লিভার সম্মেলন: শ্রেষ্ঠতম বাঙালির প্রতি অতল শ্রদ্ধা
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)
ন্যাসভ্যাক এখন আশা জাগাচ্ছে কোভিডেও। কিউবায় এরই মধ্যে সাফল্যের সঙ্গে ওষুধটি প্রয়োগ করা হয়েছে কোভিড চিকিৎসায়। নামকরা একটি আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক জার্নালে এ নিয়ে প্রকাশনা আসতে যাচ্ছে অচিরেই। পরিকল্পনা চলছে বড় মাপের আন্তর্জাতিক ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের। বাঙালির সাধ্য হতে পারে সীমিত, সামর্থ্য নয়। কোভিডে ন্যাসভ্যাক নিয়ে নানান আলোচনায় সরগরম এবারের ভার্চ্যুয়াল পদ্মা-গঙ্গা-গোমতী
মেডিকেল পেশার সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত, মেডিকেল কনফারেন্স তাদের জন্য পার্ট অ্যান্ড পার্সেল। নিজেদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি আর পাশাপাশি দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে নিজেদের আরো সমৃদ্ধ করার সুযোগ করে দেয় এই কনফারেন্সগুলো। কিন্তু আজকে এমন একটি কনফারেন্স নিয়ে লিখতে বসা, যা একেবারেই ভিন্ন আঙ্গিকের। বিশেষজ্ঞদের এই কনফারেন্সটির গণ্ডি শুধু লিভারের মুনশিয়ানায় সীমাবদ্ধ না, বরং তার ব্যাপ্তি আরো অনেক বেশি, বিশাল। আর সে কারণেই লিভার বিশেষজ্ঞদের ব্যতিক্রমী এই কনফারেন্সটি নিয়ে লিখতে বসা।
বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরা- বাংলা ভাষাভাষী বাঙালি-অধ্যুষিত এই তিনটি প্রধান অঞ্চল একসময় অবিভক্ত ভারতবর্ষের অংশ হলেও আজকের বাস্তবতায় এদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র আর অন্য দুটি স্বাধীন ভারতের স্বতন্ত্র দুটি প্রদেশ। রাজনৈতিক মানচিত্রে বিভাজিত বাঙালি জাতি বিভাজিত হয়নি অন্য কোনোভাবেই- একের বিপর্যয়ে তাই অপরের রক্তক্ষরণ। একাত্তরে নয়টি মাসে বাংলাদেশের এক কোটি শরণার্থীর নির্ভরতার আশ্রয়স্থল ছিল পশ্চিমবঙ্গ আর ত্রিপুরা। ত্রিপুরার স্থানীয় বাঙালির সংখ্যাকে ছাপিয়ে প্রদেশটিকে আপন করে নিয়েছিল বাংলাদেশের বহু লাখ বাঙালি। আর রাজনৈতিক বিভাজনকে ছাপিয়ে এই তিন ভূখণ্ডের তো বটেই, পৃথিবীর তাবৎ বাংলা ভাষাভাষী মানুষেরও অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর স্বল্পদৈর্ঘ্য জীবনের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে তিনি শুধু বাঙালিরই নন, বরং হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বের সব নিপীড়িত মানুষের নেতা। বিশ্বসভায় তাঁর পক্ষেই বড় গলায় বলা মানায়, দ্বিধাবিভক্ত পৃথিবীতে তার আনুগত্য শোষক নয়, শোষিতের পক্ষে। কিন্তু এর চেয়েও তাঁর যা বড় অর্জন, তিনি বাঙালির একটি জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি এমনকি এই রাষ্ট্রটির নাম আর জাতীয় সংগীতটিও ঠিক করে দিয়েছিলেন আর সর্বোপরি চব্বিশ বছরের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম আর অতঃপর নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এ দেশটিকে তিনি স্বাধীনও করেছিলেন। তিনি বাঙালি জাতির ‘জাতির পিতা’- হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। সে কারণেই তিনি রাজনৈতিক সীমানার ঊর্ধ্বে দাঁড়িয়ে সব বাঙালির প্রাণপুরুষ।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী সামনে রেখে গত বছর বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ আর ত্রিপুরার ভ্রাতৃপ্রতিম লিভার বিশেষজ্ঞদের তিনটি ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ফোরাম ফর দ্য স্টাডি অব দ্য লিভার বাংলাদেশ, ওয়েস্ট বেঙ্গল লিভার ফাউন্ডেশন ও হেপাটাইটিস ফাউন্ডেশন ত্রিপুরার উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানানোর তাগিদ থেকে আয়োজন করা হয়েছিল প্রথম পদ্মা-গঙ্গা-গোমতী লিভার সম্মেলন। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ আর ত্রিপুরার তিন প্রধান নদী পদ্মা, গঙ্গা আর গোমতীতে প্রবাহিত সব জল গিয়ে একাকার হয় বঙ্গপোসাগরে, ঠিক যেমন বাঙালির বাঙালিত্বের মোহনায় দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই এই সম্মেলনটির এমন নামকরণ। সম্মেলনটি উপলক্ষে গত বছরের সেপ্টেম্বরের ২১ তারিখে ঢাকায় পর্দাপণ করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গ আর ত্রিপুরার অর্ধশতাধিক বাঙালি লিভার বিশেষজ্ঞ। ধানমন্ডি ৩২-এ বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠতম এই বাঙালি মহানায়কের প্রতি তিন বাংলার লিভার বিশেষজ্ঞদের বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ছিল বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের সিইও মাশুরা আপার তত্ত্বাবধানে জাদুঘরটি ঘুরে দেখার পর্বটি। উপস্থিত লিভার বিশেষজ্ঞদের অনেকের জন্যই যা প্রথম এবং অবশ্যই অপার্থিব এক অভিজ্ঞতা। জাদুঘরের ভিজিটরস বুকে মন্তব্য করতে গিয়ে তাদের লেখায় তারই অনুরণন।
অপরাহ্ণে সম্মেলনটির সূচনা জাতির পিতার নামে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বের উচ্চতম মেডিকেল বিদ্যাপীঠ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে…’ সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে। কনফারেন্সটির এটাই থিম সং। এই সম্মেলনের জন্য এর চেয়ে মানানসই আর কোনো থিম সং মাথায় আসেনি তিন বাংলার সেরা লিভার বিশেষজ্ঞদের শত মাথা কুটেও। সম্মেলনটির বৈজ্ঞানিক সূচিও সাজানো হয়েছিল ভিন্ন আঙ্গিকে। বাংলাদেশের লিভার বিশেষজ্ঞদের উদ্ভাবিত হেপাটাইটিস বির নতুন ওষুধ ন্যাসভ্যাক যেমন ছিল, ছিল তেমনি ওয়েস্ট বেঙ্গল লিভার ফাউন্ডেশনে উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব লিভার অ্যান্ড ডাইজেস্টিভ সায়েন্সেস আর হেপাটাইটিস ফাউন্ডেশন ত্রিপুরার উদ্যোগে সাত লক্ষাধিক ত্রিপুরাবাসীকে হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিনেশনের আওতায় আনার সাফল্য গাথাও। বাঙালি লিভার বিশেষজ্ঞদের যা কিছু অর্জন বাংলাকে ছাপিয়ে বিশ্বময় বাংলার আর বাঙালির মুখ উজ্জ্বল করেছে তার সবটাই ছিল সম্মেলনটির বৈজ্ঞানিক সূচিতে। আর এভাবেই জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর প্রাক্কালে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত বাঙালি লিভার বিশেষজ্ঞরা।
এ বছর আমাদের লক্ষ্য ছিল আরো বড়। পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে শান্তি নিকেতনের বাংলাদেশ ভবনে আর তারপর একাত্তরের স্মৃতিবিজড়িত আগরতলায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় পদ্মা-গঙ্গা-গোমতী লিভার সম্মেলন আয়োজনের যে উদ্যোগ, শীঘ্রই তা থমকে গেল কোভিডের থাবায়। কিন্তু ওই যে পিতা বলে গিয়েছিলেন, বাঙালিকে দাবায় রাখা যায় না, দাবায় রাখা যায়নি আমাদেরও। ‘নিউ নরমাল’ পরিস্থিতিতে অনলাইনে সদ্যই অনুষ্ঠিত হলো ‘নিউ নরমাল’ দ্বিতীয় পদ্মা-গঙ্গা-গোমতী ভার্চ্যুয়াল লিভার সম্মেলনটি। সীমান্তের এপার-ওপারের চার শতাধিক বাঙালি বিশেষজ্ঞের আগ্রহী অংশগ্রহণই বলে দেয় বাঙালি আর বাংলার লিভার বিশেষজ্ঞদের কাছে কোথায় বঙ্গবন্ধুর অবস্থান।
এবারের সম্মেলনটির বৈজ্ঞানিক আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল আরো চমকপ্রদ। ন্যাসভ্যাক এখন আশা জাগাচ্ছে কোভিডেও। কিউবায় এরই মধ্যে সাফল্যের সঙ্গে ওষুধটি প্রয়োগ করা হয়েছে কোভিড চিকিৎসায়। নামকরা একটি আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক জার্নালে এ নিয়ে প্রকাশনা আসতে যাচ্ছে অচিরেই। পরিকল্পনা চলছে বড় মাপের আন্তর্জাতিক ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের। বাঙালির সাধ্য হতে পারে সীমিত, সামর্থ্য নয়। কোভিডে ন্যাসভ্যাক নিয়ে নানান আলোচনায় সরগরম এবারের ভার্চ্যুয়াল পদ্মা-গঙ্গা-গোমতী। একইভাবে বুক ফুলে গেছে ওয়েস্ট বেঙ্গল লিভার ফাউন্ডেশনের তিলে তিলে প্রতিষ্ঠিত বিশাল কোহর্ট থেকে ফ্যাটি লিভারের নানা অজানা তথ্য কীভাবে মানুষের লিভারবিষয়ক জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করছে তা দেখে। লিভার সিরোসিসের অত্যাধুনিক সব চিকিৎসা নিয়ে দারুণ উপস্থাপনা হেপাটাইটিস ফাউন্ডেশন ত্রিপুরারও। এক কথায় সব মিলিয়ে যাকে বলে ‘দারুণ’।
মুজিববর্ষ থাকছে আগামী বছরের শেষ অবধি। সঙ্গে বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী। সুবর্ণজয়ন্তী রাজনৈতিক বিভাজনে বিভাজিত তিন বাংলার বাঙালির যৌথ প্রযোজনায় একাত্তরে যে অনবদ্য চিত্রনাট্যটির অসামান্য চিত্রায়ণ তার। অধীর আগ্রহে আমরা তাকিয়ে আছি ২০২১-এর দিকে। মুজিববর্ষ আর সাধের বাংলাদেশের অর্ধশতবার্ষিকীতে প্রাণ খুলে আমরা বাঙালি লিভার বিশেষজ্ঞরা অভিবাদন জানাব আমাদের পিতাকে, এই প্রত্যাশায়। পিতা না এলে আসত না বাঙালির বাংলাদেশ। ন্যাসভ্যাক তো বহু দূরের কথা, হারিকেন জ্বালিয়েও এই ভূখণ্ডে খুঁজে পাওয়া যেত না এক-আধজন লিভার বিশেষজ্ঞও। পিতার প্রতি এই বাংলার লিভার বিশেষজ্ঞদের তো বটেই, ওপারের বাঙালি লিভার বিশেষজ্ঞদের শ্রদ্ধাও তাই অশেষ। আগামী জুনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্মৃতিবিজড়িত আগরতলায় তৃতীয় পদ্মা-গঙ্গা-গোমতী লিভার সম্মেলনে পিতার প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার বিপুল বহিঃপ্রকাশের প্রত্যাশায় এখন তাই দিন গোনা পৃথিবীর প্রান্ত থেকে প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লিভার বিশেষজ্ঞদের।
লেখক: চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্যসচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ