শেখ কামাল মুখরিত করে রাখতেন সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়াঙ্গন
আবু মুসা হাসান
শেখ কামাল ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে আমাদের আগের ব্যাচের ছাত্র। এর আগে ঢাকা কলেজেও তিনি আমাদের এক বছর ওপরের ক্লাশে ছিলেন। কিন্তু সিনিয়র হলেও কামালভাই আমাদের সঙ্গে আড্ডা মারতেন চুটিয়ে। রাজনৈতিক মতপার্থক্য তাঁর কাছে কোনো বিষয় ছিলনা। আমাদের সময় সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে ছাত্রলীগের ছিল একচেটিয়া আধিপত্য। কিন্তু আমরা কয়েকজন ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে তপ্রোতভাবে জড়িত থাকলেও তাঁর স্নেহ থেকে কখনও বঞ্চিত ছিলাম না।
আজ ৫ই আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তনয় বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামালের ৭২তম জন্মদিন। জন্মদিনে রইলো তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা।
ঢাকা কলেজে অধ্যয়নকালেই কামাল ভাইকে দেখেছি ছাত্রলীগের একজন তুখোর নেতা হিসেবে। আইয়ুব-মোনায়েম বিরোধী আন্দোলনে তিনি সবসময়ই ছিলেন সোচ্চার। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি বাংলাদেশে সেবাহিনীর প্রথম ব্যাচের কমিশন অফিসার হিসেবে মুক্তিবাহিনীর সিএনসি জেনারেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। স্বাধীনতার পর তিনি আবার ফিরে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
শেখ কামালের বর্ণাঢ্য জীবন সম্পর্কে পূর্নাঙ্গ মূল্যায়ন নয়, আমি তাকে ঢাকা কলেজে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে দেখেছি, তাই সংক্ষেপে লিখছি। এক কথায় বলতে গেলে বলতে হয় যে, শেখ কামাল আমাদের সময়কার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে প্রাণবন্ত ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন । ‘অলরাউন্ডার’ বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন তা–ই। গান, নাটকসহ সাংস্কৃতিক নানা বিষয়সহ সব ধরনের খেলাধুলায় তিনি ছিলেন সমভাবে পারদর্শী। সেতারও ছিল তাঁর একটি প্রিয় বাদ্যযন্ত্র। সবসময় হইহুল্লোড় করে আসর মাতিয়ে রাখতেন। আর দলবেঁধে গান গাইতেন। ছোটবড় সবার সঙ্গে ছিল তাঁর বন্ধুত্ব। চালচলন ছিল একেবারে সাদাসিধা। তাঁকে দেখে কখনও মনে হতনা যে, তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রীর ছেলে।
প্রতি বছর ১৫ আগস্টের কালোরাতের প্রাক্কালে শেখ কামালের স্মৃতি মনে ভেসে ওঠে। তাঁর কথা মনে হলে আরও কষ্ট লাগে এই জন্য যে, পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে ঘাতকের বুলেটে নিহত হওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেও তিনি ছিলেন আমাদের সঙ্গে, হইহুল্লোড় করে আমাদের মাতিয়ে রেখেছিলেন তাঁর স্বভাবসুলভ প্রাণবন্ত আড্ডায়।
১৫ আগস্ট সকালে বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে আসার কর্মসূচি ছিল। এই কর্মসূচি নিয়ে ডাকসুর পক্ষ থেকে ক্যাম্পাস জুড়ে চলছিল প্রস্তুতি। ছাত্র–শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) নির্মিত হয়েছিলএকটি সুউচ্চ টাওয়ার। আর্টস কলেজের (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ) ছাত্রছাত্রীরা এটি তৈরি করেছিল।
এই টিএসসি মিলনায়তনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং ডাকসু ও হল সংসদগুলোর প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দেবার কথা ছিল। ভাষণ দেবার আগে কলা ভবনের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের মিউজিয়াম পরিদর্শনের কর্মসূচিও ছিল। এছাড়া কার্জন হলেও তাঁর অপর একটি অনুষ্ঠানে যাবার কথা ছিল। মহসীন হল ছাত্র সংসদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য আমিও আমন্ত্রণপত্র পেয়েছিলাম।
অন্যদিকে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হিসেবে আগের দিন অর্থাৎ ১৪ আগস্ট রাতে আমরা ব্যস্ত ছিলাম বিভাগের মিউজিয়াম এবং এর প্রবেশ পথের সাজসজ্জার কাজে। শেখ কামাল ওই রাতে আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। সাজসজ্জার কাজ তদারক করছিলেন আর তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে গল্প করে গান গেয়ে সবাইকে মাতিয়ে রেখেছিলেন।
কলা ভবনের নিচতলার সামনের দিকে অবস্থিত আমাদের মিউজিয়ামের প্রবেশপথে খড় দিয়ে একটি কুঁড়েঘর বানানো হয়েছিল। হঠাৎ কামাল ভাইয়ের মাথায় এল যে, কুঁড়েঘরের চালে লাউ গাছ ও লাউ ঝুলিয়ে দিতে পারলে চমৎকার হবে। আমাকে বললেন, ‘‘কী রে হাসান, এখানে একটা সাধের লাউ ঝুলিয়ে দিতে পারবি না? যদি পারিস, তাহলে মনে হবে এটা একটা আসল কুঁড়েঘর।’’
যে কথা সেই কাজ। দুজন সঙ্গী নিয়ে রাতের আঁধারে চলে গেলাম সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ইন্সটিটিউটে। মেয়েদের হোস্টেলের গাড়ি–বারান্দার ওপর থেকে লাউগাছের ডগা নেওয়ার জন্য ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী গণিকে তার হোস্টেলের রুম থেকে তুলে নিয়ে এলাম। গণি তখন ঘুমাচ্ছিল। আমাদের জন্য তাকে উঠতে হল। কিন্তু মেয়েদের হোস্টেলে কাছে গিয়ে দেখলাম, ওগুলো লাউগাছ নয়, চালকুমড়া গাছ। অগত্যা চালকুমড়ার ডগা নিয়েই ফিরতে হল আমাদের।
কামাল ভাই ঐগুলো দেখে মহাখুশি হয়ে বললেন, ‘‘একই কথা, যেই লাউ সেই কদু। চালকুমড়ার ডগাই চলবে।’’ এরপর বললেন, ‘‘ডগা তো হল, এবার লাউ জোগাড় করতে পারলেই হবে।’’
তাঁকে বললাম, ‘‘এখন লাউয়ের সিজন নয়, ভোরবেলা নিউ মার্কেটের কাঁচাবাজারে গিয়ে চালকুমড়া নিয়ে আসার চেষ্টা করব।’’
উল্লেখ্য, ওই সময়ে তাঁর প্রিয় গানের একটি ছিল, ‘সাধের লাউ বানাইলি মোরে বৈরাগী।’ প্রায়ই দল বেঁধে কামাল ভাই ওই ‘সাধের লাউ’ গানটি গাইতেন। ওই রাতেও গানটি গেয়েছিলেন ক্ষণে ক্ষণে।
এভাবে দেখতে দেখতে রাত দু্টো বেজে গেল। এক পর্যায়ে কামাল ভাই বললেন, “তোরা থাক, আমি একটু বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নিয়ে আসি।”
কিন্তু এই বিশ্রাম যে তাঁর সারা জীবনের বিশ্রামে পরিণত হবে তা আমরা কেউ তখন কল্পনাও করতে পারিনি। আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাসায় ঘাতকরা বুলেটে বুলেটে কামাল ভাইয়ের বুক ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। জাতির জনককে হত্যা করেছে সপরিবারে।
ভোরবেলায় এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের সংবাদ পেয়ে আমরা ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে আসি। এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পর চারদিকে তৈরি হয় এক অসহনীয় পরিবেশ। পাকিস্তানি সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের উপর আবার চেপে বসে সামরিক স্বৈরাচার। প্রায়ই মনে হত, কামাল ভাই যদি বিশ্রাম নেওয়ার জন্য ওই রাতে ৩২ নম্বরের বাসায় না যেতেন তাহলে হয়তো বেঁচে যেতেন– মুজিবহীন বাংলায় মানুষের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন শোষণহীন বাংলাদেশ কায়েমের জন্য দিতে পারতেন বলিষ্ঠ নেতৃত্ব।
বিশ্ববিদ্যালয় সপ্তাহ :
ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী হয়েও কামাল ভাইয়ের কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়ার প্রসঙ্গে আরও একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। সম্ভবত ১৯৭৪ সালে ডাকসুর উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সপ্তাহ উদযাপিত হয়েছিল। ওই সময় ডাকসুর ভিপি ছিলেন বর্তমানে সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং জিএস ছিলেন বর্তমানে আইটি খাতের সফল ব্যবসায়ী মাহবুব জামান।
ডাকসুর সদস্য, বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব ও সংগঠক ম. হামিদ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সপ্তাহ উদযাপন পরিষদের আহবায়ক। হামিদ ভাইও ছিলেন মহসীন হলের আবাসিক ছাত্র। আমি তাঁর খুবই স্নেহাস্পদ ছিলাম। আমার ওপর হামিদ ভাইয়ের অগাদ আস্থা ছিল। তাই হামিদ ভাই আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সপ্তাহ উদযাপন কমিটির ক্রীড়া উপ–পরিষদের আহ্বায়ক করেছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয় সপ্তাহ উপলক্ষে আমরা সব ধরনের ইনডোর গেমের আয়োজন করেছিলাম। আরও আয়োজন করেছিলাম বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বনাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দলের মধ্যে একটি প্রীতি বাস্কেটবল ম্যাচ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জিমনেসিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই প্রীতি ম্যাচটি।
তবে সাঁতার প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে গিয়ে পড়েছিলাম মহা বিপাকে। টিএসসির সুইমিংপুলে সাঁতার প্রতিযোগিতা হবে। কিন্তু পুল ছিল পানিশুন্য। বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশলীরা পানি সরবরাহ করতে অপারগতা প্রকাশ করলেন এই বলে যে, পানি দিয়ে সুইমিং পুল ভরতে গেলে রোকেয়া হলও শামসুন্নাহার হলে তীব্র পানি সংকট দেখা দিবে।
এই অবস্থায় আমরা ফায়ার ব্রিগেডের শরণাপন্ন হলাম। তাদের বলা হল, জগন্নাথ হলের পুকুর থেকে পানি এনে সুইমিং পুল ভরে দিতে। কিন্তু তা–ও হলোনা, জগন্নাথ হল কর্তৃপক্ষ জানালেন যে, তাদের পুকুর থেকে পানি আনলে পুকুরের চাষ করা সব মাছ মরে যাবে।
কী আর করা! এবার আমরা ফায়ার সার্ভিসের মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পুকুর (বাংলা একাডেমির উল্টো দিকে) থেকে পানি আনার বন্দোবস্ত করলাম। সে জন্য রাতে ফায়ার ব্রিগেডের লোকজন এসে রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ করাতে বললেন। কারণ গাড়ি চলাচল করলে তাদের পানি আনার পাইপ ফেটে যাবে।
তখন রাত প্রায় ১০টা বাজে। রাস্তা বন্ধ করতে হলে পুলিশের প্রয়োজন। এতো রাতে আর কোনো উপায় না পেয়ে সোজা চলে গেলাম কামাল ভাইয়ের কাছে। ৩২ নম্বরের বাসায় গিয়ে তাঁকে খোঁজ করলাম। কামাল ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি শুনেই মূল ফটকে পাহারারত পুলিশ কনস্টেবল কোনো কিছু জিজ্ঞেস না করেই আমাকে ভেতরে নিয়ে গেল, খবর দিল কামাল ভাইকে। তখন বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাসভবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল এমনই।
যাহোক, কামাল ভাই নিচতলার বসার ঘরে চলে এসে আমার কাছ থেকে পুরো কাহিনী শুনে পুলিশের উর্ধ্বতন ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ করে রাতের বেলায় ঐ রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখার জন্য অনুরোধ করলেন।। ফায়ার ব্রিগেড পানিতে ভরে দিল টিএসসির সুইমিং পুল। পরদিন আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় ভাইস চ্যান্সেলর আবদুল মতিন চৌধুরী সাঁতার প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করলেন।
উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সপ্তাহের একক অভিনয়, গান, খেলাধুলা প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে শেখ কামাল বিজয়ী হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন গেমে যারা চ্যাম্পিয়ন ও রানার আপ হয়েছিলেন, কামাল ভাই তাদের সবাইকে নিউ এলিফ্যান্ট রোডেরএকটি চাইনিজ রেস্তোরাঁয় দাওয়াত দিয়েছিলেন। ক্রীড়া উপ–পরিষদের আহ্বায়ক হিসেবে আমিও তাঁর দাওয়াত পেলাম। খাওয়া–দাওয়ার পর তিনি সবাইকে তাঁর আবাহনী ক্লাবে যোগদানের আমন্ত্রণ জানালেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, আবাহনী ক্রীড়াচক্র প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি বাংলাদেশের ক্রীড়াজগতে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
তেমনি স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করে তিনি সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও এক বিরাট অবদান রেখে গেছেন। প্রকৃত অর্থেই শেখ কামাল ছিলেন একজন ক্রীড়া ও সংস্কৃতি–অনুরাগী। কখনও ব্যবসায়িক কার্যকলাপে জড়িত হননি তিনি, ছোটেননি অর্থের পেছনে।
আবু মুসা হাসানঃ সাংবাদিক, সত্যবাণীর উপদেষ্টা সম্পাদক