শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পরশে অজয় পালের অন্তিম যাত্রা: লন্ডন শহীদ মিনারে শোকবিধূর পরিবেশ

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
সত্যবাণী 

লন্ডন: সতীর্থ, স্বজন, শুভানুধ্যায়ীদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পরশ নিয়ে অনন্তলোকের পথে অন্তিম যাত্রা করেছেন একাত্তরের কলমযোদ্ধা, বিশিষ্ট সাংবাদিক অজয় কুমার পাল। সোমবার, ১৬ই জানুয়ারী বিকেল ১.৩০ থেকে ২.৩০ মিনিট পর্যন্ত পূর্ব লন্ডনের আলতাব আলী পার্কস্থ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে অনন্তলোকের পথে যাত্রা শুরু করেন সিনিয়র এই সাংবাদিক। শহীদ মিনার চত্বরে তখন বিরাজ করছিলো এক বেদনাবিধূর পরিবেশ, প্রিয় মানুষের অন্তিম বিদায়ে তাঁর সতীর্থ  বিলেতের বাংলা মিডিয়ার সাংবাদিকদের অনেকেরই চোখ ছিলো ছলছল।

প্রয়াত অজয় পালের মরদেহ সামনে রেখে এসময় তাঁর সহকর্মী, বন্ধু ও অনুসারীদের কেউ কেউ স্মৃতিচারণ করেন কৃতি এই মানুষটির বর্নাঢ্য সাংবাদিক জীবন নিয়ে। সাংবাদিক আহাদ চৌধুরী বাবুর পরিচালনায় অনুষ্ঠিত এই শ্রদ্ধা জ্ঞাপন অনুষ্ঠানে অজয় পালের বর্নাঢ্য সাংবাদিক জীবন সম্পর্কে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ছড়াকার দিলু নাসের। এরপর একে একে স্মৃতিচারণ ও শ্রদ্ধা নিবেদন করেন লন্ডন বাংলাদেশ হাই কমিশনের প্রতিনিধি মিনিষ্টার প্রেস আশিকুন্নবী চৌধুরী, টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র এডভাইজার মোহাম্মদ জোবায়ের, টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের আর্ট এন্ড কালচারাল লীড মেম্বার কাউন্সিলার ইকবাল হোসেন, কমনওয়েলথ জার্নালিষ্ট এসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নাহাস পাশা, লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি নবাব উদ্দিন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ আব্দুস সাত্তার, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির যুক্তরাজ্য সভাপতি ও সত্যবাণী সম্পাদক সৈয়দ আনাস পাশা, লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের সহসভাপতি রহমত আলী, ইউকে বাংলা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি মতিয়ার চৌধুরী, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার কমিটির পক্ষে আলতাফুর রহমান মোজাহিদ, লেবার পার্টির কাউন্সিলার আব্দাল উল্লা এবং অজয় পাল পুত্র দিপায়ন পাল।

এর আগে প্রয়াত অজয় পালের মরদেহ শহীদ মিনারে নিয়ে এলে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের লক্ষ্যে গঠিত নাগরিক কমিটির পক্ষে মরদেহ গ্রহন করেন, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য, সাংবাদিক আনসার আহমেদ উল্লাহ, সঙ্গীত শিল্পী হিমাংশু গুস্বামী, সংগীত শিল্পী গৌরি চৌধুরী, সাংবাদিক আ স ম মাসুম, কামাল মেহদী, যুবনেতা জামাল খান, লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের কোষাধ্যক্ষ সালেহ আহমেদ, নির্বাহী সদস্য  আহাদ চৌধুরী বাবু, ইমরান আহমেদ,  সাংবাদিক বিশ্বজিৎ রায় অপু ও জুয়েল রাজ। এসময় নাগরিক কমিটির নেতৃবৃন্দের সাথে মরদেহের পাশে ভেজা চোখে নিরবে দাড়িয়েছিলেন প্রয়াত অজয় পালের পুত্র দিপায়ন পাল।

উল্লেখ্য,  ৭ জানুয়ারী, শনিবার রাত সাড়ে আটটার দিকে রয়েল লন্ডন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন একাত্তরের কলমযোদ্ধা, সিনিয়র সাংবাদিক, ছড়াকার ও গীতিকার শ্রী অজয় পাল। এর আগে ৪ঠা জানুয়ারী বুধবার ব্রেন স্ট্রোক করলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, দুই পুত্রসহ আত্মীয়স্বজন ও অগনন গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে সদ্য কৈশোর পেরোনো অজয় পাল উত্তাল উপকূল থেকে প্রথম রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন প্রাচীনতম সংবাদপত্র যুগভেরীতে। ফুঁসে ওঠা সমুদ্র থেকে সাংবাদিকতার হাতেখড়ি নিয়েছিলেন বলেই বুঝি পথপরিক্রমায় প্রবল জোয়ার ভাটার সাক্ষী হয়ে আছেন। পাঁচ দশকের অধিক সাংবাদিকতা জীবন তাই বিরল সব অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ, কর্মে বর্ণাঢ্য আর বিপুল প্রাপ্তির মনিমুক্তো ছড়ানো। এসব প্রাপ্তি আর গৌরবের খতিয়ানে সবচেয়ে বেশি ঝলমলে অধ্যায় মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের আগরতলা থেকে প্রকাশিত দৈনিক জাগরণ-এ কাজ করার অভিজ্ঞতা। অজয় পাল আক্ষরিক অর্থেই একাত্তরের কলম সৈনিক।
সত্তর ও আশির দশকে যে সব মেধাবী সাংবাদিক সংবাদ পরিবেশনে সনাতনী গুরুগম্ভীর অবয়ব ভেঙে নতুন একটি ধারার সূচনা করেন তাঁদেরই একজন অজয় পাল। যাদের সংবাদের ভাষা প্রাঞ্জল, বিষয় বৈচিত্র্যপূর্ণ। যাদের হাত ধরে বদলে যায় রিপোর্টিংয়ের গৎবাঁধা উপস্থাপন এবং ছকবাঁধা বর্ণনা।
এ কথা বলা অতিশয়োক্তি হবে না যে, বাংলা সাংবাদিকতায় আধুনিকতায় অজয় পালেরও রয়েছে বিশেষ অবদান। বাংলাদেশের সংবাদপত্রের যুগ বদলের ধারায় বৃহত্তর সিলেটকে সংযুক্ত করার কৃতিত্ব তাঁর অবশ্যই প্রাপ্য। এই যে কৃতিত্ব এটি নিশ্চিতে কৈশোর, তারুণ্য‌, যৌবন এবং পরিণত বয়সের অধিকাংশ সময় তিনি কাটিয়েছেন পরিপূর্ণ সংবাদ পরিমণ্ডলে। কাজ করেছেন বাংলাদেশ, যুক্তরাজ্য, কানাডার স্বনামধন্য সব সংবাদপত্রে। জাতীয় দৈনিকের মধ্যে বাংলার বাণী, দৈনিক সংবাদ, দেশবাংলা ও বাংলাবাজার পত্রিকা ছাড়াও সিলেটের স্থানীয় দৈনিক সিলেট বাণী পত্রিকায়ও কাজ করেন কিছুদিন। আর সাপ্তাহিকের মধ্যে যুগভেরী, সিলেট সমাচার, দেশবার্তা ও সিলেটধ্বনি পত্রিকায় কর্মরত ছিলেন বহুদিন।

শুরুর দিকে সুনামগঞ্জ থেকে প্রকাশিত সূর্যের দেশ পত্রিকায় কিছুদিন সিলেট প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেন। যুক্ত ছিলেন লন্ডন থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সুরমা, জাগরণ, পত্রিকা, দেশবার্তা, পূর্বদেশ ও কানাডা থেকে প্রকাশিত বাংলা নিউজ পত্রিকার সঙ্গে। ২০০৮ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত মাসিক মাসিক হৃদয়ে বাংলাদেশ ম্যাগাজিনের ছিলেন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক।
সাংবাদিক অজয় পাল মানেই ঘটনার গভীরে প্রবেশ, সংবাদের ভেতরে জীবনের অনুসন্ধান। আর এ কারণে একাধিকবার বাংলাবাজার পত্রিকা তাঁকে দেশসেরা সাংবাদিক হিসেবে নির্বাচিত করে। সাংবাদিকতার সুবাদে ২০০১ সালে অজয় দা কিউবার হাভানায় অনুষ্ঠিত ইন্টার–পার্লামেন্টারি কনভেনশনে বাংলাদেশ সংসদীয় দলের সঙ্গে সাংবাদিক প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি ছড়াসাহিত্যেও অজয় পাল অনন্য, অনবদ্য। শব্দে-বাক্যে টানতে জানেন চমৎকার অন্তমিল। এ কারণেই গান রচনায়ও তিনি ছিলেন বেশ সাবলীল। তাঁর লেখা গানে কণ্ঠ দিয়েছেন সুবীর নন্দী, হিমাংশু গোস্বামীর মতো খ্যাতনামা শিল্পীরা।

You might also like