সিলেটে বন্যা:ছাতক-সিলেট রেলপথে সংস্কার কাজ শুরু
চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী
সিলেট থেকেঃ স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ছাতক-সিলেট রেলপথের সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে। বানের পানির তীব্র স্রোতে সিলেট-ছাতক ৩৪ কিলোমিটার রেললাইনের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ছাতক থেকে গোবিন্দগঞ্জ অর্থাৎ আফজলাবাদ স্টেশন পর্যন্ত প্রায় ১৩ কিলোমিটার রেলপথ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রেলপথের এই অংশ প্রায় লন্ডভন্ড হয়ে যায়। অধিকাংশ স্থানে রেলপথের মাটি-পাথর সরে ঝুলে রয়েছে স্লিপার।করোনা মহামারির সময়ে এই রুটে রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ে। সম্পুর্ণ চালু অবস্থায় সিলেট-ছাতক রেলপথে রেল যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। বন্যার আগপর্যন্ত এই রেলপথে আর রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়নি। এরমধ্যে বন্যায় রেলপথের অধিকাংশ স্থান ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে এই রেলপথে যাতায়াতকারি ৩ উপজেলার কয়েক লাখ মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বর্তমানে কর্তৃপক্ষ সিলেট-ছাতক রেলপথের সংস্কার কাজ শুরু করেছে। একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এই কাজটি করে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন এই রেলপথে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার পর বন্যা পরবর্তীতে রেলপথ সংস্কারের কাজ শুরু হলে জনমনে অনেকটা আশার আলো দেখা দিয়েছে। দীর্ঘদিন পর হলেও এই রেলপথ সংস্কার করে আবারো রেল যোগাযোগ স্থাপিত হবে।
১৯৫৪ সালে সিলেট রেলওয়ে স্টেশন হতে বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক বাজার রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত ৩৪ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হয়। ওই সময়ে এই রেলপথের সর্বশেষ স্টেশন হিসেবে ছাতক বাজার রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণ করা হয়ে। আগে এটি ছিলো আখাউড়া-কুলাউড়া-সিলেট পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাথর, বালু, চুনাপাথর, কমলালেবু ও তেজপাতাসহ বিভিন্ন মালামাল আনা-নেয়ার জন্যই মুলত রেলপথটি নির্মিত হয়েছিলো। পরে এখানের কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল পরিবহন, ছাতক-দোয়ারাবাজার অঞ্চলসহ সুনামগঞ্জ জেলার মানুষের যাতায়াত সুবিধার ব্যাপক উন্নতি হয় রেলপথের মাধ্যমে। এই অঞ্চলের মানুষের সে সময় থেকেই ছিলো একমাত্র ভরসা রেলপথ। শুরু থেকেই রেল বিভাগের রাজস্ব আয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে সিলেট-ছাতক রেলপথটি। ১৯৭৯ সালে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের রাজস্ব আয়ে ছাতক বাজার স্টেশন শ্রেষ্ঠত্বের স্থান দখলে করে নেয়।আগে প্রতিদিনই এই রেলপথে ৩টি ট্রেন যাতায়াত করতো। মাঝে নানা অজুহাতে কমিয়ে দেয়া হয় ট্রেন ও ট্রেনের বগি সংখ্যা। ট্রেনে করে প্রায় ৪৫ মিনিটে ছাতক থেকে সিলেট পৌঁছানো সম্ভব। সিলেট-ছাতক রেলপথের ট্রেন পথিমধ্যে খাজাঞ্চীগাঁও, সৎপুর ও আফজালাবাদ স্টেশনে যাত্রা বিরতি করে। ছাতক অঞ্চল, দোয়ারাবাজার, সিলেটের সৎপুর ও খাজাঞ্চীগাঁও এলাকার হাজার- হাজার মানুষের সিলেট শহর ও দেশের অন্য অঞ্চলে যোগাযোগের মাধ্যমই ছিলো রেলপথ। শিল্প শহর ছাতক থেকে চুনাপাথর, সিমেন্ট, স্লিপার, বালু, বড় আকারের পাথরসহ বিভিন্ন মালামাল দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করতে সড়ক পথের চেয়ে এই রেলপথে পরিবহন খরচ অনেক কম। সিলেট থেকে ছাতক পর্যন্ত রেলপথের দুরত্ব ৩৪ কিলোমিটারের ভাড়া মাত্র ১২ টাকা। ট্রেনের ভাড়া ১২ টাকার বিপরীতে বাস ভাড়া বর্তমানে ৮০ টাকা ও সিএনজি অটোরিক্সা ভাড়া ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা।
সুনামগঞ্জ জেলার সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প ও সহায়তার চাল-গম ইত্যাদি এই রেলপথে পরিবহনেও অনেক সুবিধা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে রেলপথে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রি ছাতক নিয়ে নৌপথে জেলার অন্য উপজেলায় পৌছানো সহজ। এতে ট্রাক ভাড়ার চেয়ে প্রায় কয়েকগুণ সরকারি অর্থ সাশ্রয় হতো বলে জানা গেছে। রেলপথটি লাভজনক হওয়ার কারণে পাথর পরিবহনের জন্য দেশের একমাত্র ছাতক-ভোলাগঞ্জ রজ্জুপথ স্থাপন করে রেলওয়ে বিভাগ। এখানে স্থাপিত হয়েছে দেশের একমাত্র সরকারি কংক্রিট স্লিপার প্ল্যান্ট। দু’টি প্রকল্প এখন বন্ধ রয়েছে। ছাতকে রয়েছে রেলওয়ের ৩৫০ একর মুল্যবান ভুমি ও শতাধিক স্থাপনা। ভোলাগঞ্জেও রয়েছে রেলওয়ের বেশ কয়েকটি স্থাপনা ও শতাধিক একর ভুমি। সবই ঠিকঠাক শুধুমাত্র রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। গুরুত্বপুর্ণ এই রেলপথটি দ্রুত সংস্কার না হলে রেলওয়ের স্লিপারসহ বিভিন্ন সরঞ্জামাদি চুরি হয়ে যাবারও আশংকা রয়েছে। রেল যোগাযোগ না থাকায় অনেকে কর্মকর্তা-কর্মচারি কর্মস্থলে থাকেন না। ফলে রেলওয়ে স্টেশনসহ সরকারি কোটি-কোটি টাকা মুল্যের সম্পদ এখানে অরক্ষিত।রেলপথ সংস্কার কাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সুপারভাইজার আব্দুল মান্নান জানিয়েছেন, রেলপথের ব্রিজগুলোর কাজ করছেন তারা। লাইন মেরামতের কাজ এখনো শুরু হয়নি। ছাতক থেকে সিলেট পর্যন্ত রেললাইনে ছোট-বড় ব্রিজ রয়েছে ৩৮টি। এরমধ্যে ছাতক অংশে ১০টি ব্রিজ। ইতোমধ্যে রেলপথের ৩১টি ব্রিজের মেরামত কাজ সম্পন্ন হয়েছে।ছাতক রেলওয়ের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী (এইএন) জুবায়ের আহমদ জানান, ছাতক-সিলেট রেলপথের সংস্কার কাজ চলছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে রেলপথের সংস্কার কাজ সম্পন্ন করা হবে।
রেলওয়ে সিলেটের উপ-সহকারী প্রকৌশলী (কার্য) আব্দুন নুর গণমাধ্যমকে জানান, বন্যায় এই রেলপথের কোটি-কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। রেলপথ মেরামতের কাজ শুরু করা হয়েছে। এই রেলপথে ফের রেল যোগাযোগ চালু করা হবে।সিলেটের উর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী (পথ) মোহাম্মদ জুলহাস জানিয়েছেন, রেলপথের ৩৮টি ব্রিজের মধ্যে ৩১টি ব্রিজের মেরামত কাজ শেষ হয়েছে। ব্রিজের কাজ শেষ হলেই লাইন মেরামতের কাজ শুরু হবে। অনেক ক্ষতিগ্রস্ত রেলপথ সংস্কার করতে কিছু সময়ের প্রয়োজন।