রাজধানী ছাড়ছে নিম্ন-মধ্যবিত্ত ভাড়াটিয়া সংকটে বাসায় বাসায় ‘টু লেট’
নিউজ ডেস্ক
সত্যবাণী
ঢাকাঃ কয়েকমাস আগেও রাজধানীতে পছন্দসই বাড়ি ভাড়া পেতে ঘাম ঝাড়তে হয়েছে,করোনা মহামারিতে পাল্টে গেছে সেই চিত্র।ঢাকার অলি গলিতে একের পর বাড়িতে ‘টু-লেট’লেখা সাইনবোর্ড ঝুললেও মিলছে না ভাড়াটিয়া।এতে বাড়ি ভাড়ার ওপর নির্ভরশীল মালিকরা পড়েছেন ভীষণ বেকায়দায়।ভাড়াটিয়ার অভাবে কারও কারও দুই মাস ধরে রুম- ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট খালি পড়ে আছে।একে তো ভাড়ার টাকা পাচ্ছেন না,তারপরে ওই সব ফ্ল্যাটের গ্যাস-পানি-বিদ্যুতের বিল পকেট থেকে দিতে হচ্ছে।
করোনাকালে কাজ হারানো রাজধানীর লাখো মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছেন।গত তিন মাসে অর্থনৈতিক শ্রেণি কাঠামোতেও বদল এসেছে।এ সময়ে নিম্ন-মধ্যবিত্ত নেমেছে নিম্নবিত্তে আর নিম্নবিত্ত আরও দরিদ্র হয়ে পড়েছে।এদের বেশিরভাগই খেয়ে-পরে কোনোরকম টিকে থাকলেও বাড়িভাড়া নিয়ে বড় চাপে পড়েছেন।পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে অনেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে গ্রামে চলে যাচ্ছেন।কেউ কেউ পরিবার গ্রামে পাঠিয়ে মেসে উঠছেন।এ অবস্থায় ঢাকার বাড়ির মালিকরা ভাড়াটিয়া সংকটে পড়েছেন।অধিকাংশ বাসার সামনে বাড়িভাড়ার সাইনবোর্ড় ঝুলছে। কিন্ত ভাড়াটিয়া মিলছে না,এমন কি খোঁজ নিতেও আসছে না কেউ।
বাড়িওয়ালাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, করোনা সংকটে গত ২৬ মার্চ দেশে সাধারণ ছুটি শুরু হলে শিক্ষার্থী ও কর্মজীবী অনেকে গ্রামের বাড়ি চলে যান। সাধারণ ছুটি শেষে তাদের অনেকে ফিরলেও কর্মহীন পরিস্থিতি নিজেদের অসহায়ত্ব তুলে ধরে কিছু ছাড় চেয়ে ভাড়া পরিশোধ করছেন এবং বাসা ছেড়ে দিচ্ছেন। আবার যারা এতদিন পরিবার-পরিজন নিয়ে ঢাকায় ছিলেন তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় তারা বাসা ছেড়ে গ্রামমুখী হচ্ছেন। এতে বিপাকে পড়েছেন রাজধানীর বিপত্তিতে পড়েছেন বেশিরভাগ বাড়িওয়ালা।
রাজধানীর শাহজাদপুর এলাকার এক বাড়িওয়ালা বলেন, আমার পাঁচতলা বাড়ির দুটি ফ্ল্যাট গত দুই মাস ধরে ফাঁকা। আগে ‘টু -লেট’ ঝুলানোর তিন-চার দিনের মধ্যেই বাসা ভাড়া হয়ে যেত। কিন্তু এখন ভাড়াটিয়া পাওয়া যাচ্ছে না। আশপাশে আরও অনেকে বাড়িতেই এখন ‘টু-লেট’ ঝুলছে। কিন্তু কেউ ভাড়াটিয়া পাচ্ছেন না। অনেকেই গ্রামে চলে গেছেন। অনেকে পরিবারকে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে কোনো মেসে উঠেছেন। এরমধ্যে জীবিকার তাগিদে ঢাকায় নতুন মানুষও আসেননি। যে কারণে বাসাগুলো ফাঁকা রয়ে গেছে। বেতন না পাওয়া, কাজ না থাকা বা চাকরি হারানোই বড় কারণ।
ঢাকার মহাখালিতে দুই রুমের একটি ফ্লাট ভাড়া করে থাকতেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত আজাদ রহমান। বাড়িওয়ালোকে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, আগামী মাসে বাসা ছেড়ে দেবেন।বাসা ছেড়ে দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, সীমিত বেতনে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। বেতনের অর্ধেকই চলে যায় বাসা ভাড়ায়। তবু স্ত্রী আর এক সন্তান নিয়ে ভাড়া ফ্ল্যাট থাকতাম। কিন্তু কোম্পানি কাজকর্ম কমে যাওয়ায় গত দুই মাস ধরে অর্ধেক বেতন দিচ্ছে। এ অবস্থা বাসা ভাড়া দিয়ে সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তাই বাসা ছেড়ে দিয়ে স্ত্রী-সন্তানকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি, আপাতত আমি কমভাড়ার একটা গিয়ে মেসে উঠবো।
ঢাকার বস্তিগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, টানা তিন মাস কাজকর্ম না থাকায় নিম্ন আয়ের মানুষের অবস্থা এখন শোচনীয় । প্রথমদিকে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে ত্রাণ দেওয়া হলেও সেই কর্মসূচি এখন নেই বললেই চলে। এতে পেট চালানো কঠিন হয়েছে বেশিরভাগ পরিবারের। এ পরিস্থিতিতে ঘর ভাড়া ও ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা নিয়ে আরও বিপদে পড়েছেন নিম্নবিত্ত মানুষ। ঘর ভাড়া ও কিস্তি থেকে বাঁচতে অনেকে রাতের আঁধারে ঢাকা ছেড়ে পালাচ্ছেন বলেও খবর পাওয়া গেছে।
দেড় হাজার বর্গকিলোমিটারের এ নগরীর বাসিন্দার সংখ্যা দাঁড়িয়ে যায় প্রায় দুই কোটি, যাদের প্রায় ৮০ শতাংশই ভাড়া বাসার বাসিন্দা। এ ভাড়াটিয়ারা বছরের পর বছর বাসার উচ্চ ভাড়া দিয়ে আসছেন। কিন্তু করোনাভাইরাস পরবর্তী পরিস্থিতি বদলে দিয়েছে বাসা ভাড়ার চিত্রও।ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এক হিসাবে দেখা যায়, গত ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়িভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪০০ শতাংশ। একই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। অর্থাৎ এ সময়ে নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় বাড়িভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ। সংগঠনটির অন্য এক হিসাব বলছে, ঢাকার ২৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ, ৫৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া প্রায় ৫০ শতাংশ, ১২ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ টাকা ব্যয় করেন বাসা ভাড়ায়।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের তথ্য বলছে, ২০০৭ সালের পর খরা, ঘূর্ণিঝড়সহ নানা কারণে দেশের ভেতর উদ্বাস্তু হয়েছে প্রায় ৫৭ লাখ মানুষ। এসব মানুষের অধিকাংশই কর্মের সন্ধানে ঢাকায় প্রবেশ করে। যারা রাজধানীর বস্তিগুলোতে বাস করে আসছিল। তবে করোনার ধাক্কায় এসব মানুষের জীবনে বড় বিপর্যয় নেমে এসেছে।করোনাভাইরাস বিশ্বে মহামারী রূপে ছড়ানোর প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক শ্রম সস্থা (আইএলও) গত এপ্রিলে একটি প্রতিবেদন দেয়। ওই প্রতিবেদনে সংস্থাটি উল্লেখ করেছে, করোনার কারণে চলতি বছর বিশ্বের ১৯ কোটি মানুষ পূর্ণকালীন চাকরি হারাবে। এর মধ্যে ১২ কোটিই এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের।ঢাকাভিত্তিক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) হিসাব অনুযায়ী, করোনার কারণে গত তিনমাসে দেশের অন্তত দেড় কোটি মানুষ স্থায়ী কাজ হারিয়েছে।