সিলেট নগরেই হাঁটু সমান পানি, প্লাবিত হচ্ছে নতুন এলাকা
নিউজ ডেস্ক
সত্যবাণী
সিলেট: ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেট নগরসহ পুরো জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। সুরমা নদী উপচে নগরেই হাঁটু সমান পানি হয়েছে। বাসাবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও পানি উঠছে। বন্যায় সিলেট জেলা ও মহানগরের প্রায় ১৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন।এসব মানুষের জন্য মোট ২১৫টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এরমধ্যে ১৯৯টি জেলা প্রশাসন ও ১৬টি আশ্রয়কেন্দ্র সিলেট সিটি করপোরেশন খুলেছে।সিলেট আবহাওয়া অধিদপ্তরে জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী বলেন, সিলেটে ও এর উজানে আগামী ২৩ জুন পর্যন্ত বৃষ্টি অব্যাহত থাকতে পারে। এ কারণে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।গত সোমবার (১৬ মে) দুপুর ১২টা থেকে সিলেট নগরের নিম্নাঞ্চলগুলোতে পানি প্রবেশ করতে শুরু করে। মঙ্গলবার নগরের প্রায় অর্ধেকেরও বেশি এলাকা পানির নিচে চলে গেছে। দ্রুত পানি বাড়ায় বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষজন।
বন্যার পানি বাড়া অব্যাহত থাকায় যত সময় যাচ্ছে ততই সিলেট নগরের নতুন নতুন এলাকার বাসাবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট তলিয়ে যাচ্ছে। সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র মরহুম বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের নগরের ছড়ারপারস্থ বাসভবনসহ নগরের প্রায় ৬০ ভাগ বাসাবাড়ি ও দোকানে বন্যার পানিতে হাঁটুজল দেখা দিয়েছে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন নগরবাসী।এ অবস্থায় মঙ্গলবার সিলেট সিটি করপোরেশন বন্যা দুর্গত নাগরিকদের জন্য ১৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছে। গঠন করেছে দুটি মেডিকেল টিম। সিলেট নগরেই প্রায় তিন লক্ষাধিক মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।নগর ঘুরে দেখা গেছে, লক্ষাধিক বাসাবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়েছে। নগরের ছড়ারপার, কলাপাড়া, ডহর, শামিমাবাদ আবাসিক এলাকা, গোটাটিকর, সাদাটিক, শাপরাণ, সিলেট সার্কিট হাউস-তালতলা ভিআইপি রোডের তালতলা, কালিঘাট, বেতবাজার, তেরতন, শাহজালাল উপশরসহ প্রায় ৬০টি এলাকার বিভিন্ন পাড়ামহল্লার রাস্তা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় দুর্ভোগে পড়েছেন নগরবাসী।
এছাড়া সিলেটের গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, জকিগঞ্জ ও সিলেট সদর, বিশ্বনাথ, বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর, বিয়ানীবাজার, ফেঞ্চুগঞ্জসহ পুরো জেলায় বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে।নগরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ওয়ার্ড হচ্ছে সিটি করপোরেশনের ১০ নম্বর ওয়ার্ড। এ ওয়ার্ডের মসজিদে মসজিদে মাইকিং করে পানি বাড়ার বিষয়টি বলা হচ্ছে। বাসার জিনিসপত্র নিরাপদে রেখে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বলা হচ্ছে।এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনের ১০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তারেক উদ্দিন তাজ বলেন, বন্যায় নগরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আমার ওয়ার্ডে। এখানকার প্রায় ৯৮ ভাগ এলাকাই এখন পানির নিচে। মসজিদে মাইকিং করে লোকজনকে বলা হচ্ছে নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার জন্য। এ ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের জন্য পাঁচটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।তিনি আরও বলেন, নগরবাসীর পাশে সিটি করপোরেশন রয়েছে। বন্যাদুর্গতদের আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠাতে মঙ্গলবার বৈঠক করে কাউন্সিলরদে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।সিলেট নগরের লালাদীঘির পাড় এলাকার বাসিন্দা আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ১৯৮৬ সালের পর এমন ভয়াবহ বন্যা দেখিনি। এবার মনে হয় ছিয়াশির বড় বন্যাকেও ছাড়িয়ে যাবে।
বিকেলে নগরের অভিজাত এলাকা শাহজালাল উপশহরে গিয়ে দেখা গেছে প্রধান সড়কে হাঁটুর ওপরে পানি। পানি ঢুকে পড়েছে আশপাশের দোকানপাট ও এলাকার বাসাবাড়িতেও। পানিতে সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে যান চলাচল।উপশহরের বি ব্লকের ব্যবসায়ী আজমল আলী বলেন, ‘দোকানের ভেতরে হাঁটুর ওপরে পানি। কাল রাতেও পানি ছিল না। সকালে এসে দেখি দোকানে পানি ঢুকে সব মালপত্র ভিজে গেছে।একই এলাকার বাসিন্দা রোম্মান আহমদ বলেন, ‘প্রতি মিনিটে পানি বাড়ছে। এত দ্রুত পানি বাড়তে আগে দেখিনি। আমাদের ঘরের নিচতলা তলিয়ে গেছে। আমরা দোতলায় আশ্রয় নিয়েছি।বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন সিলেটের সাধারণ সম্পাদক ও সিলেট নগরের বাসিন্দা আব্দুল করিম কিম জাগো নিউজকে বলেন, সুরমা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় ঢলের পানি ধারণ করতে পারছে না। ফলে নদী উপচে নগরে ঢুকছে বন্যার পানি।তিনি আরও বলেন, নদীতে বর্জ্য ফেলা বন্ধ করে জরুরি ভিত্তিতে নদী খনন করতে হবে। তা না হলে প্রতি বছরই এমন দুর্ভোগ পোহাতে হবে মানুষকে।সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিধায়ক রায় চৌধুরী বলেন, বন্যাকবলিতদের জন্য নগরে ১৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এছাড়া দুটি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। সিটি করপোরেশনের সবগুলো ওয়ার্ডে ১২৫০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়া বুধবার নগরের তিনটি এলাকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করবেন।
যেসব এলাকায় সিটি করপোরেশনের ১৬ আশ্রয়কেন্দ্র:
ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতিতে নগরের সাতটি ওয়ার্ডে ১৬টি আশ্রয়কেন্দ্র চালু করেছে সিটি করপোরেশন। এগুলো হলো- ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের মিরাবাজারস্থ কিশোরী মোহন বালক উচ্চবিদ্যালয়, ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের চালিবন্দর রামকৃঞ্চ উচ্চবিদ্যালয় ও চালিবন্দর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের মাছিমপুরস্থ আব্দুল হামিদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের বুরহান উদ্দীন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শাহজালাল উপশহরের তেররতন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
এছাড়া ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের মির্জাজাঙ্গালস্থ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, কাজিরবাজার স্কুল, মনিপুরি রাজবাড়ি আশ্রয়কেন্দ্র ও মাছুদিঘীর, ১০ নম্বর ওয়ার্ডের ঘাসিটুলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইউসেপ ঘাসিটুলা স্কুল, কানিশাইল স্কুল, জালালাবাদ স্কুল, বেতের বাজার কাউন্সিলরের চতুর্থ তলা বিল্ডিং এবং ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের হবিনন্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, সিলেটের উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে গত পাঁচ দিনে ১২৩৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। অবিরাম বৃষ্টি ঝরছে সিলেটেও। ফলে দ্রুত বাড়ছে নদনদীর পানি।
মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত সুরমা নদীর পানি অমলসীদ ও কানাইঘাট পয়েন্টে প্রায় ১৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আর সিলেট সদরে ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। পানির তোড়ে জেলার বিভিন্ন এলাকায় ইতোমধ্যেই ভেঙে গেছে ২০টি নদীরক্ষা বাঁধ। এ ছাড়া কুশিয়ারা, সারি ও গোয়াইন নদীর পানিও বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের উপ-সহকারী প্রকৌশলী নিলয় পাশা বলেন, ‘পানি এত বেশি আসছে যে আমাদের বাঁধগুলো উপচে পড়ছে। কিছু কিছু জায়গায় বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানি অতিরিক্ত থাকায় আমরা সংস্কারকাজও করতে পারছি না।সিলেট জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, জেলা প্রশাসনরে পক্ষ থেকে ১৯৯ টি আশ্রয়কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। এ পর্যন্ত সিলেট জেলায় পানিবন্দি রয়েছেন ১৩ থেকে ১৫ লাখ মানুষ। সোমবার রাতে ১৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৫০০ জন আশ্রয় নেন। মঙ্গলবার সকালে তারা চলে গেছে। এ পর্যন্ত আমরা ১২৯ টন চাল ও ১ হাজার বস্তা শুকনো খাবার দিয়েছি।সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, বন্যাকবলিত ১৯৯টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যাকবলিতদের প্রয়োজনীয় খাদ্য সহায়তাও দেওয়া হচ্ছে। আমি নিজেও বিভিন্ন বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করছি।