মাতাল বাঁশি

 হামিদ মোহাম্মদ

(সাহিত্যের বহু শাখায় বিচরণ হামিদ মোহাম্মদ-এর। কবিতা,গল্প, উপন্যাস এমনকি মননশীল সাহিত্য কোনটাই বাদ যায়নি। লিখেন সমান সৃজনশীলতা নিয়ে, সমান উজ্জ্বলতায়। সত্যবাণী প্রতি রোববার ধারাবাহিক প্রকাশ করবে তাঁর লেখা উপন্যাস ‘মাতাল বাঁশি’। সাম্প্রতিক নানা বিষয় থেকে শুরু করে ধর্মীয় মৌলবাদী উত্থান, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন, চিকিৎসাবাণিজ্য, বাঙালি, বাংলাদেশ এবং বিলেতের অভিবাসী প্রেক্ষিত—সব একসুত্রে গেঁথেছেন লেখক। পাঠক পড়তে থাকুন,আমরা আছি আপনাদের সঙ্গে।)

॥এগারো॥

বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের বিস্তার প্রথমে শুরু হয় চিনের উহান প্রদেশ থেকে। চিনের সাথে বর্তমান বিশ্ব এতো বেশি যুক্ত তা বর্ণনাতীত ব্যাপার। বিশ্বের সর্বাধিক শিল্পোৎপাদন হয় বর্তমানে চিনে। সেই বাণিজ্যিক বিস্তৃতির কারণে চিনে উদ্ভুত করোনা ভাইরাসটি দ্রুতছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের সর্বত্র। এ পর্যন্ত প্রায় ষাট লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, এর মধ্যে ইউরোপে সর্বাধিক। এক ধরনের বিভীষিকাময় অবস্থা।

মা সেলিনা আজাদ বা আবেদীন সালাম কাকু বসে থাকার জীব নয়, ব্রিটিশ সরকার ঘোষিত কোয়ারেনটাইনে থাকলেও তারা অন লাইনে ফেইসবুকের মাধ্যমে জুম পদ্ধতিতে সাহিত্য-সংস্কৃতি ও আর্ন্তজাতিক নানা বিষয় নিয়ে বিভিন্ন দেশে বসবাস করা বন্ধুদের সাথে আলোচনা করছেন, মতবিনিময় করছেন দেশে ঘটে যাওয়া ভাস্কর্য ভাঙা ও মৌলবাদের উত্থান নিয়ে। আমার মা সেলিনা আজাদ দমে যাওয়ার পাত্রী নন, জাতির যে কোন বিপন্ন সময়ে তিনি লড়াকু সৈনিক, রীতিমত যোদ্ধা।

সেই লড়াকু মা’র সন্তান আমি ডা. মাধুরী আজাদ ২০১০ সালে হাসপাতালের দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশে যাই। আমার মা সেলিনা আজাদ এবং বাবা আহমেদ আজাদ লন্ডনে সাংস্কৃতিক কাজে আগ থেকেই সক্রিয় ছিলেন। দেশ থেকে আসার পরই তারা ছুটে চলেন এক অনুষ্ঠান থেকে আরেক অনুষ্ঠান আয়োজনে। বিশেষত প্রগতিশীল চিন্তাধারার বিভিন্ন আয়োজনের মধ্যে ১লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ উদযাপন, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস এবং শহীদ দিবস একুশে ফেব্রুয়ারি।

কবি শামীম আজাদ এই সময় প্রচলন করেন ব্রিটিশ আদলে ‘বিজয়ফুল’। ১লা ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচটি পাঁপড়িযুক্ত একটি কাগজের ফুল প্রবর্তন করেন–যা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মারক হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে থাকবেন, সেটি বুকে ধারণ করবেন। জাতীয় পতাকার লালসবুজ এই ফুলটি জাতীয় প্রতীকে রূপান্তরের কর্মসূচীটি বিলেতসহ বাংলাদেশেও দ্রুতজনপ্রিয় হয়ে পড়ে। কবি শামীম আজাদের সঙ্গে মা সক্রিয় হন। ২০১০ সালে আলতাব আলী পার্কের শহীদ মিনারে ‘বিজয়ফুল’ কর্মর্সচীর উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাঈদুর রহমান খান। ৩০ নভেম্বর এই ‘বিজয়ফুল’ উদ্ধোধনের দিনটির সন্ধ্যা ছিল বরফ আচ্ছাদিত লন্ডন। বরফের মধ্যে হাজির হন বাংলাদেশের হাইকশিনার। উদ্ধোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শতাধিক বাঙালি সংস্কৃতিকর্মী কবি সাহিত্যিক রাজনীতিক ও সাধারণ মানুষ।

সাংস্কৃতিক কর্মের ধারায় মা ও বাবা ২০১৬ সালে যুক্ত হন বাচিকশিল্পী মুনিরা পারভীন পরিচালিত ‘ছান্দসিক’এর আবৃত্তি কার্যক্রমে।‘হাজার বছরের বাংলা কবিতা–উল্লাসে সংকটে’ প্রথম অনুষ্ঠান ছিল বাংলাটাউনের ব্রাডি আর্টস সেন্টারে। উপচেপড়া ভিড় ছিল এদিন দেখার মত। এরপর সংগঠনটি পরিবেশন করে মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত ‘বীরাঙ্গনা’দের কথা ‘মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিভাষ্য’ পঠন-পাঠন আবৃত্তি।  প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক এসব কার্যক্রমে মা তার ভূমিকার কথা আমাকে নিয়মিত না জানিয়ে ঘুমান না।

এর কিছুদিন পর যুক্ত হলেন কবি হামিদ মোহাম্মদ পরিচালিত ‘কবিকণ্ঠ’-এর যুগান্তকারি কিছু অনুষ্ঠান আয়োজনে। বাংলাদেশে গত বছরগুলোতে এতবেশি নারী নির্যাতন সংঘটিত হচ্ছে, যা সভ্য জীবনব্যবস্থাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে চলছে বিশ্বব্যাপী বর্ণবাদী আচরণ। সভ্য সমাজ ও শান্তিপ্রিয় মানুষ বিচলিতবোধ করছেন, টালমাটাল রূপ নিয়েছে বিশ্ব। প্রগতিশীল ও প্রতিবাদী সাহিত্যান্দোলনের অন্যতম প্লাটফরম ‘কবিকণ্ঠ’। ‘কবিকণ্ঠ’ ইতোধ্যেই আয়োজন করেছে ‘ধর্ষনের বিরুদ্ধে কবিতা’ আবৃত্তি ও স্বরচিত কবিতা পাঠ। এতে অংশ নিয়েছেন বিলেতের কবি ও আবৃত্তিকারবৃন্দ। ২০১৮ সালে  লন্ডনে কবিকণ্ঠ আয়োজিত ‘ধর্ষণ বিরোধী–প্রতিবাদের কবিতাপাঠ’ এবং ‘বর্ণবাদ, সাম্পদায়িকতা ও মৌলবাদ বিরোধী’ কবিতাপাঠ এবং ‘কবি মুজিব ইরম-এর কবিতা ও সাহিত্য’ নিয়ে ব্যতিক্রমধর্মী অনুষ্ঠানের আয়োজনে যুক্ত হন মা সেলিনা আজাদ ও বাবা আহমেদ আজাদ।

এসব অনুষ্ঠান এবং ব্যতিক্রমী আয়োজনে বাবা ও মা নিয়মিত কর্মী। এর মাঝে এক ভর দুপুরে বাংলাদেশে খবর এলো বাবা হার্ট-এ্যাটাকে মারা গেছেন। আমি দৌঁড়ে এলাম লন্ডনে। সে অনেক কথা।

২০১৭ ও ২০১৯ আয়োজন করা হয় বিলেতে বাংলা বই মেলা ও সাংস্কৃতিক উৎসব। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক পরিষদ আয়োজন করে দু’দিনব্যাপী এ আয়োজনের। এতে বাংলদেশ থেকে বেশ কয়েকটি প্রকাশনী সংস্থা অংশ নেয়। ২০১৯ সালে অতিথি আলোচক হিসেবে অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাবিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. ভীষ্মদেব চৌধুরী ও কথাসাত্যিক শাহাদুজ্জামান এবং কবি শামীম আজাদ। মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন কবি হামিদ মোহাম্মদ। এই  সমস্ত আয়োজনে মা সেলিনা আজাদ কর্মী হিসেবে উপস্থিত থাকেবেন না তা কল্পনা করা কঠিন। আমি বাংলাদেশ থেকে তাদের এসব কাজকর্মে উদ্দীপ্ত ও উজ্জীবিত হতে থাকি।

এদিকে, কবি টি এম আহমেদ কায়সারের উদ্যোগ ও কর্মে উজ্জ্বল কিছু সাংস্কৃতিক কাজ বিলেতের বহুজাতিক সোসাইটিতে আলোবিস্তার করে চলেছে–যার উচ্চতা অনন্য। তার ব্যতিক্রমী কাজের সংগঠনের নাম ‘সৌধ- সোসাইটি অব পয়েট্রি এন্ড ইন্ডিয়ান মিউজিক’ এবং রাধারমণ সোসাইটি’। ২০১০ সাল থেকে ‘সৌধ’-এর মাধ্যমে বিলেতে গ্লোবাল মিউজিক এন্ড লিটারেচার এবং ‘রাধারমণ সোসাইটির বাংলা কবিতা ও লোকগান তথা লোক সংস্কৃতিচর্চা এক অভাবনীয় আন্দোলনমুখী কর্মযজ্ঞ সৃষ্টি করে। লোককাহিনি ভিত্তিক পালাগান ‘বিননন্দের কিচ্ছা’ ‘রূপবান’ ও ‘বেদের মেয়ে জোৎস্না আধুনিক বিনির্মাণ, ক্লাশ স্ট্রাগাল উপস্থাপন, মঞ্চায়ন এবং বিলেতের বিভিন্ন শহরে এর পরিবেশনা ২০১৮ ও ১৯ সাল ছিল এক ভিন্নমাত্রিক। সৌধ আরও আয়োজন করে ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি কবি জীবনান্দ দাশের ১২১তম জন্মতিথি অনুষ্ঠান। এতে জীবনীপাঠ, জীবনানন্দ দাশের কবিতার বিশ্বমাত্রিকতা নিয়ে আলোচনা, কবিতা আবৃত্তি, নৃত্য পরিবেশনা। সব মিলিয়ে অনুষ্ঠানটি ছিল অন্যন্য এক বর্ণাঢ্য আয়োজনে সমৃদ্ধ। বিলেতের শ্বেতাঙ্গ, ভারতীয় অভিবাসী ও দক্ষিণ এশীয় মানুষের আগ্রহ ছিল এসব পরিবেশনার কেন্দ্রবিন্দুতে, এক বিপ্লবাত্মক পরিচিতি এনে দেয় বাংলা লোক সংস্কৃতির বৈশ্বয়িক ধারায়, গুণগত মৌলিকতায়। এসব অনুষ্ঠান ও উপস্থাপনে মা একজন নেপথ্যকর্মী, স-আবেগে ব্যাপৃত টি এম কায়সারের অনুসঙ্গী, নিত্য নতুন চিন্তার প্রতি সমর্থন, কী যে উদভ্রান্ত, উন্মাদনায় ভরপুর এসব। শুদ্ধতম বাংলাচর্চা বাইরে থাকবে, ভাবতেও পারি না। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা অন-লাইন পোর্টাল, বাংলাদেশের ‘প্রথম আলো’র মাঝে এসব কর্ম নিয়ে সবিস্তার আলোচনা ফিচার আমাকে মা’ একের পর এক পাঠান, আর আমিও ডুবে থাকি এ সবে, দিনকে দিন। প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় লিডসে রাধারমণ সোসাইটির উদ্যোগে তিনদিনব্যাপী রাধারমণ উৎসব। কোন সংস্কৃতিকর্মী সে উৎসবে যায়নি, তেমন লোক বিলেতে খুব একটা  খুঁজে পাওয়া যাবে না। গান পাগল হাজার মানুষের ভীড়ে আমার মা সেলিনা আজাদ একজন অস্থির সাংস্কৃতিক ‘দূত’। কেউ তাকে ডিঙিয়ে যাবে সে সাহস ধারণ করে এমন লোক বিলেতে দ্বিতীয় জন নেই। আমিও আনন্দ পাই।

এবারের করোনাকালেও নভেম্বর মাসে তিনদিনব্যাপী অন-লাইন জুম মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয় লীডসে রাধারমণ উৎসব। তিনদিনের আয়োজনে আলোচনা, গান, নৃত্যসহ নানা বক্তব্য ছিল ভিন্ন মাত্রার। বিশ্বের বহু দেশ থেকে শতাধিক শিল্পী সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মীর যোগদান ছিল আরেক ইতিহাস সৃষ্টিকারি। মা ছিলেন এই তিনদিনের  অবিচ্ছিন্ন একজন।

রাধারমণ সোসাইটির অন-লাইন উৎসব ছাড়াও ২০২০ সালের চলমান করোনা ভাইরাসের প্রকোপেও বসে নেই মা। তিনি জড়িয়ে পড়েছেন অন-লাইন জুম প্রোগ্রামে, নানা আয়োজেনে। সঙ্গে সালাম কাকুও, তারা যেন এক গতিশীল ধুমকেতু দু’জন। আমি আনন্দ পাই তাদের সীমাহীন না-থামা সাস্কৃতিক উদ্যমে, কর্মে বিভোর থাকার উদযাপনে। (চলবে)

 

You might also like