যুক্তরাজ্যে উচ্চশিক্ষা: বাংলাদেশিদের জন্য সুযোগ সংকুচিত হতে পারে
ইব্রাহীম চৌধুরী
অতিথি লেখক
লন্ডন থেকে ফিরে: সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাজ্যে ব্যাপকভাবে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের গমন ঘটছে। একসময়ে পশ্চিমের দেশগুলোতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের কাজটি কঠিন ছিল। এখনও বিষয়টি সহজ না হলেও লন্ডনে বেশ কিছু শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কৌতূহলের নানা কথা। এসব শিক্ষার্থীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে দালাল চক্র। হাতিয়ে নিচ্ছে বিশাল অংকের অর্থ। উচ্চশিক্ষা গোল্লায় যাচ্ছে অধিকাংশের। এমন অনিয়ম অব্যাহত থাকলে যুক্তরাজ্যে উচ্চশিক্ষার সুযোগ বাংলাদেশিদের জন্য সংকুচিত হয়ে যেতে পারে।
বিভিন্ন শিক্ষার্থীদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, কঠিন সব বাস্তবতার ঘটনা। এক থেকে তিন বছরের জন্য যুক্তরাজ্যের কলেজ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে যাওয়ার জন্য গড়ে ১৫ লাখ টাকা দিতে হয়েছে এসব শিক্ষার্থীকে যুক্তরাজ্যে ভিসা পাওয়ার আগেই। এ ভর্তিবাণিজ্য নিয়ে দেশে এজেন্ট বা দালাল চক্র গড়ে উঠেছে। মেধাবী বা মাঝারী মানের শিক্ষার্থীদের নানা নিয়ম-অনিয়মের মাধ্যমে এসব এজেন্টই যুক্তরাজ্যে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে।
শিক্ষার্থী ভিসায় যারা যুক্তরাজ্যে যাচ্ছে, তাদের স্বামী বা স্ত্রী এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানকেও ভিসা দেয়া হচ্ছে। শিক্ষা ব্যয় ও পরিবার সামলানোর জন্য সীমিত কাজেও অনুমতি দেয়া হচ্ছে শিক্ষার্থীকে। স্পাউস হিসেবে ভিসা পাওয়া ব্যক্তিটির রয়েছে ফুল টাইম কাজের সুযোগ।
মহামারিপরবর্তী বৈশ্বিক বাস্তবতায় যুক্তরাজ্য বা পশ্চিমের দেশগুলোতে এখন কর্মসংস্থান কোনো কঠিন বিষয় নয়। বাংলাদেশ থেকে সদ্য যাওয়া তরুণ-তরুণীরা হিমশিম খেলেও সামাল দিচ্ছে যোগ্যতার সাথে। লন্ডনে বা অন্যান্য নগরকেন্দ্রে আবাসনের সঙ্কটে আছে অনেকেই। কষ্টেশিষ্টে তা সামাল দিলেও অধিকাংশ শিক্ষার্থী উচ্চাশিক্ষার ধারে-কাছেও নেই। সঠিক হিসেব না থাকলেও এমন কয়েকজনের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, মাত্র ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা অব্যাহত রাখছে।
অন্যদের নিয়ে শুরু হয়েছে নানা অনিয়ম। দেশ থেকে শুরু হওয়া অনিয়মের বেড়াজাল থেকে বেরুতে পারছে না এসব শিক্ষার্থী। এমন সব ঘটনার সন্ধান পাওয়া গেছে, যা রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতো। শিক্ষার্থীদের যেহেতু স্পাউজ ভিসা দেয়া হচ্ছে। ফলে ছেলে বা মেয়ের সাথে ভুয়া বিয়ে দেখিয়ে একজনের সাথে অন্যজন আসার ঘটনা ঘটছে। এ ক্ষেত্রে ১৫-২০ লাখ টাকার মধ্যে ভিসা পাওয়া শিক্ষার্থীও পাচ্ছেন এক অংশ। যুক্তরাজ্যে আসার পর কেউ কেউ লিভ টুগেদার করার চেষ্টা করছেন। যেহেতু বিয়ে বা দাম্পত্য এখানে বিষয় নয়। আদম পাচারই মূল লক্ষ্য। এমন অবস্থায় নারী শিক্ষার্থীরা বেশি বিপাকে পড়ছেন। শিকার হচ্ছেন নানা হয়রানি ও নিগ্রহের। নতুন দেশে এসব নিয়ে কোনো কথা বলারও সুযোগ পাচ্ছেন না অনেকেই।
বার্মিংহামে বসবাসরত এক প্রবাসী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বিয়ের নাম করে মধ্যপ্রাচ্যফেরত এক যুবক স্পাউস হিসেবে আসেন একজন নারী শিক্ষার্থীর সাথে। কয়েকদিনের মধ্যেই আশ্রয় দেয়া এক পরিবারে তাঁকে জটিল বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। শিক্ষার্থী মেয়েটিকে ফেলে পালিয়ে গেছেন যুবকটি। দেশ থেকে আত্মীয়স্বজনের বিলাপ-কান্নার জের ধরে মেয়েটিকে এখন দেখভাল করতে হচ্ছে বার্মিংহামের প্রবাসীকে নেহায়েত মানবিক কারণে। লন্ডনসহ অন্যান্য নগরকেন্দ্রে পরিবারের অতিরিক্ত একজন মানুষকে ঘরে আশ্রয় দেয়া সব সময় সহজ নয়, এ ঘটনা দেশ থেকে অনেকেরই অনুমানের বাইরে। পূর্ব লন্ডনের সড়কে সড়কে এমন বহুজনের দেখা পাওয়া গেছে। যারা হন্যে হয়ে ঘুরছেন একটি
আশ্রয়ের জন্য। পড়ছেন নানা বিড়ম্বনায়। উচ্চশিক্ষা বা উন্নত জীবনের আশায় পশ্চিমের দেশে পৌঁছে এদের নীরব কান্নায় বাতাস ভারী হচ্ছে। এসব শিক্ষার্থীকে গোপনে কাজ দিচ্ছেন কোনো কোনো স্বদেশি রেস্তোরাঁ মালিক। যেহেতু নগদে মজুরি পরিশোধ করছেন, ফলে ন্যুনতম মজুরি থেকেও বঞ্চিত করা হচ্ছে। স্বল্প মজুরিতে এমন কর্মী রাখাকে কোনো অন্যায়ও মনে করছেন না লোকজন। বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে জড়িত এক রেস্টুরেন্ট মালিক বলেন, ‘বিপদের সময় খাম দিছি। এর লাগিয়া কৃতজ্ঞ থাকা উছিত। ইতা মাতিয়া লাভ নাই। আউক্কা নমাজ পড়ি লাই!
লন্ডন দেখা গেল, হোমকেয়ার ব্যবসা এখন বেশ জমজমাট। বয়স্কজন বা অসুস্থজনকে ঘরে বসে সেবা দেয়ার এ কাজে এখন জড়িত বেশ কিছু বাংলাদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানও। কর্মিসংকটের এ সময় এসব হোমকেয়ার খাতে বেশ কিছু শিক্ষার্থী কাজ করছেন। শুনে এ নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেও পরে জানা গেল আরেক ভয়াবহ সংবাদ। হোমকেয়ারে বা অন্যত্র স্থায়ী চাকরি করার মধ্য দিয়ে ছাত্র ভিসা বদল করে দেয়া যায়। অভিবাসন আইনের যথযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই এমন করা সম্ভব। এখন এ কাজে উকিল, সলিসিটার, হোমকেয়ার মালিক, স্বদেশি দালাল মিলে গড়ে উঠেছে আরেক চক্র। তারা ১৮ হাজার পাউন্ডের মাধ্যমে চুক্তি করছে সদ্য দেশ থেকে ছাত্র ভিসায় আসা লোকজনের সাথে। ১৫/২০ লাখ টাকার এ অর্থের যোগানও দিতে হচ্ছে দেশের পরিবারকে জমিজমা বিক্রি করে। কেউ এখানে কাজ করে অর্থ পরিশোধের চেষ্টা করছে। ফলে উচ্চশিক্ষা বলে কিছু হচ্ছে না। জীবন জড়িয়ে পড়ছে শ্রম দাসত্বে।
হোমকেয়ার ব্যবসার সাথে জড়িত একজনকে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে জানালেন, ‘এ তো খারাপ কিছু নয়। লিগ্যাল হলে তার মা, বাবা, বৌ, চৌদ্দগুস্টির বিলেত আসার পথ খুলে যাবে। ২০ লাখ টাকা কোনো ব্যাপারই নয়।’ এমন মন্তব্য করে হোমকেয়ার ব্যবসার মালিকটি সদ্য ওমরাহ হজ থেকে নিয়ে আসা ‘জমজমের পানি’ পান করতে দিলেন এ প্রতিবেদককে। মন্তব্য করলেন— ‘অন্য কিছু নিয়ে লেখালেখি করেন, এ ইহুদি-নাসারার দেশে কত গুনাহর কাজে জড়িয়ে পড়ছে আমাদের সন্তানরা। এসব বিষয়ে লেখেন।
এর মধ্যে বিয়ের ঘটনাও ঘটছে। অনেকেই ‘লন্ডনী কন্যা’ বিয়ে করে ছাত্র ভিসাকে পরিবর্তন করতে চেষ্টা করছে। এ খাতটিও ব্যয়বহুল। ছাত্র ভিসায় লন্ডন পৌঁছানো মাহদি নামের একজন জানান, সিলেট অঞ্চল থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের কিছু অংশ এ সুযোগ পাচ্ছেন। সিলেট অঞ্চল থেকে আসা যুক্তরাজ্যে বসবাসরত পরিবারগুলো অন্য জেলার ছেলেমেয়েদের সাথে বিয়ের সম্পর্ক করতে অনিচ্ছুক থাকে। তাদের জন্য এ দরজা প্রায় বন্ধ। সিলেট অঞ্চলের যেসব যুবক এমন বিয়ের ফাঁদে পা দিচ্ছেন। মোহরানার নামে বড় অংকের নগদ অর্থ দিতে হচ্ছে কন্যার পরিবারকে। ব্রিটেনে জন্ম ও বড় হওয়া এমন মেয়ের সাথে শুধু অভিবাসনের জন্য বিয়ের শুরুতেই শুরু হচ্ছে নানা ঝুটঝামেলা। এসব আরোপিত দাম্পত্যের পরিণতিতে সৃষ্টি হচ্ছে নানা সামাজিক সমস্যা।
সবমিলে ঠিক কত শিক্ষার্থীর বাংলাদেশ থেকে গত এক বছরে ভিসা হয়েছে এবং কতজনের সাথে স্পাউস হিসেবে অন্যদের আগমন ঘটেছে তার কোনো সঠিক হিসেব গ্রহণ সম্ভব হয়নি। হাজার হাজার এমন শিক্ষার্থীর মধ্যে খুবই অল্প সংখ্যক উচ্চশিক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিষয়টি নিয়ে অন্য বিষয়গুলোও এখন ব্রিটিশ সরকারের নজরে আসছে। উচ্চশিক্ষার নামে যুক্তরাজ্যের ভিসাপ্রাপ্তিতে ব্রিটেনের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এ নিয়ে এখন নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে। এ নিয়ে ভিসাপ্রাপ্তিতে অতিরিক্ত স্কুটিনি আরোপিত হতে যাচ্ছে বলে বিষয়টি নিয়ে কাজ করেন এমন একজন জানালেন।