মাতাল বাঁশি
হামিদ মোহাম্মদ
(সাহিত্যের বহু শাখায় বিচরণ হামিদ মোহাম্মদ-এর। কবিতা,গল্প, উপন্যাস এমনকি মননশীল সাহিত্য কোনটাই বাদ যায়নি। লিখেন সমান সৃজনশীলতা নিয়ে, সমান উজ্জ্বলতায়। সত্যবাণী ধারাবাহিক প্রকাশ করলো তাঁর লেখা উপন্যাস ‘মাতাল বাঁশি’। আজ প্রকাশিত হচ্ছে এর শেষ পর্ব।
সাম্প্রতিক নানা বিষয় থেকে শুরু করে ধর্মীয় মৌলবাদী উত্থান, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন, চিকিৎসাবাণিজ্য, বাঙালি, বাংলাদেশ এবং বিলেতের অভিবাসী প্রেক্ষিত—সব একসুত্রে গেঁথেছেন লেখক ‘মাতাল বাঁশি’ তে। দীর্ঘ কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতি রবিবার ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত এই গল্পে সত্যবানীর সাথে থাকায় আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।
॥শেষ পর্ব॥
আর মাত্র পাঁচ মিনিট পর দেখা হবে মা’র সাথে। দেখবো এক হাতে কাগজের ডিসপজেবল একটি ছোট্ট ট্রে’তে আমার জন্য কিসমিসওয়ালা কেক কয়েক পিস ও কস্টার কফির বড় কাপ। আরেক হাতে কফির কাপ, তিনি চুমুক দিচ্ছেন ঘনঘন। হয়ত আমার মত লাল শাড়ি পরনে তার। শীতের দিনে মাথায় ভারী টুপি। কোন রঙের, হয়ত কালো হবে। লালের সাথে কালো টুপিই মা’র পছন্দ।
আমি বাংলাদেশ থেকে দু’বছর আগে সরাসরি লন্ডন না এসে আসছি দু’বছর পর। ভাবতেই পারি না আমার একগুয়েমিটা কী পরিমাণ ব্যতিক্রমী, বেয়াড়া। তবে বেয়াড়ামিতে মা বাঁধা দেননি, বলতে গেলে সহযোগিতাই করেছেন। পড়ালেখায় বাড়তি সময় কাটানো বা ব্যয় করা কোনদিনই আপত্তির নয়, বরং উৎসাহের। এজন্য বাংলাদেশ থেকে তিনটি সুটকেসের মধ্যে দুটি সরাসরি লন্ডনে মা’র কাছে পাঠিয়ে একটি সুটকেসে প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় আর কিছু ব্যবহার্য জিনিসপত্তর নিয়ে জার্মান পৌঁছি।
‘বীরমুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম হাসপাতালÑএক টাকার হাসপাতাল’ সম্পর্কে আলাদা যে মায়া তৈরি হয়েছিলÑতা বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর উবে যায়। গত দু’বছরে আমার মাথায় তা নেইও যেন। ছিন্ন হয়ে গেছে সব, টানটুন নেই। ভুলতে বসেছি ডাক্তার আপা বা এক টাকার ডাক্তার যে কোন ডাক বা পরিচয়ও। তবে, আমার শান্তনাÑএকটি বৃক্ষ রোপন করতে পেরেছি, এক টাকায়ও চিকিৎসা করা যায়, এক টাকায় রোগী দেখে রোগীকে ভাল পরামর্শ দেয়া সম্ভব। অনেকে আমাকে পরামর্শ দিতে চেয়েছিলেন, আমি এ নিয়ে আন্দোলন শুরু করি না কেন। থানা উপজেলায় কমিটি করে একটি সংগঠন তৈরি করি না কেন। বেসরকারি হাসপাতাল বন্ধ করাসহ নানা জনহিতকর কর্মসূচী দিয়ে সরকারকে বাধ্য করতে চিকিৎসাকে বাণিজ্যকরণ থেকে বাঁচানো।
আমি তাদের ধন্যবাদ দিয়ে বলেছিÑবাংলাদেশে আমার চেয়েও আরও খ্যাতিমান, পরিশ্রমী অসংখ্য ডাক্তার রয়েছেন, যেমন গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিটিকেলের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী। হাল আমলের নবীন ডাক্তার বরিশালের মনীষা চক্রবর্তী। তাদেও সাহস, কর্মচাঞ্চল্য, দেশপ্রেমের কাছে আমি তুচ্ছ একজন।
আজ আমি একজন ভারমুক্ত মনুষ্য জীব। কোন দায় নেই, নেই নাফিসের মত একটি জানোয়ারের কোন ছায়াও আমার জীবনে। আমার হাসপাতাল যখন উঠে যাবার উপক্রম এবং বিব্রত অবস্থায় সিলেট অবস্থান করছিলাম, তখন নাফিসকে খুঁজে পেতে আমার এক মাস সময় লাগে। হয়ত ফোন ধরে, কখনো টেক্সের উত্তর দেয়, দু’দিন পর বা আরো পরে, ফোন ব্যাক করে না। আমি, বলতে গেলেÑঅস্থির হয়ে খোঁজাখুঁিজ করছি।
এদিকে, তাদের ‘হিউম্যান সার্পোট, বাংলাদেশ’-এর পরিচালিত ‘নার্সিং হোম’এর পেছনে পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ লেগেছে। এ প্রতিষ্ঠানটি নাকি মধ্যপ্রাচ্যে নার্সের চাকরির নামে নারী পাচার করছে। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় সচিত্র সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। কয়েকটি টেলিভিশনেও তথ্যভিত্তিক সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গেও আমি বার বার খোঁজ নিচ্ছি নাফিসের, কিন্ত সে কোন গুরুত্ব দিচ্ছে না আমাকে।
আজ সোমালিয়া কাল মাদাগাসকার,পরশু আফগানিস্তান। এই যখন অবস্থা তখন একদিন আমাকে বলে ওঠে,‘আমাকে ভুলে যাও, আমি জীবন বদলে ফেলতে চাইছি। তুমি চেনোÑআউয়াল সাবের মেয়ে তসলিমা আউয়াল ‘হিউম্যান সাপোর্ট-বাংলাদেশ’-এর ডেপুটি একজিকিউটিভ আর আমি একজিকিউটিভ এখন। আমরা দু’জনে ঘর বাধতে প্রস্তত। আউয়াল সাব মারা গেছেন গত বছর, তার অবর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানটির মালিক আমরা দু’জন। সুতরাং এই অবস্থায় ভিন্ন কিছু ভাবার সুযোগ কম। আমাকে ক্ষমা করে দিও।’
আমি সত্যাসত্য জানার কোন প্রশ্ন না করেই জটপট উত্তর দিলামÑতোমার মত কাপুরুষকে কালকেই আমি ডির্ভোস পাঠাচ্ছি, আমি আর পাপের কোন বোঝা বহন করতে চাই না। ফোন রেখে দিই টাস করে মুহূর্ত দেরি না-করে। সে নারী পাচারেও জড়িয়ে গেছে কি না, সন্দেহ হল।
এরপরই সিদ্ধান্ত নিই আমি জানতে চাই ‘মানুষের জীনগত প্রভাব,নৃত্ত¡াত্তিক পরিচয়’ সম্পর্কে। সারারাত ইন্টারনেট ঘেটে পাই জার্মানীর হাইডেলবার্গ ইউনির্ভাসিটিতে ‘এন্ত্রোপলজিক্যাল গেøাবাল হেলথ’ কোর্সটি। আমি বুঝতে চাই আউয়াল মুনসী যে ‘মারিয়েটা’কে প্রতারণা করেছিল, সেটার সাথে তার মেয়ে তসলিমার রক্ত বা জীনগত সম্পর্ক। আমি ডাক্তার, আমার জীবন দিয়ে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা এবং অর্জনটি কেমন হবে মানুষের কল্যাণে, ভবিষ্যত মানবপ্রজাতির জন্য কতটুকু প্রয়োজনÑতা নিয়ে পাগলের মত ভাবতে থাকি দিনরাত।
আমি মনস্থির করি এই সাবজেক্টটি আমার আনন্দের বস্তুও হতে পারে। প্রাপ্তিটা কোন আবেগের হবে না, বা নয়, বাস্তববাদী আমি। আমার কোন প্রাপ্তি এমনও হতে পারে, হয়ত এ প্রাপ্তিটা জড়িয়ে যেতে পারে বিশ্ব মানবতার কল্যাণে। এসব আকাশকুসুম ভাবনা, পাগলামি নিয়েই আমি হাইডেলবার্গ ইউনির্ভাসিটিতে দু’বছর স্টাডি করে ফিরছি আজ লন্ডনে।
মানুষের পরাজয় প্রতিনিয়ত ঘটছে ষড়যন্ত্র আর চক্রান্তের জালে পড়ে। সে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রকে উপড়ে ফেলতে পারিনি, বলতে গেলে এক ধরনের পরাজয় মেনে নিয়ে আমি লন্ডনে ফিরছি। তবে আমি এটাকে পরাজয় হিসেবে মেনে নিইনি। আমি একজন জীবনজয়ী মানবপ্রাণী বলেই ভাবতে ভালবাসি। যা ছিলাম, সত্য ও সুন্দরের বাঁশি বাজনো হ্যামিলনের একজন বংশিবাদক।
মূহুর্তের মধ্যেই মা’কে চোখে পড়ল। সত্যিই একটি লাল শাড়ি পেঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন দু’হাত ভর্তি শুকনো খাবার এবং সালাম কাকুর হাতে দুটি লাল-নীল-হলুদ রঙের সাথে মাখামাখি করা সবুজ পাতায় জড়ানো ফুলের ভাঞ্জ বা তোড়া। এগিয়ে এলেন মা। আমি খানিকটা হাত বাড়াতেই সালাম কাকু আমাকে মনে করিয়ে দিলেন কোভিড-১৯এর কথা। মাস্ক খুলে নিয়েছিলেন তারা, আমিও মাস্ক খুলে থুতনিতে নামিয়ে নিয়েছি। সামাজিক আর শারীরিক দূরত্বটা বাঁধ সাধলো মা’র গলা জড়নোর উষ্ণ আলিঙ্গনকে দূরে ঠেলে। বায়বীয় পদ্ধতিতে মাকে হাক দিলামÑউড়ন্ত চুম্বন। এই মা আমার হাক ছাড়া বাঁচেন না। তিনি ব্রিকলেনের মত বর্তমানে পরহেজগার মানুষের কোলাহলমুখর এলাকায় বরাবরই বিদায় বা দেখা হলে প্রকাশ্যে যে কেউকে হাক দেন। এটা তার সংস্কৃতি, আন্তরিক ব্যবহার, যা বাঙালি মেয়েরা বর্তমানে চর্চা করে না। যারা বোরকা ছাড়া বুঝেই না ব্রিকলেনকে। সেই মা হিথরোতে আমি তার মেয়ে মাধুরী, তার কাছে আমি শিশু, মুখভর্তি দুধ, এই টিপা দিলেই উগরে দেবে, গলগলিয়ে পড়বে মুখ থেকে টোলপড়া গাল বেয়ে, তাকে হাক দেবেন না!
এই হিথরোতেও বাঙালি কজন বোরকা পরা মহিলা হা করে তাকিয়ে আমাদের আড় চোখে দেখল, তিরস্কার করল। আমি হাসলাম। হায়রে বাঙালি, বাংলাদেশে ভাস্কর্য ভাঙবে তো, কী ভাঙবে? পারলে আমাকে ভেঙে এরা চুরমার করে ড্রেনে ফেলে দেবে।
এই ক্ষণে আমার চোখে ভেসে ওঠেÑপ্রতিনিয়ত লুটপাট ও অপকর্মে চাপা পড়া মানব সভ্যতা, গুমরে উঠছে, মানুষ অসহায়, বিপন্ন। আমি বা আমরা সেই সভ্যতার অংশ।
দীর্ঘদিন পর মা’ কে পেয়ে আনন্দে কাঁপছি আমি। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, কীভাবে এতো দিন মা’কে ছাড়া আমি বাংলাদেশে ছিলাম। বুকে বাজতে থাকা ‘মাতাল বাঁশি’ অবিরাম জীবন-যুদ্ধের গানে বিভোর। সুস্থ সাংস্কৃতিক ধারা প্রতিষ্ঠার লড়াইকে আকড়ে থাকা আমার মা, মৃত বাবা কখনো হারেননি। চিকিৎসা ও শিক্ষা ব্যবস্থা বাংলাদেশে যে বাণিজ্যকরণের বৈশ্বয়িক সৃষ্ট ¯্রােতে ভাসছে, তার নীচে চাপা পড়া জীর্ণ সভ্যতায় ক্ষীণ হলেও আমি সেই ‘বাঁিশ’ বাজিয়ে এসেছি। বৃক্ষরোপন করেছিÑ‘এক টাকার হাসপাতাল’ যা আমার মতে সত্য ও সুন্দর প্রতিষ্ঠার এটি-ই একটি ‘মাতাল বাঁশি’। সমাপ্ত