মুক্তিযুদ্ধের প্রবাসী সংগঠক আনোয়ার জাহান জেপির সাক্ষাৎকার
নিলুফা ইয়াসমীন হাসান
বার্তা সম্পাদক, সত্যবাণী
বার্তা সম্পাদক, সত্যবাণী
(একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে প্রবাসী বহু নারী ও পুরুষ অবদান রেখেছেন। বর্তমানে প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যে চলমান তালিকা প্রকাশিত হয়েছে সেখানে এখনো কোন নারী সংগঠকের নাম আসেনি। এমনি সময় মুক্তিযুদ্ধের প্রবাসী সংগঠক আনোয়ার জাহান জেপির এই সাক্ষাৎকারটি পুনর্মূদ্রণ সময়োপযোগি বলেই আমরা মনে করছি।)
[একাত্তরের নভেম্বরে আমরা আবারও বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের ও ধর্ষনের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার কাটিংসহ আন্তর্জাতিক বিচারালয়ে ইয়াহিয়া সরকারের বিচারের দাবী জানিয়ে বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রপ্রধান ও নেতৃস্থানীয় মহিলাদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছি। ৩ ডিসেম্বর মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য ইন্দিরা গান্ধীকে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছি। ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতিদান ও পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবীতে আমরা মিছিল করেছি, হাইড পার্কের স্পিকার্স কর্ণারে সভা করেছি।]
‘স্টপ জেনোসাইড, রিকোগনাইজ বাংলাদেশ; ইয়াহিয়ার আর্মী আউট আউট, তোমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ শ্লোগান দিয়ে যারা ১৯৭১ সালে ব্রিটেনের মাটি কাঁপিয়ে তুলেছিলেন এবং অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদেরই অন্যতম একজন আনোয়ারা জাহান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে ব্রিটেনে গঠিত বাংলাদেশ মহিলা সমিতির (বাংলাদেশ ওমেনস্ এসোসিয়েশন অব গ্রেট ব্রিটেন) সেক্রেটারী ছিলেন আনোয়ারা জাহান।
একজন গুণী, কর্মঠ ও সংগ্রামী নারী আনোয়ারা জাহান জন্ম গ্রহন করেন ১৯৩৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ’৫৯ সালে ইকোনমিক্স এবং ’৬৬ সালে সোসিওলজিতে তিনি মাস্টার্স করেছেন, সেই সঙ্গে টিচার্স ট্রেনিংও নিয়েছেন। স্মল ইন্ডাস্ট্রি করপোরেশনে রিসার্চ অফিসার হিসাবে চাকরী করেছেন। আনোয়ারা জাহান ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতি সচেতন ছিলেন, টাঙ্গাইলের কুমুদিনী কলেজে পড়াকালীন সময়ে কলেজ ইউনিয়নের সেক্রেটারী ছিলেন। আইয়ুবী শাসনের বিরুদ্ধে তৎকালীন সময়ের বিভিন্ন আন্দোলনে শরীক হয়েছেন। বরাবরই অসহায় মেয়েদের জন্য এবং নারীর অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য কিছু করার বাসনা ছিল আনোয়ারা জাহানের।
দুই ছেলে এক মেয়ের জননী আনোয়ারা জাহান ১৯৬৭ সালে ব্রিটেনে এসেছিলেন উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে। পিএইচডি শেষ করে দেশে ফিরে যাবেন এটাই ছিল আশা। অবস্থার বিবর্তনে পিএইচডি করা সম্ভব হয়নি। লন্ডন ইউনিভার্সিটি থেকে টিচার্স ট্রেনিং করেছেন। পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরী ও কমিউনিটি ওয়ার্ক করেছেন। ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, ফ্যাক্টরী ও পোষ্ট অফিসে কাজ করেছেন।
পরবর্তীতে মালবারী স্কুল, ডেইনফোর্ড স্কুল ও ক্যামডেন কমিউনিটি স্কুলে ফুলটাইম টিচার হিসাবে কাজ করেছেন আনোয়ারা জাহান। দশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে গ্রেড ওয়ান থেকে শুরু করে ডেপুটি হেড হয়েছেন। আনোয়ারা জাহান ব্রিটেনের স্কুলে বাংলা শিক্ষার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৪ সালে আরো কয়েকজন মিলে নর্থ লন্ডনের হিন্সবারী পার্কে বাংলা স্কুল চালু করেন। তিনি লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে ‘বাংলা’র অন্যতম এক্সামিনার ছিলেন। বাংলার শিক্ষার্ত্রীদের সুবিধার্থে আনোয়ারা জাহান, জেবুন্নেসা বক্স ও সুফিয়া রহমান মিলে ‘এসো বাংলা পড়ি’ নামে বই লিখেছেন। লেখালেখির সঙ্গে সেই ছোটবেলা অর্থাৎ ১১ বছর বয়স থেকেই জড়িত আছেন আনোয়ারা জাহান। তিনি ছোটদের জন্য বই লিখেছেন, অনুবাদ করেছেন, তাঁর প্রবন্ধ ও কবিতার বইও বেরিয়েছে। আনোয়ারা জাহানের তিন ছেলেমেয়েই গ্রাজুয়েশন করেছেন। তিনজনই ইঞ্জিনিয়ারিং পেশায় নিয়োজিত।
আনোয়ারা জাহান প্রথম বাঙালী মহিলা, যিনি জাস্টিস অফ পিস হিসাবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। ১৯৮০ সালে থেকে দীর্ঘ ২৭ বছর তিনি এই সম্মানজনক পদে (জেপি) কাজ করেছেন। তিনি কমিশন ফর রেসিয়াল ইকুয়ালিটির কমিশনার হিসাবে অভিবাসী মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব করেন। আনোয়ারা জাহান আরো যে সকল প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন সেগুলো হলো: ইউনাইটেড কিংডম ইমিগ্রান্টস এডভাইজারী সার্ভিসের এক্সিকিউটিভ মেম্বার, এশিয়ান ফোরামের ডেপুটি চেয়ার এবং ইউকে এন্ড ইউরোপ বাংলাদেশ ফোরামের ডেপুটি চেয়ার।
সাউথ ইস্ট লন্ডনের নিউক্রসের এশেমড্্ রোডের বাড়ীতে ’৭২ সাল থেকে বসবাস করছেন আনোয়ার জাহান। চাকুরী থেকে অবসর নিলেও বর্তমানে তিনি বই পড়ে, লেখালেখি করে এবং সাংগঠনিক কাজকর্ম করে সময় কাটান।
আনোয়ারা জাহান প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়কার স্মৃতি রোমন্থন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসে বাঙালী নারীর অবদানের প্রসঙ্গ তুলতেই আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন আনোয়ারা জাহান। আনোয়ারা জাহান স্মৃতি হাতড়িয়ে অনেক কিছু বলেছেন, আবার কিছু কিছু ঘটনা স্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে বলে জানালেন। তিনি বলেন, দেশে তখন (১৯৭১ সালে) ঘোরতর সঙ্গিন অবস্থা। মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা ভারতের সাহায্য নিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। শোনা যাচ্ছিল তাদের অনেক কিছু প্রয়োজন। উপায় খুঁজছিলাম কি করে মুক্তিসেনাদের সাহায্য করা যায়। বলতে পারেন সেই প্রেক্ষিতেই আমরা প্রবাসে ‘বাংলাদেশ মহিলা সমিতি’ গঠন করি। তারপরের কথামালা পাঠকের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন/উত্তর আকারে তুলে ধরা হলো Ñ
প্রশ্ন: সেই সময়ে আপনার সহযোদ্ধা কারা ছিলেন?
উত্তর: ১৯৭১-এর ২রা এপ্রিলে ১০৩ লেডবারি রোডের ছোট একটি ঘরে ‘বাংলাদেশ মহিলা সমিতি’র জন্ম। সেদিন মাত্র আমরা গুটিকতক বাঙালী বোন পাকিস্তানীদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলাম। জেবুন্নেসা বক্স ছিলেন মহিলা সমিতির প্রেসিডেন্ট, আমি সেক্রেটারী, বুলু, বিলকিস বানু ছিলেন উপদেষ্টা। আরো যারা ছিলেন তাঁরা হলেন মুন্নি রহমান, কুলসুম উল্লাহ, সুফিয়া রহমান, শেফালীসহ আরো অনেকে। পরে সাড়ে তিনশ’র মত মহিলা যোগ দিয়েছেন আমাদের সঙ্গে। স্বতঃস্ফুর্তভাবে সবাই এসেছিলেন। লন্ডনের বাইরেও আমাদের সদস্য ছিল।
প্রশ্নঃ আপনাদের মূল কাজ কি ছিল?
উত্তর: মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ফান্ড রেইজিং এবং বিশ্ব জনমত গড়ে তোলা।
প্রশ্নঃ সেই সময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো কি ছিল?
উত্তর: ১৯৭১ সালের শুরুতে বেশ কয় মাস ধরে বিদেশী পত্র-পত্রিকার মারফতে বাংলাদেশের রাজনীতি ও বাঙালীর অবস্থার কথা জানতে পারছিলাম। নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ বাংলার জনগনের একমাত্র দল হিসেবে আবির্ভূত হলো। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্ধকৃত জাতীয় সংসদের ১৬৯ আসনের মধ্যে বাঙালীর নেতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৬৭ টি আসন লাভ করলো। কিন্তু পাকিস্তানী গোষ্ঠী ক্ষমতা দেয়ার পরিবর্তে শুরু করলো বাঙালী নিধন। এর প্রতিবাদে সারা বাংলায় তখন শুরু হয়েছে মুক্তির সংগ্রাম। আমরা সারা ব্রিটেনে মহিলা সমিতির শাখা খোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করলাম। ‘নির্ঝর’ নামে একটি ম্যাগাজিন বের করেছিলাম মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে।
’৭১-এর ৪ এপ্রিল আমরা মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে বাঙালীদের উপর পাকিস্তানীদের হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে লন্ডনস্থ বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের রাষ্ট্রদূতদের কাছে আবেদনপত্র দিয়ে এলাম।
১০ এপ্রিল টেলিগ্রাম পাঠানো হলো জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার রাষ্ট্রনেতাদের কাছে। তাতে লেখা ছিল – ‘বিশ্ব বিবেক সতর্ক হও’, ‘বন্ধ কর পাকিস্তানীদের হাতে নির্বিচারে গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, শিশু হত্যা’ ।
১৩ এপ্রিল পাকিস্তানের দাতা দেশগুলোর কাছে আবেদন জানালাম ‘তোমাদের সাহায্য বন্ধ কর, পাকিস্তানকে সাহায্য করা মানে বাঙালীকে নিধন করা।’ তখন পাকিস্তানের বন্ধু ছিল চীন। চীনের রাষ্ট্রদূত ভবনের সামনে আমরা জড়ো হয়েছিলাম প্রতিবাদ জানানোর উদ্দেশ্যে। রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমরা দেখা করতে চাইলাম। রাষ্ট্রদূত এলেননা, এলেন একজন সাধারণ অফিসার, তাঁকে আমরা একটা চিঠি দিতে চাইলাম, যাতে লেখা ছিল ‘তোমাদের বন্ধু দেশ পাকিস্তানকে উপদেশ দাও সা¤্রাজ্যবাদী নীতি বর্জন করতে, সেই সঙ্গে তোমাদের সাহায্য বন্ধ কর, পাকিস্তানীদের হাতে বাঙালী নিধন বন্ধ কর।’ তিনি আমাদের চিঠি গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন।
১৮ এপ্রিল আমরা রাষ্ট্রদূতের স্ত্রীর কাছে টেলিগ্রাম পাঠালাম। ‘উইমেন টু উইমেন’ অর্থাৎ একজন নারীর কাছে আরেকজন নারীর ফরিয়াদ তুলে ধরা হলো। গৃহিনীদের উদ্দেশ্য করে লেখা হলো ‘তোমরাদের হাজব্যান্ডকে বুঝাও পাকিস্তানী আর্মীদের দ্বারা বাঙালী নারী ধর্ষণ বন্ধ করো, শিশু হত্যা বন্ধ করো, পুরো একটা জাতিকে নিঃশেষ হতে দিওনা।’
এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে শুরু হলো ব্রিটেনের পার্লামেন্ট অধিবেশনে এমপিদের লবিং করা। তখন আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা পালা করে পার্লামেন্টের দোরগোড়ায় বসে থাকতাম আর ভিতরে চিরকুট পাঠাতাম সরকারী ও বিরোধী দলের এমপিদের কাছে। চিরকুটে লেখা থাকতো, ‘সংবাদপত্র আর প্রেসের খবর যদি তোমাদের বিশ্বাস না হয় তাহলে আমাদের কথা শুনো, আমরা দেশ থেকে চিঠি পেয়েছি, তাতে লেখা আছে আমাদের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে অনেক মেয়েকে আর্মীরা ধরে নিয়ে গেছে, অনেক বাচ্চাকে মেরে ফেলেছে।’ পার্লামেন্টের অধিবেশনের অতিথিদের প্ল্যাকার্ড দেখানো হলো, তাদের কাছে আমাদের আবেদনপত্র পেশ করলাম – ‘পাকিস্তানকে সেন্টা থেকে বহিস্কার করো, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দাও।’
১৭ এপ্রিল আমরা মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে প্ল্যাকার্ডসহ জমায়েত হলাম ১০নং ডাউনিং স্ট্রীটের সামনে। ছাত্ররাও আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন।
প্রশ্নঃ আপনাদের কাজ কি শুধুমাত্র জনমত গঠনে সীমাবদ্ধ ছিল?
উত্তরঃ না, জনমত গঠনের সঙ্গে সঙ্গে মহিলা সমিতির সংগঠনমূলক কাজ এবং অন্যান্য সাহায্য সংগ্রহের কাজ সমানতালে চলতে লাগলো। ধীরে ধীরে ব্রাডফোর্ড, প্রেস্টন, সাউদামটন, পোর্টসমাউথ ও স্কটল্যান্ডে সমিতির শাখা খোলা হলো। মহিলা সমিতির কাজ সুষ্ঠুভাবে চালানোর জন্য পুরো লন্ডন শহরকে কয়েকটি জোনে ভাগ করে প্রত্যেক জোনে দু’জন করে আঞ্চলিক অর্গানাইজার নির্বাচন করা হলো। সমিতির সদস্য সংখ্যা ইতোমধ্যে প্রায় ৩৫০ জনে দাঁড়ালো। সদস্যদের মধ্যে যাদের শিগ্্গিরই দেশে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল বা নাম প্রকাশ হয়ে পড়লে যাদের আত্মীয়-স্বজনরা পাকিস্তানী শাসকদের তোপের মুখে পড়বেন বলে ভয় পাচ্ছিলেন, তাঁরা পরোক্ষভাবে আমাদের নানা কাজে সাহায্য করতে লাগলেন।
প্রশ্নঃ আপনাদের কার্যক্রম কি ছিল?
উত্তরঃ আমাদের আন্দোলনে শিশুরাও শরীক ছিল। জুন মাসের চার তারিখে মহিলারা সঙ্গে করে শিশুদেরও নিয়ে আসলেন, মা-শিশু মিলে প্রায় তিন’শ জনের এই মিছিলে পথচারীরাও যোগ দিয়েছিলেন। মায়েরা বাচ্চাদের হাত ধরে মহিলা সমিতির অফিসের সামনে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ালো, ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মায়েদের সঙ্গে হেঁটেছে মাইলের পর মাইল। এই বিরাট মিছিলে কাজ হলো। পরদিন প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্রে বাংলাদেশের কথা লেখা হলো। ‘নট এ পেনি নট এ গান, টিক্কা ভূট্টো ইয়াহিয়া খান’ এই শ্লোগানটি পরের দিনের বহু সংবাদপত্রের হেড লাইন হয়েছে। এতে রিলিফ অর্গানাইজেশনগুলোর টনক নড়লো। প্রচুর ওষুধ, খাবার, অর্থ সাহায্য ভারতের উদ্বাস্তু শিবিরে পাঠানোর খবর বের হলো পরের দিনের কাগজে।
প্রশ্নঃ মহিলা সমিতি কি এককভাবে কাজ করেছিলো?
উত্তরঃ আপনি প্রশ্ন না করলেও এই ব্যাপারে আমি বলতাম। বিলেতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গজিয়ে ওঠা বিভিন্ন সংস্থাগুলোকে একত্রিত করে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি সংঘবদ্ধ সংস্থা গঠন করার প্রয়োজনীয়তা তখন সকলে অনুভব করলো। কভেন্ট্রিতে এক সর্বদলীয় সভা আহ্বান করা হলো। কিন্তু কোনো দলই একমত হতে পারছিলেন না সংস্থার কাঠামো নিয়ে। শেষ পর্যন্ত মহিলা সমিতির সদস্য বিলকিস বানুর মধ্যস্থতার ভিত্তিতে সভার কাজ সমাধান করে ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হলো। আমরা মহিলা সমিতির সদস্যরা ‘এ্যকশন বাংলাদেশ’ এবং আরও কতকগুলো সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে এ্যইড বন্ধ করার আবেদন নিয়ে জার্মান ও অ্িষ্ট্রয়ান দূতাবাসে গেলাম। সেখানে পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্যের প্রতিবাদ করে দূতাবাসের সামনে আমাদের এক সদস্য এবং কিছু ছাত্র অনশন শুরু করলো। পরে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর অনুরোধক্রমে সদস্যরা অনশন ভঙ্গ করেন। প্যারিসেও এ্যইড দানের সভায় এ্যইড বন্ধ করার জন্য আবেদন নিয়ে কয়েক সদস্য দেখা করেন। রাস্তায় মিছিল আর রাষ্ট্রদূত ও রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে আবেদন করেই ক্ষান্ত হইনি, ব্রিটেনের ভার্সিটি আর কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের কাছে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহায্য করার জন্য আবেদন করেছি।
’৭১-এর ৬ অক্টোবর ব্রাইটনে অনুষ্ঠিত লেবার পার্টির কনফারেন্সে এবং ১৩ অক্টোবর কনজার্ভেটিব পার্টির কনফারেন্সে মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উত্থাপন করার জন্য অনুরোধ করি। ১৪ অক্টোবর লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে নবাগতদের সম্মেলনেও আমরা ‘ইন্ডিয়া সোসাইটি’র সহযোগিতায় একটি স্ট্যান্ড নিলাম। ছাত্রদেরকে বাংলাদেশের নির্যাতনের ভয়াবহতা তুলে ধরে ‘বাংলাদেশ সোসাইটি’ গঠন করার প্রয়োজনের কথা বুঝালাম। আমাদের উদ্দেশ্য সফল হলো অল্পদিনের মধ্যেই। আনুষ্ঠানিকভাবে ইউএলইউ (ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন ইউনিয়ন) বাংলাদেশ সোসাইটিকে স্বীকৃতি দিল।
১৭ অক্টোবর আমরা নির্যাতনের হাত থেকে বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির জন্য মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করলাম।
নভেম্বরে আমরা আবারও বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের ও ধর্ষনের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার কাটিংসহ আন্তর্জাতিক বিচারালয়ে ইয়াহিয়া সরকারের বিচারের দাবী জানিয়ে বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রপ্রধান ও নেতৃস্থানীয় মহিলাদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছি। ৩ ডিসেম্বর মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য ইন্দিরা গান্ধীকে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছি। ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতিদান ও পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবীতে আমরা মিছিল করেছি, হাইড পার্কের স্পিকার্স কর্ণারে সভা করেছি। সেখানে লেবার এমপি ডগলাস ম্যান বক্তৃতা করলেন। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। তখন আনন্দে বুক ভরে গেল।
প্রশ্নঃ আপনারা মুক্তিযোদ্ধাদের কিভাবে সাহায্য পাঠাতেন?
উত্তরঃ আমরা শুধু ভারতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যই সাহায্য পাঠাইনি, দেশের ভিতরেও সাহায্য পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করেছি। ‘এ্যাকশন ওমেগা’ নামের সংগঠনের এক সদস্য এ্যালেন কনেটের মাধ্যমে মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে আমরা বাংলাদেশের ভিতরে খাবার ও ঔষুধ পাঠাবার ব্যবস্থা করেছি। তবে দুঃখজনক ঘটনা হলো খাদ্য বিতরণের সময়ে এ্যালেন কনেট ধরা পড়ে। তাঁকে যশোর জেলে ছয় মাস আটক রাখা হয়। বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন ও ওয়ার অন ওয়ান্ট-এর মাধ্যমে আমরা জামা কাপড় পাঠালাম ভারতে উদ্বাস্তু শিবিরের শিশু ও মায়েদেরে জন্য। যুদ্ধে আহত মুক্তিসেনাদের আশু চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের কাছে এক হাজার পাউন্ড দিয়েছি।
প্রশ্নঃ আপনারা কিভাবে অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন?
উত্তরঃ ক্ষুদ্র পরিসরে আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করেছিলাম। মহিলা সমিতির সদস্যরা অর্থ সংগ্রহ করেছিল অভিনব উপায়ে। সংগতিসম্পন্ন মহিলারা সমিতির জন্য আসবাবপত্র কিনে দিয়েছেন। আমরা বিভিন্ন শো’র আয়োজন করেছি। আগেও উল্লেখ করেছি শিশুরাও আমাদের সঙ্গে ছিল। দশ এগারো বছরের ছেলেমেয়েরা প্রচ- শীতকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশের প্রতীকসহ টাই, ব্যাজ এবং ক্যালেন্ডার বিক্রি করে ফান্ড রেইজ করেছি।
প্রশ্নঃ প্রবাসে স্বাধীনতা সংগ্রামে আর্থিক সাহায্যের যে তালিকা পাওয়া যায় তাতে মহিলা সমিতির নাম নেই কেন?
উত্তরঃ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছেন। সেই সময়ে সংগৃহিত ফান্ড জমা নেয়ার জন্য একটি ট্রাস্ট গঠন করা হলো। ট্রাস্টি নির্বাচিত হলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, লেবার এমপি রাইট অনারেবল জন স্টোনহাউস, মি. ডোনাল্ড চেজওয়ার্থ (চেয়ারম্যান, ওয়ার অন ওয়ান্ট)। আমরা বিভিন্নভাবে যে ফান্ড যোগাড় করেছি তা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর উদ্যোগে গঠিত ফান্ডে দিয়েছি। আমরা নাম কুড়াবার জন্য কাজ করিনি।
প্রশ্নঃ দেশ স্বাধীন হবার পর মহিলা সমিতির কার্যক্রম কি ছিল?
উত্তরঃ দেশ স্বাধীন হলেও আমরা থেমে ছিলামনা। পাকিস্তান কারাগারে বন্দী, নির্যাতিত সামরিক ও বেসামরিক লোকজনের মুক্তির দাবীতে আমরা ওভারসিজ আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলিত হয়ে মিছিল করেছি, হাইড পার্ক স্পিকার কর্ণারে সভা করেছি। বিভিন্ন দূতাবাসে আবেদনপত্র দিয়েছি। শিশু হাসপাতালের জন্য আসবাবপত্র, শিশুদের খেলনা কিনে দেওয়া হয়েছে। পরবর্তিতে মহিলা সমিতির সদস্যরা ইন্টারন্যাশনাল আর্ট গ্যালারিতে নানারকম সুস্বাদু খাবার বিক্রি করে যে বিপুল পরিমান অর্থ যোগাড় করা হলো তার সবটাই বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দান করা হয়েছে। মহিলা সদন ও দুঃস্থ মেয়েদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছি আমরা।
১৯৭২ সালের ১৪ জানুয়ারী আমরা বিজয় উৎসব পালনের প্রস্তুতি নিয়েছি, এরইমধ্যে ৭ জানুয়ারী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন আসলেন, আমরা তাঁর সঙ্গে দেখা করেছি। আমাদের উৎসবের দাওয়াতপত্র বঙ্গবন্ধুকে দিলাম, তিনি খুব খুশী হলেন, কিন্তু সময়ের অভাবে আসতে পারবেননা বলে দুঃখ প্রকাশ করলেন। আরও অনেক ঘটনা আছে সব মনেও নেই আর জাতির সামগ্রিক ইতিহাসে বাংলাদেশ মহিলা সমিতির কার্যক্রমের মূল্যায়ন করাও সম্ভব নয়।
প্রশ্নঃ যে আশা নিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন করেছেন, দিনরাত খেটেছেন সেই আশা পূরণ হয়েছে?
উত্তরঃ বাংলাদেশ নামে নিজেদের একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি, এটাই আমাদের সার্থকতা। দীর্ঘ সময় পার হবার পরও যারা যুদ্ধকালীন সময়ে নারীদের ধর্ষণ করেছে, মানবতা বিরোধী অপরাধ করেছে তাদের বিচার হচ্ছে দেখে ভাল লাগছে, তবে এই যুগে ফাঁসির শাস্তি চাইনা, তবে বাংলাদেশের আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি যা তাই হবে।
প্রবাসের কথা বলবো বাঙালী পলা মঞ্জিলা উদ্দিন ‘ব্যারোনাস’ হয়েছেন, পার্লামেন্টে বাঙালী এমপি পেয়েছি এরজন্য গর্ববোধ করি।
সর্বশেষে বলবো, স্মৃতির পাতায় অনেক কিছু মুছে গেছে, অনেকের অবদানের কথা হয়তো বলা হয়নি, সকলে ক্ষমা সুন্দর চোখে দেখবেন বলেই আশা রাখছি। সকলকে শুভেচ্ছা।