মাতাল বাঁশি
হামিদ মোহাম্মদ
(সাহিত্যের বহু শাখায় বিচরণ হামিদ মোহাম্মদ-এর। কবিতা,গল্প, উপন্যাস এমনকি মননশীল সাহিত্য কোনটাই বাদ যায়নি। লিখেন সমান সৃজনশীলতা নিয়ে, সমান উজ্জ্বলতায়। সত্যবাণী প্রতি রোববার ধারাবাহিক প্রকাশ করবে তাঁর লেখা উপন্যাস ‘মাতাল বাঁশি’। সাম্প্রতিক নানা বিষয় থেকে শুরু করে ধর্মীয় মৌলবাদী উত্থান, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন, চিকিৎসাবাণিজ্য, বাঙালি, বাংলাদেশ এবং বিলেতের অভিবাসী প্রেক্ষিত—সব একসুত্রে গেঁথেছেন লেখক। পাঠক পড়তে থাকুন,আমরা আছি আপনাদের সঙ্গে।)
॥পনের॥
আমি মাঝে মাঝে ঢাকায় নাফিসের চাকরি স্থলে প্রতিষ্ঠানটির তরফ থেকে পাওয়া বা বরাদ্দকৃত বাড়িটিতে উঠি, অনেকটা ভাগাভাগি করে দু’জনে ঢাকা ও সিলেটে থাকি। মাসে আমি যদ্দিন পারি ঢাকায় থাকব অথবা নাফিস সাধ্যমত সিলেট দু’দিন ঘুরে যাবে। নাফিসের অফিস সপ্তাহে পাঁচদিন, আর আমার হাসপাতাল ডিউটি তিনদিন, চেম্বার করি দু’দিন–মোট পাঁচদিন ডিউটি। চাকরি আর জীবনকে এমনিই একটি নির্দিষ্ট ফর্দে ভাগ করে নিই। মিলিয়ে খাপ খাইয়ে চলা স্থির করি। মন্দ নয়, এই বদলে-চলা কিংবা বলতে গেলে বাংলাদেশে এই চ্যালেঞ্জটা নেয়া।
ঢাকা-সিলেট যাতায়াত বর্তমানে আগের চেয়ে অনেক সহজ। ট্রেনে বা বাসে কোনটাই তেমন কষ্টদায়ক নয়। ট্রেন এখন আর আখাউড়া জংশন হয়ে চলাচল করে না। আখাউড়ার এক স্টেশন আগেই নতুন বাইপাস হয়েছে, সে বাইপাস দিয়ে আখাউড়া না পৌছে, আগের মত আর দু’ঘন্টা ট্রেন সান্টিং করে ব্যয় না করেই ঢাকার পথ। সান্টিংকরার সময়টা বাঁচিয়ে দু’ঘন্টা আগে ঢাকা পে ৗঁছে ট্রেন চার থেকে পাঁচ ঘন্টায়। আমরা দু’জনেই ট্রেনে যাতায়াত পছন্দ করি। উপভোগ করি বাংলাদেশের মনোরম প্রাকৃতিক অন্যতমশ্রেষ্ঠ দৃশ্যাবলি, চাবাগানের সবুজ সৌন্দর্য। হা-করে গিলতে বাকী থাকে-না বোকার মত ছুটে চলা গ্রাম, বন আর পথের চমকে দেয়া নানা চলচ্ছবি।
নাফিস ‘হিউম্যান সার্পোট-বাংলাদেশ’-এর এ্যাসিসটেন্ট একজিকিউটিভ পদে কাজ করাটা বেশ স্বছন্দবোধ করছে। কথা ছিল সে একটি ব্যতিক্রমী কর্মসূচী হাতে নেবে, যা দিয়ে বুঝানো যায় শিক্ষা বাণিজ্য নয়, এটি মানুষের নাগরিক অধিকার। যা আমি বা নাফিস কিংবা মা বিলেতের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে রপ্ত করেছিলাম। ভাবনা ছিল বাংলাদেশে এর একটি মডেল তৈরি করব। কিন্তু এরকম কোন কার্যক্রম শুরু করা আপাতত বাংলাদেশে কঠিন। বিশেষত যে শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছে বাংলাদেশে, তা এখনও পরীক্ষা-নীরিক্ষার পর্যায়ে। কিন্ডারগার্টেন শিক্ষাপদ্ধতি বা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনকি সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোনটারই প্রকৃত অবস্থান এখনও কোন মাপকাঠিতে পৌঁছেনি। একটি বিশৃঙ্খল অবস্থায় দিশাহীন হয়ে পথ খুঁজছে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যস্থা। কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতি, বেসরকারি স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় সবগুলোতেই এক উদ্ভট শিক্ষা পদ্ধতি বিরাজমান। এ প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইংরেজির চাপ বেশি। বাংলা জাতীয় ভাষা হলেও তার কোন ছিটেফোঁটাও পাঠ্যসূচীতে নেই। এক ধরনের চরম উদাসীনতা, বিদেশমুখিতা বা পুঁজিবাদী দৌঁড়ে এক অসম প্রতিযোগিতা সৃষ্টিকারি শিক্ষাব্যবস্থার বিপরীতে নাফিস যে কাজটি করতে চেয়েছিল, মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা, তা আপাতত স্থগিত রেখেই ‘হিউম্যান সার্পোট, বাংলাদেশ’-এর চকচকে এই কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ে।
আসলে তার প্রতিষ্ঠানেও প্রকাশ্যে দেখা যায় যে, প্রতিষ্ঠানটি মানুষকে পথ দেখাচ্ছে, মূলত তা নয়, আশ্চর্যের বিষয়–শোষণ নামক পুঁজিতন্ত্রের একটি ভিন্ন মাত্রার হাতিয়ার এই ‘হিউম্যান সাপোর্ট-বাংলাদেশ’।
আফ্রিকার দরিদ্রপীড়িত দেশ তথা সোমালিয়া, নাইজেরিয়া, নামিবিয়া, মোজাব্বিকসহ আফগানিস্তান, দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, চিলি, ভেনিজুয়েলা এবং উত্তর আমেরিকার দরিদ্র স্টেটগুলোতে এর কার্যক্রম রয়েছে। এর পৃষ্টপোষক যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের ধনী সম্পদশালি দেশ এবং ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানসমূহ। সুদ-নির্ভর একটি জনহিতকর ব্যবসা, যার থাবার ভেতর একবার মাথা দিলে, আর নিস্তার নেই, এমনি এক ক্ষমতাবিস্তারি প্রতিষ্ঠান হিউম্যান সার্পোট, বাংলাদেশ’।
মন ও চিন্তার বিপরীতে কাজ। নাফিস কিভাবে যেন এতো দিনে মানিয়ে নিয়েছে। সে ছুটে চলে এ দেশ থেকে ঔদেশে। প্রতিমাসে একাধিক সেমিনার, আর্ন্তজাতিক কনভেনশন ইত্যাদিতে বক্তব্যদান, পেপার সামিট, আরো নানা ওয়ার্কসপ। সবগুলোতেই উপস্থিত থাকতে হয়, সংস্থার পরিসর বৃদ্ধিসহ বৈশ্বয়িক কাজে শ্রম ও মেধা-ই গতি সঞ্চারের একমাত্র উপায়।
আমিও মানিয়ে নিয়েছি। নিয়মিত কথা বলে দু’জনে তৈরি করি আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের রুটিন। কবে, কখন কে, কোথায় ঢাকা না সিলেট থাকবো এগুলো হয়েছে আমাদের পা ফেলার অগ্রিম বার্তা। এক কৃত্রিম জগৎ তৈরি হয়েছে আমি ও নাফিসের জীবন ঘিরে। যেখানে মাতাল হওয়ার মত কোন পাগলা বাঁশি বাজে না, অথবা হয়ত বাজে, আমরা ধরতে পারি না বা বুঝি না। (চলবে)