রানি’র কফিনমুখি ভালোবাসার স্রোতে
সৈয়দা ফেরদৌসি পাশা কলি
দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে যেকোন জনপ্রিয় শাসকেরই জনসমর্থনে ভাটা পরে, সচরাচর যেখানে এমনটিই দেখা যায়, সেখানে মৃত্যুর পর রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ তাঁর ব্যতিক্রমী ইমেজই যেন জানান দিলেন। ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘকালীন সময় একটানা ৭০ বছর ক্ষমতায় থাকার পর, শুধু ক্ষমতা থেকে নয় এই পৃথিবী থেকেই যখন বিদায় নিলেন, তখন ইতিহাসকেই যেন তিনি আরেক নতুন অধ্যায় দান করে গেলেন। শাসক আর শাসিত’র মধ্যে যেখানে দুরত্ব থাকে যোজনসম, সেখানে সমাহিত হওয়ার আগেই তাঁর কফিন ঘীরে মানুষের সুনামিতুল্য শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় বিশ্ব ইতিহাসের জন্য রচিত হলো এক বিরল অধ্যায়। এই অধ্যায় একজন শাসকের জন্য শাসিতের শ্রদ্ধা ও ভালেবাসার অধ্যায়, এই অধ্যায় মানুষের হৃদয়ে একজন দীর্ঘকালীন শাসকের ছবি খোদাই হয়ে থাকার অধ্যায়।
ব্রিটেনের রাজ পরিবারের ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রতি আমার আগ্রহ সেই ছোটবেলা থেকেই। স্কুল শিক্ষিকা মায়ের কাছে কত যে গল্প শুনেছি ব্রিটিশ রাজ পরিবার নিয়ে। এসব গল্পে যেমন ছিলো পলাশীর আম্রকাননে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে নবাব সিরাজদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে ব্রিটিশের ভারত দখল, নীলকরদের অত্যাচার, জালিওয়ানবাগ হত্যাকাণ্ড, বিপ্লবীদের ফাঁসিতে ঝুলানোর কথা, ঠিক তেমনি ছিলো ১৯৬১ সালে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ঢাকা সফরের সময় গাছের মগডালে উঠে আমার নানার রানি দর্শনের মত গল্পগুলো।
এমনসব গল্প শুনে শুনেই আমার বেড়ে ওঠা। আর একারনেই সেই ছোটবেলা থেকেই ব্রিটিশ রাজ পরিবারের বিভিন্ন উৎসব-শোক অনুষ্ঠান উপভোগ করা বা শোক প্রকাশ অনেকটা নেশার মতোই ছিলো আমার। এটি প্রিন্স এন্ড্রু, প্রিন্স উইলিয়াম বা প্রিন্স হ্যারির বিয়েই হোক, সেই ছোটবেলায় বাংলাদেশে বসে টেলিভিশনের বদৌলতে বর্তমান রাজা চার্লস ও প্রিন্সেস ডায়নার বিয়েই হোক বা ডায়নার সেই অস্বাভাবিক মৃত্যু পরবর্তী ঘটনার পর বাকিংহাম প্যালেসের সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে থাকাই হোক। ঐসময়গুলোতে বারবার ছুটে গিয়েছি বাকিংহাম প্যালেসসহ সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে।
এবার রানির মৃত্যুর পরও তাঁর মরদেহ সামনে নিয়ে আনুষ্ঠানিক শোক জানাবো এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু মৃত্যুর পর থেকেই রানিময় হয়ে ওঠা ব্রিটিশ মিডিয়াগুলোর বদৌলতে যখন জানতে পারি, জীবিত রানির চেয়েও মৃত রানি আরও অধিক জনপ্রিয়, যখন জানলাম রানির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সারা বিশ্ব থেকেই ছোটে আসছেন মানুষ, তখন আদৌ রানির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারবো কি না তা নিয়ে নিজেই সন্দিহান হয়ে উঠেছিলাম তা স্বীকার করতে মোটেই দ্বিধা নেই আমার। তবে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম শ্রদ্ধা জানাতেই হবে মহামান্য রানিকে। রানির প্রতি মানুষের ভালোবাসার লাইন যতই দীর্ঘ হোক এই লাইনে অবশ্যই নিজেকে সম্পৃক্ত করবো।
যেই ভাবা, সেই কাজ। শুক্রবার অফিস শেষ করে বের হলাম রানির কফিনমুখি লাইনে দাঁড়াতে। বোন বিলকিস ও ভাবী লুসিকে আগেই বলা ছিলো হোয়াইটচ্যাপেল স্টেশনে মিলিত হবো আমরা, এরপর রওয়ানা দেবো ওয়েষ্ট মিনিষ্টার হলের কফিনমুখি লাইনের উদ্দেশ্যে। নির্ধারিত সময় বিকেল ৫.৪৫ মিনিটে হোয়াইটচ্যাপেল থেকে রওয়ানা হয়ে সাউথওয়াক স্টেশনে নেমে আমরা ওয়েষ্ট মিনিষ্টার হলমুখি লাইনে দাঁড়ালাম। সাথে আমার ভাইঝি রাফা। আমরা তিন পৌঢ় মহিলাকে দেখে রাখতে সেও সঙ্গী হয়েছে আমাদের।
দীর্ঘ লাইন। ভালোবাসায় মোড়ানো হৃদয়ের অধিকারী দুনিয়ার তাবৎ মানবিক মানুষগুলো যেন দীর্ঘ এক লাইনে এসে দাড়িয়েছেন একজন মানুষের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা জানাতে, বিশ্বময় নতুন করে মানবিকতার উন্মেষ ঘটাতে। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। দীর্ঘ চারঘন্টা লঘুপায়ে হাঁটার পর পেলাম হ্যান্ড রিষ্ট ব্যান্ড। জানলাম কফিনমুখি এই লাইনে আরো আট থেকে সাড়ে আট ঘন্টা আমাদের দাঁড়াতে হবে।
বিভিন্ন বর্ণের মানুষের এই দীর্ঘ মিলন লাইন দেখে মনে হলো কে বলেছে আগের সেই মানবিক সমাজ নেই। ঔপেনিবেশিক শোষণ নির্যাতনের অতীত ইতিহাস মনে রেখেও ভিন্ন বর্ণের হাজারো মানুষকে যখন দেখি ঔপেনিবেশিক শাসনের উত্তরসূরি রানি এলিজাবেথের কফিনমুখি লাইনে, তখন মনে হয়, আসলে মানবিকতাই সবকিছুর উর্ধে। ইতিহাস মনে রেখেও একটি মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় মানুষ যে ভূমিকা রাখতে চায়, আজকের এই ভালোবাসাময় লাইন তারই প্রমান।
ব্রিটেনের মত একটি কল্যান রাষ্ট্রের সুযোগ সুবিধা পাওয়ার লোভে নিজ দেশ ও দেশের সরকারের উপর মিথ্যে অভিযোগ দিয়েও যারা ব্রিটেনে ঢুকা বা স্থায়ী হওয়ার চেষ্টা করেন, রানির এদেশে স্থায়ী হওয়ার পর নিজ ধর্মের দোহাই দিয়ে সেই তাঁরাই যখন ব্রিটিশ জাতির চৌদ্দ গোষ্ঠি উদ্ধার করে পরকালের স্বর্গের সার্টিফিকেট যোগার করতে চান আজকের এই ভালোবাসার দীর্ঘ লাইন থেকে তারা কি শিক্ষা নেবেন আমি জানিনা। তবে কৃতজ্ঞ মানুষের আজকের এই লাইনে মিশে যাওয়ার সুযোগ অবশ্যই আমার জন্য এক বিরাট অভিজ্ঞতা।
দীর্ঘ এই লাইনে যেমন ছিলো সমাজের অনেক সিনিয়র সিটিজেনের উপস্থিতি, ঠিক তেমনি ছিলো বটবৃক্ষ হারানোর শোকে শোকাতুর চেহারাধারী অথচ রানিকে শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ পাওয়ায় উচ্চশিত তরুণ তরুণী। লোকজন লঘু পায়ে হাঁটার ফাঁকে ফাঁকে লাইনের পাশে বসে যেমন নিচ্ছিলেন বিশ্রাম, ঠিক তেমনি তারুণ্যের শক্তিতে বলিয়ান অনেকেই লাইনে দাড়িয়েই চা-কফি পান করার মাধ্যমে ফুয়েল নিচ্ছিলেন তাদের দেহ শক্তি ধরে রাখতে। ইষ্টহ্যান্ডস সহ বিভিন্ন চ্যারিটি সংগঠনের কর্মীরা এসময় ভালোবাসা লাইনে দীর্ঘ অপেক্ষমাণ এই মানুষগুলোকে চা-কপি অফার করে নিজেদেরও সম্পৃক্ত করছিলেন স্মরণকালের এই দীর্ঘ শোক রেলিতে। টাওয়ার ব্রিজসহ লন্ডনের আইকন স্থাপনাগুলো তখন ঐ দুরে দাড়িয়ে যেন লাইনে দাঁড়ানো সমবেত মানবিক মানুষগুলোর প্রতি তাদের শ্রদ্ধা জানাচ্ছিলো নিজেদের শরীরের আলো ঝলকানি দিয়ে।
দীর্ঘ সাড়ে ১২ ঘন্টা লঘু পায়ে হেটে, দাড়িয়ে ও বিশ্রাম নিয়ে আমরা পৌঁছলাম ওয়েষ্ট মিনিষ্টার হলে রানির কফিনের কাছে। শ্রদ্ধা জানালাম বিশ্বের দীর্ঘকালীন সময় ক্ষমতায় থাকা ব্রিটেনসহ ১৪টি দেশের রাষ্ট্র প্রধানের প্রতি। দুঃখ হলো পূর্ব প্রজন্মের ঔপেনিবেশিক শাসনের নেতিবাচক ঘটনাগুলোর সাথে নিজে সম্পৃক্ত না থেকেও এর দায় তাঁর উপরও এসে পড়ায়। মনে মনে বললাম দুঃখ করোনা প্রিয় রানি, ইতিহাসের দায় নিতেই হয়। এরপরও তুমি ভাগ্যবান, আজ বিদায় বেলায় লাখো মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত তুমি। একজন মানবিক মানুষ হিসেবে আজীবন তুমি থাকবে মানুষের হৃদয়ে, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা কোন শাসকেরই হয়তো অতীতে এমন ভাগ্য হয়নি। শান্তিতে ঘুমাও মহিমান্বিত রানি। ইতিহাস তুমায় বুকে আগলে রাখবে।
রানিকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে শনিবার সকাল ৮টায় অবশেষে নিজের বিছানায় এসে ঝাপিয়ে পড়লাম ঘুম ডুলু ডুলু চোখে।
সৈয়দা ফেরদৌসি পাশা কলি: ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, সত্যবাণী।