সিলেট উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন হলেও কবে শুরু হচ্ছে কার্যক্রম?
চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী
সিলেট অফিসঃ সিলেট মহানগর ও সংলগ্ন এলাকার সমন্বয়ে একটি আধুনিক ও আকর্ষণীয় পর্যটন নগরি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে এই অঞ্চলের সু-পরিকল্পিত উন্নয়ন, ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রতিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা এবং পর্যটন অঞ্চলের অবকাঠামো ও স্থাপনাসমূহ টেকসই, দৃষ্টিনন্দন ও পর্যটনবান্ধব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশে ইতোমধ্যেই ‘সিলেট উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ গঠন করা হয়েছে। গত বছরের ২৬ অক্টোবর বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদের অধিবেশনে এই বিলটি পাশ হয়। তৎকালীন গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ জাতীয় সংসদে বিলটি পাসের প্রস্তাব করেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কণ্ঠভোটে এটি গৃহিত হয়।
এরআগে ২০২২ সালের ২২ আগস্ট সোমবার তৎকালীণ মন্ত্রীসভা ‘সিলেট উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন-২০২২’ এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় মন্ত্রীসভার সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে তৎকালীন গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ ‘সিলেট উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বিল-২৩’ উত্থাপন করেন। পরে প্রতিমন্ত্রীর প্রস্তাব অনুযায়ী স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বিলটি অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পরবর্তীতে ২০ দিনের মধ্যে রিপোর্ট প্রদানের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠিয়ে দেন। যাচাই-বাছাই শেষে ২০২৩ সালের ২৬ অক্টোবর বিলটি সংসদে গৃহিত এবং ২৩ নভেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশ হয়।
গেজেট প্রকাশের পর ‘সিলেট উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’-এর কার্যক্রম শুরু করার কথা থাকলেও কার্যতঃ অদ্যাবধি পর্যন্ত সরকারের নবগঠিত এই সংস্থার চেয়ারম্যানও নিয়োগ দেয়া হয়নি। নিয়োগ দেয়া হয়নি পর্যাপ্ত জনবল। অস্থায়ীভাবে হলেও স্থাপন করা হয়নি এর কার্যালয়। ফলে সিলেটকে আধুনিক ও আকর্ষণীয় পর্যটননগরি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে কারণে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়েছে, তাও বাস্তবায়িত হচ্ছে না। অফিস ও জনবল না থাকায় পর্যটননগরি সিলেটকে নিয়ে কোন মহাপরিকল্পনাও প্রণয়ন করা সম্ভব হচ্ছে না।
কোন কোন মহল থেকে বলা হচ্ছে, ‘নিজেদের ক্ষমতা খর্ব হবে’-এ আশংকায় জেলা প্রশাসন ও সিটি কর্পোরেশন থেকে সিলেট উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং এর কার্যালয় স্থাপনে পর্যাপ্ত সহযোগিতা করা হচ্ছে না। এ কারণে শুরুতেই সরকারের কাঙ্খিত চাওয়া আধুনিক ও আকর্ষণীয় পর্যটননগরি সিলেট গঠন ব্যহত হচ্ছে। অননুমোদিত ও নকশাবহির্ভূতভাবে যত্রতত্র বহুতল ভবন নির্মিত হচ্ছে। এসব অনিয়ম নজরদারির মতো কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ, প্রতিবেশ এবং বিঘ্নিত হচ্ছে সরকারের উন্নয়ন প্রত্যাশা। পাশাপাশি নানাভাবে বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সিলেটবাসী।
অথচ মন্ত্রীসভায় ‘সিলেট উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন’ অনুমোদন হওয়ার পর ব্রিফিং-এ তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘সিলেট শহর বিশেষ করে এখন সিলেট শহর ও আশেপাশে বেশ কিছু খুবই অপরিকল্পিতভাবে অনেক বিল্ডিং বা বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ হচ্ছে। ফলে শহরের সৌন্দর্য ও যাতায়াত বা কনজেশনটা আনপ্ল্যানড্ হয়ে যাচ্ছে। সে জন্য সিলেট শহরকে পরিকল্পিত শহর হিসেবে গড়ে তুলতে এ আইনটির খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়েছে।’
নগরবিশেষজ্ঞ এডভোকেট সমর বিজয় সী শেখর সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, একটা সময়ে সিলেট শহর প্রচুর গাছপালা বৃক্ষরাজীবেষ্টিত ছিল। পাহাড়-টিলায় ভরপুর ছিল। এসব কেটে কোনো ধরণের পরিকল্পনা ছাড়াই ইচ্ছেমতো বাসাবাড়ি তৈরি করা হচ্ছে। একটি সুউচ্চ ভবন ঘেঁষে আরেকটি বহুতল ভবন তৈরি করা হচ্ছে। সেসব ভবনে যাওয়ার রাস্তাও একেবারেই সরু। মূলত, সিলেট শহর এখন অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে উঠছে। সিটি করপোরেশন যদি কঠোরভাবে বিষয়টি দেখভাল করত, তবে অপরিকল্পিত নগরায়ণের সুযোগ খুব একটা ছিল না। সম্প্রতি সিলেট নগরের আয়তন দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। বর্ধিত ওই এলাকায় যদি এখনই পরিকল্পনামাফিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করা না হয়, তবে পুরোনো নগরের এলাকার মতোই বর্ধিত এলাকার অবস্থাও একটা সময় এমনই হবে।
তিনি বলেন, শুধু তাই নয়। সামান্য বৃষ্টিতেই এখন সিলেট শহরে তীব্র জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। অথচ গত এক যুগে জলাবদ্ধতা নিরসন খাতে হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। সুরমা নদীর পাড়ে স্থানীয় লোকজন অবাধে ময়লা-আবর্জনা ফেলছে, বিভিন্ন রাস্তা নোংরা হয়ে দিনের পর দিন পড়ে থাকে। এছাড়া নগরের অসংখ্য এলাকায় পানির তীব্র সংকট আছে। এসব সমস্যায় নগরবাসী ধুঁকছে। সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ এসব সমস্যার বিষয় জেনেও কার্যকর উদ্যোগ খুব কমই গ্রহণ করছে।
এডভোকেট সমর বিজয় সী শেখর আরো বলেন, সিটি কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি সরকারি আরো অন্য কোন সংস্থার সাথে আলোচনার মাধ্যমে সমন্বিতভাবে এগোতে পারলে সিলেট নগরির অনেক নাগরিক সমস্যার সমাধান সহজেই করা যেতো।
এদিকে, সংসদে পাশ হওয়া ‘সিলেট উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন-এ’ বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি মহাপরিকল্পনায় চিহ্নিত বা উল্লিখিত উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে কোনো ভূমি ব্যবহার করেন, তাহলে তিনি অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন। অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইন কার্যকর হওয়ার পর, আওতাধীন এলাকার মধ্যে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোনো বহুতল ভবন নির্মাণ বা পুনঃনির্মাণ, পুকুর বা কৃত্রিম জলাধার খনন বা পুনঃখনন কিংবা চালা বা উঁচুভূমি অর্থাৎ পাহাড়-টিলা কাটা যাবে না। এই বিধান প্রথমবার লঙ্ঘন করলে অনধিক ২ বছরের কারাদন্ড বা অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদন্ড বা উভয়দন্ডে দন্ডিত হবেন। পরবর্তীতে প্রতিবার একই অপরাধের ক্ষেত্রে অন্যূন ২ বছর, অনধিক ১০ বছর কারাদন্ড বা অন্যূন ২ লাখ টাকা, অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয়দন্ডে দন্ডিত হবেন।
কর্তৃপক্ষের আওতাধীন এলাকায় কোনো বহুতল ভবন বা স্থাপনা নির্মাণ বা পুনঃনির্মাণ, পুকুর বা কৃত্রিম জলাধার খনন বা পুনঃখননের জন্য ফি’সহ ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মচারির কাছে আবেদন করতে হবে।
কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ পর্যটন সংরক্ষিত এলাকা ও বিশেষ পর্যটন অঞ্চল আইনের অধীনে ঘোষিত পর্যটন সংরক্ষিত এলাকায় পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ও বিকাশের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করে কোনো বহুতল ভবন বা স্থাপনা নির্মাণ বা কৃত্রিম জলাধার খননের অনুমতি প্রদান করতে পারবে।
আইনে বলা হয়েছে, কর্তৃপক্ষের আওতাধীন এলাকার অনুমোদিত নকশাবহির্ভূত স্থাপনা নির্মাণ করলে স্থাপনা নির্মাণকারী ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ অনধিক ২ বৎসর কারাদন্ড অথবা অনধিক ২০ লাখ টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয়দন্ডে দন্ডিত হবেন ।
আইনে আরো বলা হয়েছে, ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মচারি কোনো ইমারত নির্মাণ, জলাধার ভরাট বা জলাধার খননের অনুমতি প্রদান করলে তাকে ওই ইমারত বা নকশাসহ তার স্বাক্ষরিত অনুমতিপত্রের একটি অনুলিপি ইমারত বা জলাধার যে এলাকায় অবস্থিত সেই এলাকার মেয়র বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহীর কাছে পাঠাতে হবে।
পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ‘সিলেট উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’-এর কার্যক্রম শুরু হলে পরিকল্পিতভাবে সিলেটের উন্নয়ন কর্মকান্ডের সুচনা হতো এবং সুষ্টু পরিবেশগত অবস্থান সমুন্নত রেখে সুদৃশ্য, পর্যটন আকর্ষণীয় নগর গড়া সম্ভব হতো।
সিলেটের বিদ্বগ্ধজনেরা মনে করেন, অবিলম্বে ‘সিলেট উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-এর চেয়ারম্যান, আইন অনুযায়ী জনবল নিয়োগ এবং সংস্থার একটি স্থায়ী কার্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে নগরবাসীর কাঙ্খিত চাওয়া-পাওয়াকে বাস্তবে রূপ দিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বলিষ্ট পদক্ষেপ নেবে।