শহীদজননী জাহানারা ইমামের মৃত্যুবার্ষিকীতে নির্মূল কমিটির আলোচনা সভা

নিউজ ডেস্ক
সত্যবাণী

ঢাকাঃ বুধবার বিকাল সাড়ে ৩টায় শহীদজননীর ৩০তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে প্রতি বছরের ন্যায় ‘জাহানারা ইমাম স্মারক বক্তৃতা’, আলোচনা সভা এবং ‘জাহানারা ইমাম স্মৃতিপদক’ প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।এ বছর ‘জাহানারা ইমাম স্মারক বক্তৃতা’ প্রদান করেন বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি জনাব ওবায়দুল হাসান। তাঁর বক্তৃতার বিষয়: ‘বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন এবং ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার’। দাপ্তরিক প্রয়োজনের তাগিদে রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন জেলার অধস্তন আদালতসমূহ পরিদর্শনের কার্যক্রম গ্রহণ করায় তিনি শারীরিকভাবে উপস্থিত হতে পারেননি। তাঁর লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন নির্মূল কমিটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র সভাপতি শিক্ষাবিদ শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য প্রদান করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টামণ্ডলীর সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য প্রতি বছরের মতো এ বছরও বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ও সংগঠনকে ‘জাহানারা ইমাম স্মৃতিপদক’ প্রদান করা হয়। এ বছর ব্যক্তি হিসেবে বাংলাদেশের মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী নাগরিক আন্দোলনের পুরোগামী নেতা বিশ্ব শিক্ষক ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপিকা মাহফুজা খানম এবং সংগঠন হিসেবে ‘এম্পাওয়ারমেন্ট থ্রু ল অফ দা কমন পিপল’ (এলকপ)-কে জাহানারা ইমাম স্মৃতিপদক প্রদান করা হয়।উক্ত অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদান করেন বাংলাদেশের এ্যাটর্নি জেনারেল এডভোকেট আবু মোহাম্মদ আমিন উদ্দিন, বিশ্ব শিক্ষক ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপিকা মাহফুজা খানম, এলকপ-এর সভাপতি অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান ও ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র সহসভাপতি এডভোকেট এম সাঈদ আহমেদ রাজা। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক শহীদসন্তান আসিফ মুনীর।সূচনা বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন এবং ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনে শহীদজননী জাহানারা ইমমের অবদান স্মরণ করে নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘যে লক্ষ্য নিয়ে আমরা প্রায় তিন যুগ আগে নির্মূল কমিটির আন্দোলন শুরু করেছিলাম শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে এর আংশিক বিজয় অর্জিত হলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমজ ও রাষ্ট্র গঠন ও পরিচালনার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনও অগ্রগতি হয়নি। সংবিধানে রাষ্ট্রের চার মূলনীতি ফিরে এলেও জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদের দ্বারা কৃত সংবিধানের সাম্প্রদায়িকীকরণ ও পাকিস্তানীকরণের ক্ষতচিহ্ন এখনও রয়ে গেছে, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী না হলে এদেশে কখনো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্ভব হত না, সংবিধানের চার মূলনীতিও পুনঃস্থাপন করা যেত না। তাঁর নেতৃত্বে অভাবনীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণ করলেও দেশে যেভাবে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতার পাশাপাশি দুর্নীতি ও জবাবদিহিহীনতা বেড়েছে এর মূলোৎপাটন করতে না পারলে আমদের সকল অর্জন ব্যর্থ হয়ে যাবে।’
পুলিশের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার দুর্নীতি সম্পর্কে পুলিশ এসোসিয়েশনের বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করে শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘গুটিকয় পুলিশ কর্মকর্তার দুর্নীতির দায় কোনও অবস্থায় পুলিশ প্রশাসন বা সরকার নিতে পারে না। সাবেক আইজিপি বেনজিরের দুর্নীতির সংবাদ প্রথম গণমাধ্যমই প্রকাশ করেছে, যার ভিত্তিতে অনেক আগেই বিভাগীয় তদন্ত আরম্ভ করা উচিৎ ছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। তা না করে পুলিশ এসোসিয়েশন যেভাবে গণমাধ্যমের সমলোচনা করেছে তার দায় সরকারের ওপরই পড়ে। অপরাধীরা ব্যাংকে সঞ্চিত যাবতীয় অর্থ নিয়ে নিরাপদে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তাদের দেশ ছাড়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়, তাদের ব্যাংক লেনদেন বন্ধ করা হয়Ñ এটা একটা তামাশায় পরিণত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে দুদকও তাদের গাফেলতির দায় এড়াতে পারে না। কারা বেনজির ও মতিউরের মতো ভয়ঙ্কর দুর্নীতিবাজদের নির্বিঘ্নে দেশত্যাগ করতে দিয়েছে এরও তদন্ত হওয়া দরকার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিনাশী অপশক্তি বাংলাদেশকে ধ্বংস করার জন্য দেশে ও বিদেশে বহু ষড়যন্ত্র করছে। ষড়যন্ত্রকারীরা প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অবস্থান করছে। এদের নির্মূল না করলে মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় অর্জন নস্যাৎ হয়ে যাবে।’

জাহানারা ইমাম স্মারক বক্তৃতায় বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি জনাব ওবায়দুল হাসান তাঁর লিখিত ভাষণে বলেন, ‘১০ই এপ্রিল, ১৯৭২ তারিখে বাংলাদেশ গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কীয় প্রস্তাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, যারা জঘন্য যুদ্ধ-অপরাধী, যারা এই দেশে পাশবিক অত্যাচার করেছে, লুট করেছে, আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে তাদের যুদ্ধ-অপরাধী হিসেবে বিচার হবে।… এই যে ন্যায়বিচারের আকাক্সক্ষা, নির্যাতনের ক্ষতকে সারিয়ে তোলার প্রচেষ্টা, অত্যাচারিতের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে সঠিক বিচারের বন্দোবস্ত করা, এটাকে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের অন্যতম মূলনীতি বললে অত্যুক্তি হবে না। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি গঠিত হয়েছিল বঞ্চিতের অধিকার প্রতিষ্ঠায়, সাম্য আর ন্যায়বিচার ছিল তার বুনিয়াদি পাটাতন। আর এই পাটাতন দৃশ্যমান হয়েছে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে, যখন তিনি দ্রুততম সময়ে আমাদের দিয়েছিলেন বিশ্বের অন্যতম উৎকৃষ্ট সংবিধান। লক্ষণীয়, যে মানুষটি আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন, রাষ্ট্র গড়ে দিয়েছেন, অবিসংবাদিত জনপ্রিয়তায় সিক্ত হয়েছেন, যে মানুষের মুখের কথায় ৭ মার্চের পর থেকে এ অঞ্চলে ডি ফ্যাক্টো সরকার গঠিত হয়ে গেছে, শুধু তাই নয়, স্বাধীনতার পর যে তুমুল উদ্দামতায় মানুষ তাঁকে বরণ করে নিয়েছে, কেবল তাঁর মৌখিক নির্দেশনাকে আইনের রূপ দিতে প্রস্তুত থেকেছে, সে মানুষটি কিন্তু দিনশেষে সংবিধানের কাছেই ফিরে গিয়েছেন, আইনের শরণাপন্ন হয়েছেন, আইনের শাসন নিশ্চিত করেছেন। এটা তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার অসামান্য স্মারক।
প্রধান বিচারপতি তাঁর লিখিত ভাষণে আরো বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু অস্ত্রের প্রতিযোগিতাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, বর্ণবৈষম্যকে ঘৃণা করেছেন, বিশ্বব্যাপী সম্পদের সুষম বণ্টনের উপর জোর দিয়েছেন। তিনি দক্ষিণ এশিয়া, উপমহাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত, পুরো পৃথিবী নিয়ে ভেবেছেন। ৬ নভেম্বর, ১৯৭৪ এ মিশরের কায়রোতে এক ভোজসভায় বঙ্গবন্ধু ইসরাইলি আগ্রাসন ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন, ফিলিস্তিনিদের বলেছিলেন ভাই, তাদের পূর্ণ জাতীয় মর্যাদা এবং অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের পাশে থাকার কথা বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সেদিনকার কথাগুলোই কি আজ আবারও ভীষণ প্রাসঙ্গিক হয়ে ফিরে আসছে না? বিশ্বব্যাপী কর্পোরেট পুঁজির অসম সঞ্চালনে, ভোগবিলাসের আয়োজনে কি পৃথিবী আহত হচ্ছে না? অনাহারে অর্ধাহারে থাকা মানব সন্তানদের হাহাকার ধনকুবেরদের মহাকাশ ভ্রমণের লালসা থামাতে পারছে না। নিয়মিত বিরতিতে বিলিয়নিয়ারদের বহুমূল্য ইয়টে অবকাশ যাপন কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না। নিহত যুদ্ধশিশুর লাশ হাতে নিয়ে যে বাবা শোকে পাথর হয়ে আছেন, যে মা তীব্র অনুতাপে দগ্ধ হচ্ছেন এই ভেবে, ঘাতক বুলেট তাঁর শরীরে না লেগে সন্তানের নরম হৃদপিণ্ডে বিদ্ধ হলো কেন, তাঁরা কি জানেন, তাঁদের সন্তানের রক্তে প্রতি মুহূর্তে অকল্পনীয় অর্থমূল্যে পরিপুষ্ট হচ্ছে বিশ্বের অস্ত্র কারখানাগুলো? আসুন, আজকের যুদ্ধংদেহী পৃথিবীতে বঙ্গবন্ধুর কাছে ফিরে যাই, তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের ঔজ্জ্বল্যে নিজেরা সমৃদ্ধ হই, আর তা ছড়িয়ে দেওয়ার দায়ভার নিই পৃথিবী জুড়ে।’

নির্মূল কমিটির সভাপতি শিক্ষাবিদ শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ভালবাসা বাঙালির জন্য এবং বিশ্বের সকল শোষিত মানুষের জন্য এটিই তাঁর দর্শন। তিনি তাঁর মানবিক আদর্শের আদলেই দেশ গড়তে চেয়েছিলেন। ’৭৫-এর পর বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ছুড়ে ফেলেছিল স্বাধীনতাবিরোধীরা সেই আদশর্কে বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী।বাংলাদেশের এ্যাটর্নি জেনারেল এডভোকেট আবু মোহাম্মদ আমিন উদ্দিন বলেন, ‘ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর স্বাধীনতাবিরোধীরা যখন বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান বানানোর চক্রান্ত শুরু করল। ঠিক সেই সময় আবির্ভূত হয়ে ছিলেন শহীদজননী। তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় গণআদালত। আজ শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের জন্য তিনি যে মশাল জ্বালিয়ে ছিলেন, আমরা পরবর্তী প্রজন্ম সেটিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাব।বিশ্ব শিক্ষক ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপিকা মাহফুজা খানম বলেন, ‘ ‘বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য সারা দেশে ৭৩টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার আরম্ভ করেছিলেন কিন্তু ’৭৫-এর পর সেটি বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তিতে ’৯২ সালে শহীদজননী জাহানারা ইমাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য যে সাহসী উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেই আন্দোলন আমরা এখনো এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আমরা যেরকম বাংলাদেশ চেয়েছিলাম এখনো তা প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি।’

সংগঠন হিসেবে ‘এম্পাওয়ারমেন্ট থ্রু ল অফ দা কমন পিপল’ (এলকপ)-কে ‘জাহানারা ইমাম স্মৃতিপদক’ প্রদান করায় নির্মূল কমিটিকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে সংগঠনের সভাপতি অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘এই সম্মাননা ‘এলকপ’-কে মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবায়নের কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে প্রেরণা যোগাবে।তিনি আরো বলেন, ‘এলকপ ২০০৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে যুদ্ধাপরাধীদের মক ট্রায়াল (প্রতীকী বিচার) করেছিল। বর্তমানে শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য সম্পন্ন হয়েছে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের কার্যক্রমের আন্দোলনে এলকপ সবসময় নির্মূল কমিটির পাশে থাকবে।আলোচনা সভায় শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করেন নির্মূল কমিটি’র সহসভাপতি এডভোকেট এম সাঈদ আহমেদ রাজা। সভায় বক্তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও দুর্নীতি নির্মূলের আহ্বান জানান।এর আগে আজ সকাল ৮টায় মিরপুরে শহীদজননী জাহানারা ইমামের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন নির্মূল কমিটির নেতৃবৃন্দ।

You might also like