সিলেট পাসপোর্ট অফিসে শক্তিশালী সিন্ডিকেট সক্রিয়

চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী

সিলেট থেকেঃ প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেটের বাসিন্দারা প্রতিনিয়ত নানাভাবে বিদেশ যাচ্ছেন। ইমিগ্র্যান্ট, ভিজিট, স্টুডেন্টসহ বিভিন্ন পদ্ধতিতে এখান থেকে লোকজন অন্য দেশে যাওয়ার চেষ্টা করে। সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যে কর্মী ও ইউরোপ-আমেরিকায় স্টুডেন্ট ভিসায় শিক্ষার্থীদের যাওয়া বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই হিড়িক পড়েছে পাসপোর্ট তৈরির। এতে চাপ বেড়েছে পাসপোর্ট অফিসে। আর এই সুযোগে বেড়েছে চিহ্নিত দালালদের অবাধ দৌরাত্ম।পাসপোর্ট অফিসে আসা পাসপোর্ট গ্িরহতারা প্রতিদিন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। অফিস সুত্রে জানা গেছে, সিলেট পাসপোর্ট অফিসে প্রতিদিনই ৫ থেকে ৬ শ’ পাসপোর্টের ফাইল জমা হয়। জমা দেয়ার পর্ব থেকেই শুরু হয় ভোগান্তি। হিসাব বহির্ভূত বাড়তি টাকা ছাড়া কোন পাসপোর্ট জমা হয় না। অফিসের মধ্যেই রয়েছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে থাকে।

বর্তমানে রোহিঙ্গা ইস্যু হচ্ছে পাসপোর্ট গ্রহিতাদের কাবু করার একটি অন্যতম নতুন হাতিয়ার। আর শুরুতেই আবেদনকারীদের বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে রোহিঙ্গা শনাক্তকরণ ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়ে। নতুন হোক বা নবায়ন হোক, আবেদনকারী রোহিঙ্গা শরণার্থী কি-না সেটা প্রমাণ দিতে হচ্ছে ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে। এই ফিঙ্গার প্রিন্টের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে আবেদনকারীদের। অথচ অনেকের কাছেই রয়েছে এদেশের নাগরিকত্বের অকাট্য প্রমাণ। কেউ ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে ব্যবহার করে আসছে বাংলাদেশী পাসপোর্ট কিন্তু নবায়নে এসে তাকে আবারও প্রমাণ করতে হচ্ছে তিনি রোহিঙ্গা নন।সরকারি চাকরিজীবী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা কারোই রেহাই মিলছে না এই বিড়ম্বনা থেকে। রোহিঙ্গা সমস্যা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে ২০১৭ সালের শেষের দিকে। অথচ রোহিঙ্গা টেস্টের নামে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিকদের এ্যাডুকেশন সার্টিফিকেট ও পুরাতন পাসপোর্ট থাকা সত্ত্বেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোহিঙ্গা টেস্টের নামে লাইনে দাঁড় করিয়ে লোকজনকে হয়রানি করা হয়। কিন্তু একটু সচেতন হয়ে পাসপোর্ট নবায়নের আবেদনকারী ও স্মার্টকার্ডধারীদের এই প্রক্রিয়া থেকে বাদ দিলে ভোগান্তি অনেক কমত বলে মনে করছেন ভুক্তভোগীরা।

আবেদনপত্রে ছোটখাটো ভুলের জন্য কর্মকর্তারা ফিরিয়ে দেন নতুন পাসপোর্টের আবেদনকারীদের। পাসপোর্টে ভুল সংশোধন করতে গিয়েও মহাবিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে অনেককে। মাসের পর মাস পাসপোর্ট অফিসে ধর্ণা দিয়েও প্রতিকার পাওয়া যায় না। টেবিলে-টেবিলে ঘুরতে হচ্ছে তাদের। নানা ছুঁতোয় তাদের ঘোরাচ্ছেন কর্মকর্তারা। ফলে অসহায়ের মতো লোকজনকে ঘুরতে হচ্ছে পাসপোর্ট অফিসের দরোজায় দরোজায়। পাসপোর্ট অফিসে সক্রিয় রয়েছে শক্তিশালী দালাল সিন্ডিকেট। সহজে পাসপোর্ট পেতে হলে দালাল ধরার কোন বিকল্প নেই। নিজে ফরম পূরণ করে জমা দিল সামান্য ভুলের কারণে তা বাতিল করে দেয়া হয়। যা তাৎক্ষণিক সংশোধন করে দেয়া যায়। কিন্তু তা না করে নতুন করে আবার দাখিল করতে বলা হয়। পাসপোর্ট গ্রহিতা ভুলের ভয়ে বাধ্য হয়ে দালালের দ্বারস্থ হন। প্রতিটি ফাইলের জন্য দিতে হয় দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা। টাকা না দিলে বা দালালদের মাধ্যমে পাসপোর্টের ফাইল জমা না হলে, বিভিন্ন অজুহাতে ফাইল ফেরত দেয়া এবং লোকজনকে হয়রানি করা কর্মকর্তাদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দালালদের মাধ্যমে ফাইল জমা না দিলে, আসল জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মসনদ ও চেয়ারম্যানের নাগরিক সার্টিফিকেট থাকা সত্ত্বে বলা হয় নির্বাচন কমিশন কর্তৃক আইডি কার্ডের ভেরিফায়েড কপি লাগবে। প্রাইভেট সার্ভিস পেশার জন্য, পেশার কাগজপত্র লাগবে। সত্যায়ন সঠিক নয় এই অজুহাতে ফাইল ফেরত দেয়া হয়। সাম্প্রতিক সময়ে দালালদের দ্বারা গৃহিত ফাইল শনাক্ত করার জন্য এক ধরনের মার্কা পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো। সাংকেতিক চিহ্ন দিয়ে এই ফাইল শনাক্ত করা হতো। টাকার বিনিময়ে এই ফাইলের কাজ করা হয়ে থাকতো। এ নিয়ে ব্যাপকহারে লেখালেখি হলে মার্কা পদ্ধতি বাদ দিয়ে সত্যায়ন পদ্ধতি চালু হয়। সত্যায়নই মার্কা হিসেবে ব্যবহার করেন দূর্নীতিবাজরা। একেকজনের একেকটা সত্যায়নের সিল-স্বাক্ষর থাকে। তাছাড়া রয়েছে ই-মেইল পদ্ধতি। প্রতিটি ফাইলে রয়েছে একটি ই-মেইল। এই ই-মেইল দিয়ে শনাক্ত করা হয় কার কয়টি ফাইল।একই ই-মেইলে অনেক ফাইল থাকে।অন্য জেলার প্রচুর লোক সিলেটে বসবাস করেন। তাদের বর্তমান ঠিকানা সিলেটে এবং নিজ জেলায় স্থায়ী ঠিকানা দিয়ে পাসপোর্ট করতে চান। কিন্তু টাকা না দিলে নিজ জেলায় জমা দিতে হবে বলে ফাইল ফেরত দেয়া হয়। আবার টাকা দিলে সেই ফাইলই জমা নেয়া হয়।

এদিকে, প্রতিটি ফাইলে এবং ব্যাংক চালানের নিচে একটি গোপন চিহ্ন থাকে, যাকে পাসপোর্ট অফিসের ভাষায় মার্কা বলে। মার্কা হিসেবে বিভিন্ন সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। মার্কাযুক্ত ফাইলগুলো সরাসরি জমা নেয়া হয়। মার্কাযুক্ত ফাইলগুলো দ্রুত পুলিশ রিপোর্টে ও ঢাকায় পাঠানো হয়। মার্কা ব্যতীত ফাইলগুলো চলে মন্থর গতিতে। ৫/৬ মাসেও এই পাসপোর্টগুলোর অগ্রগতি হয় না ।এ জন্য অনেকের ভিসা পর্যন্ত বাতিল হয়ে যায়। অনেকে স্টুডেন্ট ভিসার জন্য আবেদন করতে না পারায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফাইল জমাকারী লোকজনের সঙ্গে অফিসের লোকজনের প্রায় প্রতিদিনই হাতাহাতি ও মারামারির ঘটনা ঘটে। লোকজনের চাপাচাপিতে কিছু ফাইল জমা করা হলেও মার্কাবিহীন ফাইলগুলো অপারেটররা নানাবিধ অজুহাতে ফেরত পাঠায়।এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চায় সিলেট বিভাগের লোকজন।উর্ধতন কর্তৃপক্ষ এ দূর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে বলিষ্ট পদক্ষেপ নেবেন কবে?