শ্রদ্ধার্ঘ্য: ডাঃ ফয়জুল ইসলাম ফজলু

 হরমুজ আলী

বেশকিছু দিন থেকেই তাঁর শরীরটা ভালো যাচ্ছিলনা। শেষপর্যন্ত ডাঃ ফজলু ভাইকেও অসুখের কাছে হার মানতে হলো। চলে গেলেন পরপারে। তাঁর জীবনের উপর একটি বই লিখা হবে, আমাকে সেই বইয়ে লেখা দেবার কথা বললে আমার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমি তাৎক্ষণিক রাজি হয়ে যাই। সেই লেখাটাই আজ বন্ধুদের সাথে শেয়ার করছি। অসময়ে চলে যাওয়া ডাঃ ফজলু ভাইয়ের স্মৃতির প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা।

সিলেট মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নকালে ফয়জুল ইসলাম ফজলু সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। সময়টা তখন সব অর্থেই প্রতিকূল, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতির জন্যতো বটেই। মেধাবী পড়ুয়া ছাত্র, পাশ করে বি সি এস করবেন, সরকারি মেডিকেল কর্মকর্তা হবেন, না-হয় কোনো না কোনো বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশ চলে যাবেন, নির্ঝঞ্ঝাট ভবিষ্যৎ, তাঁর এতো ঝামেলায় যাবার দরকার কি? না, তিনি ঝামেলাই বেছে নিয়েছেন, কারণ একটাই – বঙ্গবন্ধু প্রেম। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা পোষণের এটা আমার আরেকটা কারণ।

পচাত্তরের সহযোদ্ধা, আমৃত্যু বন্ধুদের সাথে  ডা: ফয়জুল ইসলাম। বাঁ থেকে – লস্কর ভাই, শাহ ফারুক ভাই, ফরহাদ ভাই ও ফজলু ভাই।

আমি তখন ডিগ্রী কলেজে (এখনকার এম সি কলেজ) পড়ি। রাজনীতি নিষিদ্ধ। এর কিছুদিন পর ঘরোয়া রাজনীতি শুরু হয়েছে। আস্তে আস্তে ‘ঘরোয়া’ শর্তটা উঠে গেলেও সরকারি রক্তচক্ষুর প্রতাপ কিন্তু বাড়ছে বৈ কমছে না। সেই বিভীষিকাময় সময়ে ছাত্রলীগ পুনর্গঠনে নেতৃত্ব দিয়েছেন শ্রদ্ধেয় ফজলু ভাই তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে। তখনকার প্রেক্ষাপটে এই বিষয়টা যে কী পরিমাণ সাহস, ত্যাগ এবং কমিটমেন্ট এর ব্যাপার ছিলো, এখন সেটা বলে বুঝানো যাবেনা।

প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ছে ১৯৭৪ সালের কথা। শফিকুর রহমান চৌধুরীর বর্তমান টিলাগড়ের বাসায় আমরা মেস করে থাকি। তখন ছিলো একচালা টিনের ঘর। সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, শাহাদাত রহিম চৌধুরীরা কলেজ সংসদে নির্বাচন করছেন, আমাদের মেস হয়ে উঠেছে তাদের অলিখিত অফিস। দিনরাত জমজমাট। অথচ ‘৭৫ এর ১৫ই আগষ্টের পর সব যেনো নিমেষেই পালটে গেলো। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সুলতান ভাই চলে গেলেন ভারতে। বেশিরভাগ নেতাকর্মী আত্মগোপনে। সেই সময়টাতে সমসাময়িক নেতাকর্মীদের নিয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতির হাল ধরলেন আজকের ডাঃ ফয়জুল ইসলাম ফজলু ও ফয়জুল ইসলাম লস্কর, ‘৭৫ পরবর্তীতে প্রথম সভাপতি- সাধারণ সম্পাদক।

পারসিক চেহারার সৌম্য-সুদর্শন ফজলু ভাই তাঁর সেই বিখ্যাত মটর সাইকেলে চষে বেড়িয়েছেন সিলেট শহরের অলিগলি, সাথে তাঁর সহযোদ্ধা-সহকর্মী। আমরা দূর থেকে দেখেছি শ্রদ্ধাভরে। নেতাদের চারপাশে ঘুরাঘুরির অভ্যাসটা তখনও আমার ছিলোনা, এখনও রপ্ত করতে পারিনি বলে দেশে থাকতে ফজলু ভাই’র সাথে সম্পর্ক গভীরতা পায়নি কিন্তু শ্রদ্ধা-ভালোবাসার ঘাটতি ছিলোনা।

তাঁর সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে যুক্তরাজ্যে আসার পর। একই রাজনীতির মানুষ হিসেবে প্রথমে ‘প্রাক্তন ছাত্রলীগ যুক্তরাজ্য অধ্যায়’ প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে। তারপর, তাঁর বইয়ের প্রকাশনা উৎসব সাফল্যমণ্ডিত করার লক্ষ্যে আমি আমার তরফথেকে যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করেছি, যার ফলে ঘনিষ্ঠতা আরো বাড়ে।

আমাদের ফজলু ভাই বহুমাত্রিক প্রতিভার মানুষ। লেখালেখির প্রতি প্রচন্ড টান আর ভালোবাসার কারনে ইতোমধ্যেই তাঁর বেশকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। সমাজচিন্তা তাঁর আরেকটা আবেগের জায়গা। নিজ এলাকায় শিক্ষার প্রসারে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। সর্ব ইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদের দীর্ঘদিন সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, এখন সভাপতি। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সন্মানিত সদস্য।

বঙ্গবন্ধু অন্তপ্রান ডাঃ ফয়জুল ইসলাম ফজলু’র কর্মময় জীবনের উপর বই প্রকাশিত হচ্ছে জেনে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। তাঁর একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে আমার এই শ্রদ্ধার্ঘ্য। ভালো থাকুন ফজলু ভাই, বেঁচে থাকুন আমাদের মাঝে আরও বহুকাল।

হরমুজ আলী: রাজনীতিক ও লেখক। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি।

 

You might also like