সিলেটে ত্রাণের জন্য হাহাকার

চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী

সিলেট থেকেঃ এখনো পর্যাপ্ত ত্রাণ পাচ্ছে না বন্যার্তরা। এক সপ্তাহ ধরে অনেকেই শুকনো খাবার খেয়ে আছেন। কেউ ত্রাণ নিয়ে গেলে ভিড় করছেন বানভাসী মানুষ। একমুঠো ত্রাণের আশায় চলছে হুড়োহুড়িও। আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা লোকজনও এক বেলা খেয়ে অনিশ্চিত জীবন কাটাচ্ছে। বন্যার পানি না কমায় এখনো কয়েকশ’ পরিবার বসবাস করছে দুর্গম এলাকাগুলোতে। ত্রাণের জন্য হাহাকার চলছে। বন্যার্তরা পর্যাপ্ত ত্রাণ পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করছেন। কিন্তু প্রশাসন বলছে; ত্রাণের সংকট নেই। যা চাওয়া হচ্ছে সবই দেয়া হচ্ছে।সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম রওশন এরশাদের পক্ষে জৈন্তাপুর এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করছেন ছাত্র সমাজের সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মুজিবুর রহমান ডালিম। তিনি অভিযোগ করেছেন, পর্যাপ্ত ত্রাণ পাচ্ছেন না বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষ। জৈন্তাপুরের ছাতাইরখা হাওরের তীরবর্তী গ্রাম, সেনগ্রাম, পূর্ব গর্দনা, পশ্চিম গর্দনার মানুষকে তার দলের পক্ষ থেকে গতকাল শুকনো খাবার দেয়া হয়েছে। চারদিন ধরে এলাকার মানুষ অভুক্ত রয়েছে।

ব্যক্তিপর্যায়ে ত্রাণ হিসেবে শুকনো খাবার দেয়া হলেও সরকারি পর্যায়ে এলাকার মানুষ ত্রাণ পাননি বলে তার কাছে অভিযোগ করা হয়েছে। বন্যাকবলিত দরবস্ত ইউপি’র মেম্বার বশির আহমদ জানিয়েছেন, তার ওয়ার্ডের চারলাইন, খরগ্রাম এলাকা বেশি বন্যা কবলিত। এলাকায় অনেক শ্রমিকের বসবাস। ত্রাণ না পাওয়ায় তিনদিন লঙ্গরখানা খুলে তারা খাবার বিতরণ করেছেন। লঙ্গরখানায়ও টান পড়েছে। গত দু’দিন ধরে লঙ্গরখানাও বন্ধ। কিন্তু এখনো পর্যাপ্ত ত্রাণ পাননি এলাকার মানুষ। একই অবস্থায় রয়েছে পাত্তন, মোটাগঞ্জ, শুকনপুর, হরহরা গ্রামের বাসিন্দারা। এসব গ্রামের মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় বাড়িতেই রয়েছে। যারা আশ্রয়কেন্দ্রে গেছে তারাও পড়েছেন ত্রাণ সংকটে।তবে জৈন্তাপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কামাল আহমদ জানিয়েছেন ‘আমরা ত্রাণ দিচ্ছি। পর্যায়ক্রমে দেয়া হচ্ছে। সবাই যাতে ত্রাণ পায় সে কারণে তালিকা করে দেয়া হচ্ছে।’ কোম্পানীগঞ্জে ত্রাণের জন্য হাহাকার চলছে। গত শনিবার প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ ফিরে আসার পর কোম্পানীগঞ্জ সদরে ত্রাণ নিয়ে টানাটানির ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনার পরও এলাকার মানুষ পর্যাপ্ত ত্রাণ পায়নি বলে অভিযোগ করা হয়েছে।তেলিখাল ইউপির বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, আমাদের কাছে কেউ আসেনি। তার এলাকার মানুষ অনাহারে, অর্ধাহারে বসবাস করছে বলে জানান তিনি।’ তবে- কোম্পানীগঞ্জের উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাদের এলাকায় ত্রাণের সংকট নেই। পর্যাপ্ত ত্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। এদিকে ত্রাণ নিয়ে ক্ষোভ চলছে সিলেট নগরীর কাউন্সিলরদের মধ্যে।

গত রোববার সিলেট সিটি করপোরেশনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান জানিয়েছেন, নগরের ১২টি ওয়ার্ডের বেশিরভাগ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এখন পর্যন্ত নগর কর্তৃপক্ষকে সরকার থেকে ১৩ টন চাল দেয়া হয়েছে। এর বাইরে আরো দুই লাখ টাকা নগদ বরাদ্দ এসেছে। এ চাল একদিনের বরাদ্দও নয়। এরপরও সিটি করপোরেশনের তহবিল থেকে প্রতিদিনই খিচুড়ি ও শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। নগরের বন্যার্তদের জন্য আরও পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানো প্রয়োজন বলে জানান তিনি।সিলেট নগরের কানিশাইলসহ কয়েকটি এলাকার বন্যার্ত লোকজন জানিয়েছেন, শুকনো খাবার খেয়ে তো বেশিদিন থাকা যায় না। অথচ ৪/৫ দিন ধরে এক বেলা আধপেটা খেয়ে অনেকেই আছেন। এতে করে অসুস্থতার হারও বাড়ছে। সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর তৌফিক বক্স লিপন জানিয়েছেন, ‘যে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে তা পর্যাপ্ত নয়। বন্যার্তদের ত্রাণ দেয়ার জন্য আমরা ইতোমধ্যে মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে আবেদন জানিয়েছি।’ জানান ‘গতকাল পর্যন্ত বন্যার্তদের মধ্যে শুকনো খাবার ও খিচুড়ি বিতরণ করা হয়েছে। কিছু কিছু এলাকায় ত্রাণের চাল বিতরণ করা হয়েছে।এদিকে, সিলেট নগর ও আশপাশ এলাকার বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হলেও নতুন করে গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগর এলাকার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত রয়েছে। এসব এলাকায়ও খাবার সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। স্থানীয়ভাবে তাদের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। বিশ্বনাথেও বন্যা পরিস্থিতির অবনতি রয়েছে। ওই এলাকায় সরকারিভাবে যে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম বলে জানিয়েছেন বন্যা আক্রান্ত এলাকার লোকজন।

গতকাল দুপুরে বিশ্বনাথের বন্যা কবলিত অলংকারী, কামালপুরসহ কয়েকটি গ্রাম পরিদর্শন করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী। তিনি এ সময় তার ব্যক্তিগত পক্ষ থেকে বন্যার্ত লোকজনের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ করেছেন। তবে- এলাকায় স্থানীয় এমপি মোকাব্বির খান নেই বলে অভিযোগ করেছেন বিশ্বনাথের মানুষ।তাদের দাবি, ত্রাণের চাল কোথায় আসছে, কে আনছে, কারা নিচ্ছে কিছুই তারা জানেন না। এদিকে, ওই ৬টি উপজেলায় কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় জীবন যাপন করছে। তারা শুকনো খাবার খেয়ে দিন যাপন করছেন বলে জানিয়েছেন ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিরা। সিলেট জেলা দুর্যোগ ও ত্রাণ কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম জানিয়েছেন, সিলেট জেলায় প্রায় ১২/১৩ লাখ মানুষ বন্যায় কবলিত হয়েছেন। বন্যার্তদের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণ রয়েছে জেলা প্রশাসনের হাতে।যে উপজেলায় ত্রাণের জন্য যত চাহিদা দেয়া হচ্ছে; ততই দেয়া হচ্ছে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মজিবর রহমান যখন ঢাকায় যে চাহিদা করছেন, সবই দেয়া হচ্ছে। তিনি জানান, ইতিমধ্যে ৩৪৫ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। তাদের কাছে এখনো মজুত আছে ২৪৪ টন চাল। এ ছাড়া বরাদ্দ পাওয়া ২৫ লাখ টাকার মধ্যে ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। শুকনো খাবার মজুত আছে প্রায় ৬ হাজার প্যাকেট। তিনি দাবি করেন ত্রাণের সংকট নেই। চাহিদা অনুযায়ী ত্রাণ দেয়া হচ্ছে।
বিএনপির অভিযোগ
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় সিলেটের জনজীবন বিপর্যস্ত হলেও এ নিয়ে সরকারের কোনো মাথা ব্যথা নেই। সিলেট জেলা বিএনপি’র সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী জানান, তারা বন্যার্ত মানুষকে ত্রাণ না দিয়ে উল্টো পুলিশ দিয়ে লাঠিপেটা করেছে। এই সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়, তাই জনগণের প্রতি তাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। ফ্যাসিস্ট সরকারের সীমাহীন জুলুম নিপীড়ন উপেক্ষা করে বিএনপি আর্তমানবতার কল্যাণে পাশে রয়েছে।তিনি গত রোববার সিলেট জেলা বিএনপি’র উদ্যোগে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পূর্ব ইসলামপুর, পশ্চিম ইসলামপুর, উত্তর রণিখাইসহ ৬টি ইউনিয়নের বন্যা কবলিত এলাকায় খাদ্যসামগ্রী বিতরণকালে প্রধান অতিথির বক্তব্যে একথা বলেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন, সিলেট জেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট এমরান আহমদ চৌধুরী।এ সময় জেলা বিএনপি’র নেতৃবৃন্দ ছাড়াও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সকল পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে এডভোকেট এমরান আহমদ চৌধুরী বলেন, যে কোম্পানীগঞ্জে ত্রাণ না দিয়ে উল্টো বন্যার্ত অসহায় মানুষের ওপর নির্বিচারে লাঠিচার্জ করা হয়েছে। সেই কোম্পানীগঞ্জে বিএনপি’র পক্ষ থেকে হাজারের বেশি পরিবারের মাঝে সুশৃঙ্খলভাবে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে।এ সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জেলা বিএনপি’র সাবেক সহ-সভাপতি মামুনুর রশিদ মামুন, জেলা বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমদ, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা সভাপতি হাজী শাহাব উদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর, জেলা বিএনপি নেতা কামরুল হাসান শাহীন, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা সহ-সভাপতি হাজী আব্দুল মনাফ, সহ-সভাপতি হাজী উমর আলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের, ডা. নুরুল আমীন, শুক্কুর আলী, বিএনপি নেতা এডভোকেট বুরহান উদ্দিন খন্দকার ফরহাদ প্রমুখ।

You might also like