শিকড়ভূমির গণতন্ত্র পুনোরুদ্ধার আন্দোলনের স্মরণীয় দিন ১৪ই মে, প্রবাসী নেতাদের গ্রেফতার দিবস
স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
সত্যবাণী
লন্ডন: সাধারণ ঘটনাগুলো নিয়েও অনেক সময় অনেক দিবস পালিত হলেও, কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটার কিছুদিন পরই মানুষ তা ভুলে যায়। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশের শিকড় প্রেমিক অভিবাসী বাঙালীদের জন্য ১৪ই মে এমনি একটি স্মরণীয় দিন, যা আমরা সহজেই ভুলতে বসেছি। ২০০৭ সালের এইদিন ১/১১ সরকারের আমলে শিকড়ভূমির গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ায় সিলেটে গ্রেফতার হয়েছিলেন অনির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে সক্রিয় যুক্তরাজ্য ও কানাডা আওয়ামী লীগের প্রবাসী নেতারা। তাদের সাথে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের নেতারাও।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতিটি বাঁকেই আন্দোলনরত দেশবাসীর পাশাপাশি বিদেশে বসবাসরত অভিবাসী বাঙালিরা পালন করেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সেই পাকিস্তান আমল থেকেই আন্দোলন সংগ্রামের দুর্দিন দুঃসময়ে জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মাওলানা ভাসানীসহ তৎকালীন শীর্ষ রাজনীতিকদের অনেকেই প্রবাসী বিশেষ করে যুক্তরাজ্য প্রবাসীদের কাছে পেয়েছেন সহযোগীতা ও ভরসা।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ের পর মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বার্লিনে অনুষ্ঠেয় শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে ইউরোপে যাত্রা করেন। প্রতিনিধিদলটি লন্ডনে থাকতেই যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়া হয়। জারি করা হয় কুখ্যাত ৯২-ক ধারা। মওলানা ভাসানীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ওপর জারি করা হয় নিষেধাজ্ঞা। হুমকি দেওয়া হয় দেশে ফিরলে বিমানবন্দরেই তাঁকে গুলি করে মারা হবে। লন্ডনে নির্বাসিত মাওলানার প্রতি প্রবাসীরা তখন বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সহযোগিতা ও ভরসার হাত। লন্ডনের পাকিস্তান দূতাবাসের অসহযোগীতার কারনে ঐসময় আর বার্লিন সম্মেলনে যোগ দেয়া সম্ভব হয়নি মাওলানা ভাসানীর।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাসহ বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাজ্য প্রবাসী অভিবাসী বাঙালিরা ছিলেন জাতীর জনক বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা। আর তাই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু প্রথমেই এসেছিলেন তাঁর প্রিয় যুক্তরাজ্য প্রবাসীদের কাছে।
১৯৭৫ এর ১৫ই আগষ্ট জাতীর জনকের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর তাঁর বেঁচে যাওয়া দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকেও বুকে তুলে নেন প্রবাসীরা। বঙ্গবন্ধু কন্যাদের যেকোন দুঃসময়ে প্রবাসীরা যে নিজেদের সহযোগিতার হাত সব সময়ই বাড়িয়ে রাখেন তাঁর আরেক প্রমান ১/১১ পরবর্তী শেখ হাসিনার নির্বাসন জীবন।
৭ মে’ ২০০৭ সাল। ১/১১ খ্যাত তৎকালীন তত্বাবধায়ক সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে লন্ডন হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন শেখ হাসিনা। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা শেষে শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরাকালে তদানীন্তন তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাঁর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার ঐকান্তিক দৃঢ়তা, ব্রিটেনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত অভিবাসী বাংলাদেশী ও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর রাজনীতিকসহ গণতন্ত্রকামী দেশবাসীর চাপে শেষ পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
দেশে ফেরার পথে শেখ হাসিনা লন্ডনে অবস্থান করেন বেশ কিছুদিন। এই সময়ে ব্রিটেনের রাজনীতিক ও এমপিসহ প্রবাসে সক্রিয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা তাঁর দেশে ফেরার দৃঢ় অঙ্গীকারের সমর্থনে পাশে দাঁড়ান শেখ হাসিনার। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানার নেপথ্য উৎসাহ ও পরামর্শে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নেত্রীর দেশে ফেরার পক্ষে বাংলাদেশের অগণতান্ত্রিক সরকারের উপর চাপ প্রয়োগের জন্য ব্রিটিশ সরকার ও রাজনীতিকদের কাছে লাগাতার ক্যাম্পেইন চালাতে থাকেন। বাংলাদেশ সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারনে দেশে যাওয়ার উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনা লন্ডন হিথরো বিমান বন্দরে পৌছার পরও ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ তাঁকে বোর্ডিং পাস দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় বাধ্য হয়ে এয়ারপোর্ট থেকে ফেরত আসেন শেখ হাসিনা।
এরপরতো বাকী ইতিহাস। বিশ্ব জনমতের চাপে শেখ হাসিনার দেশে ফেরার নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন সরকার।জরুরি অবস্থার মধ্যেই যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের বেশ কজন নেতাকর্মী পরিবেষ্টিত হয়ে ৭ই মে ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণ করেন শেখ হাসিনা, লাখো জনতা জানায় তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে মিছিল শোভাযাত্রা সহকারে তাকে ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবনে নিয়ে আসা হয়।
নেত্রীকে নিরাপদে বঙ্গবন্ধু ভবনে পৌছে দিয়ে তাৎক্ষনিক যুক্তরাজ্যে ফিরে না এসে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত নেন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ। এমনি এক পর্যায়ে তারা গমন করেন পূন্যভূমি সিলেটে। যেহেতু শেখ হাসিনার সাথে প্রবাসী নেতাদের দেশে আগমন খুব একটা ভালো চোখে দেখেনি ১/১১ সরকার, সেহেতু প্রবাসী নেতাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষন করছিলো সরকারের বিশেষ বাহিনী। ২০০৭ সালের ১৪ই মে এক সময়ের যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ ও তৎকালীন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের নেতা শফিকুর রহমান চৌধুরী যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ নেতাদের সম্মানে একটি গেটটুগেদার অনুষ্ঠান আয়োজন করেন। সিলেট শহরের অদুরে শফিক চৌধুরীর বাগান বাড়ীতে মিলিত হন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগ সহ যুক্তরাজ্য ও কানাডা আওয়ামী লীগের নেতারা। সেখান থেকেই র্যাব ও পুলিশ গ্রেফতার করে তাদের সবাইকে। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ নেতা সুলতান শরীফ, অধ্যাপক আবুল হাশেম, আলহাজ্ব সমরু মিয়া, ফারুক চৌধুরী, সৈয়দ সাজিদুর রহমান ফারুক, এম এ রহিম, সৈয়দ আবুল কাশেম, ঝলক পাল, কানাডা আওয়ামী লীগ নেতা সরোয়ার হোসেন, তৎকালীন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা শাহেদ রেজা, মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী, জেলা নেতা শফিউল আলম নাদেল, এডভোকেট নাসির উদ্দিন, জগলু চৌধুরী, সৈয়দ শামীম, হাবিব সেলিমসহ আরও অনেকেই গ্রেফতার হন ঐসময়। পরবর্তীতে শারিরীক অসুস্থতা ও বয়স বিবেচনায় সুলতান শরীফ, অধ্যাপক আবুল হাশেম ও আলহাজ্ব সমরু মিয়াকে বাদ দিয়ে বাকী সবাইকে নিক্ষেপ করা হয় কারাগারে।
প্রবাসী নেতাদের এই গ্রেফতারে জনমনে চাপা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ঢাকা ব্রিটিশ হাই কমিশনও যুক্তরাজ্য প্রবাসী নেতাদের এই গ্রেফতারে অসন্তোষ প্রকাশ করে। গ্রেফতারকৃত নেতারা সরকারের বিশেষ বাহিনীর প্রবল চাপের মধ্যেও গণতন্ত্র ও নেত্রী শেখ হাসিনার প্রশ্নে পালন করেন আপোষহীন ভূমিকা। অবশেষে ১৪দিন কারান্তরীন রেখে মুক্তি দেয়া হয় নেতাদের।
১৪ই মে’র ঐ গ্রেফতারের মুহূর্তটি এখনও ভুলতে পারেননি গ্রেফতারকৃত যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ। গ্রেফতার হওয়া নেতাদের একজন সৈয়দ ফারুক সত্যবাণীকে বলেন, অনেকটা চ্যালেন্জ নিয়েই আমরা নেত্রীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনসঙ্গী হয়েছিলাম। জানতাম এই সঙ্গী হওয়ায় ঝুঁকি আছে, অনির্বাচিত সরকারের টার্গেট হতে পারি। একটি অনির্বাচিত সরকারের হাতে গণতন্ত্রই যেখানে জিম্মি, সেখানে নিজের নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে চিন্তা করাতো স্বার্থপরতা। জননেত্রী শেখ হাসিনার কর্মীরাতো এমন স্বার্থপর হতে পারেনা। আর তাই গ্রেফতার ঝুঁকি মাথায় নিয়েই ঐদিন আমরা নেত্রীর সফরসঙ্গী হয়েছিলাম।
গ্রেফতার হওয়া আরেক নেতা সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সাংসদ শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, দেশের যেকোন দুর্যোগ দুঃসময়ে প্রবাসীরা সবসময়ই ইতিবাচক ভূমিকা নিয়ে পাশে দাড়িয়েছেন। ১/১১ সরকারের ক্ষমতাকালীন সময়ও ছিলো দেশের জন্য একটি দুঃসময়। গণতন্ত্র পুনরোদ্ধারের সেই আন্দোলনেও প্রবাসী বাঙালীরা জননেত্রী শেখ হাসিনার পাশে ছিলেন অতীতের ধারাবাহিকতায়। সুতরাং শেখ হাসিনার হাত শক্তিশালী করতে গিয়ে ২০০৭ সালের ১৪ই মে আমরা যে গ্রেফতার হয়েছিলাম তা আমারা তথা পুরো যুক্তরাজ্য প্রবাসীদের জন্যই ইতিহাসে গৌরবজনক অধ্যায় হিসেবেই লিপিবদ্ধ থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।