সুনামগঞ্জের টেংরাটিলা ট্রাজেডির ১৮ বছরে বন্ধ হয়নি গ্যাস উদগীরণ

চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী

সিলেট থেকেঃ সুনামগঞ্জের ছাতক গ্যাসক্ষেত্র টেংরাটিলায় দ্বিতীয় দফা বিস্ফোরণের ১৮ বছর পূর্ণ হয়েছে গত ২৪ জুন। ২০০৫ সালের ২৪ জুন এই গ্যাসক্ষেত্রে কুপ খননকালে দ্বিতীয়বারের মতো অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এরআগে প্রথম দফা অগ্নিকান্ড ঘটে একই বছরের ৭ জানুয়ারি। প্রতিবছরই ৭ জানুয়ারি ও ২৪ জুন তারিখে আঁতকে উঠেন টেংরাটিলা এলাকাবাসী। বিভীষিকাময় সেই ভয়াল স্মৃতি এখনো তাড়া করে তাদেরকে।ছাতক থেকে সংবাদদাতা জানান, ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি প্রথম দফা অগ্নিকান্ডের পর চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বের হতে থাকে গ্যাসের প্রবাহ। বাড়তে থাকে গ্যাসের চাপ।গ্যাসের এই প্রবাহ ও চাপ কমানোর উদ্দেশ্যে প্রথম বিস্ফোরণের স্থান থেকে ১০০ মিটার পশ্চিমে দ্বিতীয়বারের মতো রিলিফ কূপ খননের কাজ শুরু করে কানাডিয়ান তেল-গ্যাস কোম্পানি নাইকো।

১ জুন রাত থেকে এই কূপ খননের কাজ শুরু করা হয়। এ সময় রিলিফ কূপের চারপাশে ৭টি আউটলেট বসানো হয়। নতুন করে নিরাপত্তাজনিত কারণে গ্যাসক্ষেত্রের পার্শ্ববর্তী ৭৭ পরিবারকে নিরাপদ দূরত্বে স্থানান্তরিত করা হয়। খননকাজ চলাকালেই ২৪ জুন রাতে রিলিফ কূপে দ্বিতীয় দফা অগ্নি বিস্ফোরণ ঘটে। যে উদ্দেশ্যে খননকাজ পরিচালনা করা হয়েছিল তা সম্পূর্ণভাবে ভেস্তে যায়। গ্যাসের চাপ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। অল্প সময়েই ৭ আউটলেটের মধ্যে ৫টি বালি ও কাদায় বন্ধ হয়ে যায়। মূল রিগের চারপাশ দিয়ে প্রচন্ড বেগে গ্যাস বের হতে-হতে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এরপর আতংক ছড়িয়ে পড়ে টেংরাটিলা, টেংরাবাজার, গিরিশনগর, আজবপুর কইয়াজুরি গ্রামসহ পুরো এলাকা জুড়ে। গ্রাম ছেড়ে অনেকেই নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান।অভিযোগ রয়েছে, খনন কর্মকর্তাদের গাফিলতি ও নকশায় ত্রুটি থাকার কারণে এখানে দ্বিতীয়বার ব্লো-আউট হয়। গ্যাসের চাপের তীব্রতা বেড়ে গেলে উত্তোলনকারী কোম্পানী নাইকো দ্বিতীয় দফায়ও তা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। এরপরই অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। জানা যায়, তখন নিরাপত্তার কারণে ইচ্ছাকৃতভাবেই আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় দফা অগ্নিকান্ডে আগুন প্রায় ২৫০-৩০০ ফুট উপরে উঠানামা করে।

এদিকে, দুর্ঘটনার ১৮ বছরেও বন্ধ হয়নি টেংরাটিলার গ্যাসফিল্ডের গ্যাস উদগীরণ। দু’দফা অগ্নিকান্ডে পরিবেশ ও জনমানুষের যে ক্ষতি সাধিত হয়েছিল তা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি স্থানীয়রা। অন্যদিকে গ্যাসক্ষেত্রটি দীর্ঘ দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে অঘোষিত পরিত্যক্ত অবস্থায় অবহেলা-অযতেœ পড়ে থাকায় গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি ও মালামাল বিনষ্ট হচ্ছে।টেংরাটিলা গ্যাস ফিল্ড এলাকার বাসিন্দা সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ফয়েজুর রহমান বলেন, গ্যাসফিল্ড ট্রাজেডির সেই ভয়াবহ স্মৃতি এখনো আমাদেরকে তাড়া করে বেড়ায়। আমরা বিশ্বাস করি এখনো এখানে অনেক গ্যাস মজুদ রয়েছে। আইনি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর আবারো গ্যাসক্ষেত্রটি চালু হবে বলে তিনি আশাবাদী।স্থানীয় বাসিন্দা আবুল কাশেম ও আবুল হোসেন বলেন, এখনো গ্যাসক্ষেত্রের আশপাশে যেভাবে গ্যাস উদগীরণ হচ্ছে আমাদের ধারণা এখানে প্রাকৃতিক গ্যাসের ভান্ডার রয়েছে। গ্যাসক্ষেত্রটি দ্রুত পুনঃখনন করে এটি চালু করলে দেশে গ্যাসের চাহিদা অনেকটা মেটানো সম্ভব হবে। সুরমা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শাহজাহান মাস্টার বলেন, গ্যাসক্ষেত্রে দু’দফা বিষ্ফোরণের ফলে এলাকার লোকজন অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তারা কোন ক্ষতিপূরণ পায়নি। এখনো জমিতে ক্ষেত-খামার হচ্ছেনা। টিউবওয়েলে মাঝে-মধ্যে আগুন জ্বলে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গ্যাস কিছুর আগে মানুষ রান্নার কাজে ব্যবহার করেছে। এখন ভয়ে কেউ যত্রতত্র গ্যাস ব্যবহার করছেনা।দোয়ারাবাজারের সহকারী কমিশনার (ভুমি) ফয়সাল আহমেদ বলেন, গ্যাসক্ষেত্রের ব্যাপারে নতুন কোনো নির্দেশনা নেই। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওলজি বিভাগের ৩ জন অধ্যাপক ও শিক্ষার্থীদের একটি টিম এবং সরকারি আরো কয়েকটি টিম বিভিন্ন সময় টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রটি সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন।

২০০৩ সালে নাইকো-বাপেক্স’র যৌথ চুক্তির মাধ্যমে ছাতক টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলনের অনুমতি পায় নাইকো। ২০০৫ সালে কানাডিয়ান কোম্পানি নাইকো কুপ খনন কাজ শুরু করে ৭ জানুয়ারি বিষ্ফোরণ ঘটায়। রিলিফকুপ খনন করতে গিয়ে ২৪ জুন আবারো ভয়াবহ বিষ্ফোরণ ঘটে। এতে কোম্পানির রিগসহ যন্ত্রপাতি পুড়ে যায়। লাখ-লাখ ঘনফুট গ্যাস পুড়ে কুপের বিপুল পরিমাণ ক্ষতিসাধনসহ ক্ষতি হয় এলাকার বাসিন্দা ও ক্ষেতের জমির।তৎসময়ে বাপেক্সের ভু-তত্ত্ব বিভাগীয় প্রধান মিজানুর রহমান জানিয়েছিলেন মাটির উপরে ৩ বিসিক এবং ৫.৮৯ থেকে কমপক্ষে ৫২ বিসিক রিজার্ভ গ্যাস পুড়ে গেছে বিষ্ফোরণে।২০২০ সালের ৩মে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ছাতক টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্র বিষ্ফোরণের জন্য নাইকো দায়ী। তাদের অদক্ষতার কারণে এ গ্যাসক্ষেত্রে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এজন্য নাইকো’র বিরুদ্ধে ব্রিটেনের বিনিয়োগ বিরোধ নিষ্পত্তি সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতে (ইকসিড) মামলা হয়েছে। বাংলাদেশ ৮ হাজার কোটি টাকা ক্ষতিপুরণ পাবে এমন আদেশ দিয়েছেন ওই আন্তর্জাতিক আদালত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হয়েছে, তা আর জানা যায়নি।

You might also like