রাউজানে বিস্মিত ও অভিভূত নেতৃবৃন্দ: একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রত্যাশা ইবিএফ প্রতিনিধিদলের

ঢাকা করেসপন্ডেন্ট
সত্যবাণী

ঢাকা: নেদারল্যান্ডের সাবেক সংসদ সদস্য ও মানবাধিকার কর্মী হ্যারি ফান বোমেল এর নেতৃত্বে আমস্টারডাম ইউনিভার্সিটির জেনোসাইড স্টাডিজ-এর অধ্যাপক জেনোসাইড বিশেষজ্ঞ ড. অ্যান্থনী হোল স্লাগ, ফ্রেন্ড অব বাংলাদেশ অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত যুক্তরাজ্যের সিনিয়র সাংবাদিক কমিউনিক্যাশন স্পেশালিস্ট ক্রিস ব্ল্যাক বার্ন, ইবিএফ হল্যান্ড সভাপতি বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া, ইউরোপীয়ান সভাপতি আনসার আহমদ উল্যাহ এবং প্রতিনিধি দলের চট্টগ্রামের সমন্বয়ক শহীদ সন্তান ও কলামিস্ট প্রকৌশলী প্রদীপ কুমার দত্ত, মহামান্য রাষ্ট্রপতি মরহুম মো. জিল্লুর রহমানের সাবেক পলিটিক্যাল এপিএস লেখক-সাংবাদিক শওকত বাঙালি গত ২৫ মে বিকেলে রাউজানের জগৎমল্লপাড়া ও ঊনসত্তরপাড়ার বধ্যভূমি পরিদর্শন করেন এবং শহীদ স্বজনদের সাথে কথা বলেন। এ সময় শহীদ পরিবারের সদস্যরা তাঁদের পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন এবং সেই বিভীষিকাময় সময়ের স্মৃতিচারণ করেন।

প্রতিনিধিদলকে শহীদ পরিবারের সদস্যরা বিনম্র কৃতজ্ঞতা জানান এবং বাংলাদেশ জেনোসাইডের পক্ষে কাজ করায় অভিনন্দন জানান। প্রতিনিধিদলের নেতৃবৃন্দ রাউজানের শহীদ স্বজনদের সাথে কথা বলে সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং খুব সহসা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ ফোরাম, আমরা একাত্তর ও প্রজন্ম’ ৭১-এর উদ্যোগে এবং একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, ভাষাসৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এ.কে ফজলুল হক গণপাঠাগার, আমরা করবো জয়সহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সহযোগিতায় রাউজানে প্রতিনিধিদলকে স্বাগত জানান রাউজান পৌর মেয়র জননেতা জমির উদ্দিন পারভেজ। জগৎমল্লপাড়ায় অন্যদের মধ্য উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় পৌর কমিশনার শওকত হাসান, প্রফেসর নিরদ কুল, ডা. মুকুল কান্তি রায়, প্রদীপ দে, ডিপলু দে, মুক্তিযোদ্ধা অজিত বাবু, মুক্তিযোদ্ধা বাদল পালিত, বিপ্লব মহাজন, দিলীপ সেন, মোহাম্মদ আসিফ, সুজন চৌধুরী, মিজানুর রহমান, আশরাফুল ইসলাম আবীর এবং ঐদিন সন্ধ্যায় ঊনসত্তরপাড়ায় প্রতিনিধি দলকে স্বাগত জানান স্থানীয় পাহাড়তলী ইউপি চেয়ারম্যান মো. রোকন উদ্দিন। এছাড়া, শহীদ স্বজনদের মধ্যে উপস্থিতি ছিলেন অজিত মহাজন, স্বপন দাশ, স্বপন ঘোষ, তিলক ঘোষ, উমাপতি পাল, সঞ্জয় পাল, মিঠুন পাল প্রমুখ।
২৫ মার্চ পাকিস্তানিরা নিরীহ বাঙালিদের উপর যে নৃশংস ও বর্বরোচিত গণহত্যা চালিয়েছিল তা নিয়ে জাতিসংঘের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করছেন উল্লেখ করে সাবেক ডাচ এমপি হ্যারি ফান বোমেল সফর অনুষ্ঠানে বলেন, আর্মেনিয়ার জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ে প্রায় ১০০ বছর লাগলেও বাংলাদেশের এ স্বীকৃতি অর্জনে এতটা সময় প্রয়োজন নেই। অপারেশন সার্চ লাইট দিয়েই একাত্তরের জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ে আন্তর্জাতিক অ্যাডভোকেসি ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। শুধু নেদারল্যান্ডস নয়, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যেও এ প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, এদিন কেবল একরাতেই ঢাকায় ১০ লাখ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে একই সময়ে এতবড় হত্যাকান্ডের আর কোন নজির নেই। এই হত্যাকান্ডের ৫০ বছর পরও ‘বাংলাদেশ গণহত্যা ১৯৭১’ আর্ন্তজাতিকভাবে স্বীকৃত না হওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত বেদনাদায়ক। বিশ্বের কোথাও যাতে আর জেনোসাইড সংঘটিত হতে না পারে সেজন্য বিশ্ব জনমত গঠনের উপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের বিরোধিতা করায় একাত্তরে জেনোসাইডের স্বীকৃতি পেতে দেরি হচ্ছে উল্লেখ করে আমস্টারডাম ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. অ্যান্থনী হোল স্ল্যাগ বলেন, তবে এখন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা বাংলাদেশে সংঘটিত জেনোসাইডকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। খুব শিগগিরই জাতিসংঘ থেকেও এ স্বীকৃতি আদায় সম্ভব হবে। এই জেনোসাইডকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারকে চাপ প্রয়োগ করতে হবে। আর ঠিক সেই কারণে এই বিষয়ে বৈজ্ঞানিক আলোচনা প্রয়োজন। ভুক্তভোগী এবং তাদের পরিবারের জন্য গণহত্যার স্বীকৃতি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ১৯৭১ সালে গণহত্যার শিকার ব্যক্তিদের পরিবার, সাক্ষী, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছি। এছাড়া বিভিন্ন গণহত্যার স্থান পরিদর্শন শেষে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে নেদারল্যান্ডসে গিয়ে এই গণহত্যার স্বীকৃতির জন্য আবেদন করব, প্রচারও চালাব। এছাড়া গণহত্যার সাক্ষীদের ডাচ পার্লামেন্টে নিয়ে গিয়ে তাদের বক্তব্য তুলে ধরবো।

সুইস ইন্টারস্ট্র্যাটেজি গ্রুপের কমিউনিকেশন ডিরেক্টর ক্রিস ব্ল্যাকবার্ন বলেন, আমাদের লক্ষ্য হলো, ১৯৭১ সালে এদেশে কী হয়েছিল সেটা জেনে বিশ্বের কাছে তা তুলে ধরা। একইসঙ্গে এই জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি কেন প্রয়োজন, সে ব্যাপারেও আন্তর্জাতিক মহলকে অবহিত করা।

মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সন্তান প্রকৌশলী প্রদীপ কুমার দত্ত বলেন, বাঙালির মুক্তির আন্দোলনের শ্বাসরোধ করতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এ দেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের সেই অভিযানে কালোরাতের প্রথম প্রহরে ঢাকায় চালানো হয় গণহত্যা। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান; শুরু হয় বাঙালির প্রতিরোধ পর্ব। নয় মাসের যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান, আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং জাতির অসাধারণ ত্যাগের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সেই বর্বর হত্যাযজ্ঞে নিহতদের স্মরণে ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের প্রস্তাব ২০১৭ সালে জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়। তখন থেকেই এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব লেখক-সাংবাদিক শওকত বাঙালি বলেন, ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণার দাবিতে বিশ্বব্যাপী জাগরণ তৈরির লক্ষ্যে কাজ করছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। তারই ধারাবাহিকতায় আংশিক বিজয় এসেছে। সম্প্রতি নির্মূল কমিটি নিউইয়র্ক শাখার সভাপতি তৌহিদ রেজা নূর-এর প্রস্তাবিত রেজুলিউশন অব বাংলাদেশ জেনোসাইড (আইএজিএস) বিশ্বব্যাপী জেনোসাইড স্কলার্সদের মঞ্চ ইন্টারন্যাশনাল এসোসিয়েশ অব জেনোসাইড স্কলার্স সদস্যদের আনুষ্ঠানিক ভোটাভোটির পর পাশ হয়েছে। শীঘ্রই তারা আনুষ্ঠানিকভাবে রেজুলিউশনটি পাবলিশ করবে। আইএজিএস-এর এই স্বীকৃতি বাংলাদেশে সংঘটিত জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের ব্যাপারে একটি বড় অর্জন।
একাত্তরে বাংলাদেশিদের ওপরে পাকিস্তানিদের নির্মম হত্যাযজ্ঞকে ইতিমধ্যে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান লেমকিন ইনস্টিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন, আন্তর্জাতিক সংস্থা জেনোসাইড ওয়াচ এবং গণহত্যা বিশেষজ্ঞদের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলার্স (আইএজিএস)।

এদিকে, ইবিএফ প্রতিনিধিদলকে ২৪ মে, রাত ৮টায় চট্টগ্রামের পাহাড়তলী বধ্যভূমিতে স্বাগত জানান শহীদ সন্তান কলামিস্ট প্রকৌশলী প্রদীপ কুমার দত্ত ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব লেখক-সাংবাদিক শওকত বাঙালি। এসময় পাহাড়তলি বধ্যভূমি প্রকল্প বাস্তবায়ন পরিষদের আহ্বায়ক চবির নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক মোস্তফা কামাল যাত্রা, চসিকের সাবেক কাউন্সিলর আবিদা আজাদ, পবপ্রবপ-এর সদস্য সচিব সাহাবুদ্দিন আঙুর, সাংবাদিক বশির আহাম্মদ রুবেল, শহীদ পরিবারের সন্তান গাজী কামাল উদ্দিন কামরুল ও মুক্তিযোদ্ধা রউফুল হোসেন সুজা, জসিম উদ্দিন আহমেদ, সেলিম বাদশা, আবু সুফিয়ান, মোতাহার হোসেন স্বপন, রবিউল ইসলাম, আব্দুল করিম, মোঃ রনি, মোঃ সোহেল, মোহাম্মদ সাব্বির, মোহাম্মদ আবির প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। পরদিন ২৫ মে, চট্টগ্রাম সিনিয়রস ক্লাবের আয়োজনে সিম্পোজিয়ামে প্রতিনিধিদল অংশগ্রহণ করেন। ২৬ মে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের আয়োজনে মতবিনিময় সভায় অংশগ্রহণ করেন এবং বিকেলে চট্টগ্রাম ত্যাগ করেন।

You might also like