সুনামগঞ্জের বোরো ফসল রক্ষায় ৩২৭ কি.মি. নদী ড্রেজিং করতে চায় পাউবো
চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী
সিলেট থেকেঃ সুনামগঞ্জ জেলার ইরি-বোরো ফসল আগাম বন্যা থেকে রক্ষা করতে ৩২৭ কিলোমিটার নদী ড্রেজিং করতে চায় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। কেবল নদী ড্রেজিং-ই নয়; এ প্রকল্পের আওতায় নদীর তীর সংরক্ষণের মাধ্যমে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থারও উন্নয়ন করা হবে। প্রাথমিকভাবে এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৫৪৭ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। গেল তিন বছর ধরে প্রকল্পটি নিয়ে তোড়জোড় চললেও বর্তমানে সমীক্ষা যাচাইয়ের কাজ চলমান রয়েছে। পাউবো’র সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।সূত্র জানায়, এ প্রকল্পে ১৪ টি নদীতে ৩২৭ কিলোমিটার ড্রেজিংয়ে মোট ৭৫৯ কোটি ৪৩ লাখ ৪৫ হাজার টাকা ব্যয় করা হবে। বাকী টাকা নদী তীর সংরক্ষণ, স্থানীয় লোকজনের পুনর্বাসনসহ সংশ্লিষ্ট কাজে ব্যয় হবে।
১৪ নদীর মধ্যে শুধুমাত্র পুরাতন সুরমা নদীর ৫২ দশমিক ৫০ কিলোমিটার ড্রেজিংয়ে ব্যয় হবে ১৩৪ কোটি ৪০ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। এছাড়া, আপার বাউলাই-পাটনা নদীর ৪০ কিলোমিটার ড্রেজিংয়ে ১১০ কোটি ৬৭ লাখ ৮১ হাজার টাকা, ঘাসি নদীর ২১ দশমিক ৮০ কিলোমিটার ড্রেজিংয়ে ৬৬ কোটি ১২ লাখ ৬৪ হাজার টাকা, আবুয়া নদীর ২৭ দশমিক ৫০ কিলোমিটার ড্রেজিংয়ে ৬৪ কোটি ৪৩ লাখ ৫৫ হাজার টাকা, সোমেশ্বরী নদীর ৩১ দশমিক ৫০ কিলোমিটার ড্রেজিংয়ে ৯১ কোটি ৬৪ লাখ ৩৬ হাজার টাকা, কাউনাই নদীর ২৪ কিলোমিটার ড্রেজিংয়ে ৬৫ কোটি ৫৭ লাখ ৪৩ হাজার টাকা, জিরাক নদীর ১৬ দশমিক ৮০ কিলোমিটার ড্রেজিংয়ে ৪ কোটি ১৭ লাখ ৬ হাজার টাকা, রক্তি নদীর ৬ দশমিক ৫০ কিলোমিটার ড্রেজিংয়ে ১০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা, দারাইন নদীর ৩৫ কিলোমিটার ড্রেজিংয়ে ৯২ কোটি ৩৩ লাখ ২৮ হাজার টাকা, কালিগাং নদীর ১২ দশমিক ৫০ কিলোমিটার ড্রেজিংয়ে ৩৩ কোটি ১৪ লাখ ৮২ টাকা, ডাউকি নদীর ১৪ কিলোমিটার ড্রেজিংয়ে ৩১ কোটি ২৭ লাখ ৮ হাজার টাকা, নলজুর নদীর ৯ দশমিক ৫০ কিলোমিটার ড্রেজিংয়ে ১৭ কোটি ৪৫ লাখ ২২ হাজার টাকা, মহাসিন নদীর ২৯ কিলোমিটার ড্রেজিংয়ে ৩১ কোটি ৯৭ লাখ ২৮ হাজার টাকা, ভুতিয়ারপুর নদীর ৬ দশমিক ৫০ কিলোমিটার নদী ড্রেজিংয়ে ৫ কোটি ৮৫ লাখ ৫৪ হাজার টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। সুনামগঞ্জ জেলার এই ১৪ নদীতে সব মিলিয়ে ৩২৭ দশমিক ১০ কিলোমিটার ড্রেজিং করা হবে।
পাউবো সূত্র জানায়, ‘সুনামগঞ্জ জেলার হাওর অঞ্চলের নদী খনন ও নদী তীর সংরক্ষণের মাধ্যমে নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন ও আগাম বন্যা প্রতিরোধ’ শীর্ষক ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল (ডিপিপি) ২০২০ সালে গ্রহণ করা হয়। ওই বছরের ৯ মার্চ পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে প্রকল্পটির যাচাই সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রকল্পের আওতায় ভিলেজ প্ল্যাটফর্ম নির্মাণে স্থান নির্বাচনের জন্যে ওই বছরের ২২ জুন সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদেরকে পুনঃপত্র দেয়া হয়। বর্তমানে সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট এন্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) ও ইনস্টিটিউট অব মডেলিং ওয়াটার (আইডব্লিউএম) নামক পৃথক দু’টি প্রতিষ্ঠান প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা যাছাইয়ের কাজ করছে। সমীক্ষা যাচাইয়ের পর পরই প্রকল্পটি আবারও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সভায় উঠবে। মন্ত্রণালয়ের সভায় অনুমোদন পেলেই প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে প্রেরণ করা হবে। প্ল্যানিং কমিশনে কোনো ত্রুটি ধরা না পড়লে প্রকল্পটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্যে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)-এ উত্থাপনের জন্যে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত করে ড্রেজিং করা গেলে সুনামগঞ্জ জেলার ইরি*বোরো ফসল অসময়ে তলিয়ে যাওয়া বা আগাম বন্যা থেকে স্থায়ীভাবে রক্ষা পাবে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের সরাসরি তত্বাবধানে ড্রেজিং করারও মত দিয়েছেন তারা।
জানতে চাইলে পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাশমির রেজা বৈজ্ঞানিক উপায়ে নদী ড্রেজিংয়ের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, নদীর মাটি আবার নদীতে রাখলে হবে না, নদী থেকে দূরে ফেলতে হবে। অনেক জায়গায় দেখা যায়, নদীর ড্রেজিং করে নদীর মাটি নদীতেই রাখা হচ্ছে। ক্যাপিটাল ড্রেজিং এর আওতায় সুনামগঞ্জ থেকে আশুগঞ্জ পর্যন্ত ড্রেজিং করতে পারলে আমাদের ফসল আগাম বন্যা থেকে রক্ষা পাবে।
হাওর বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান এ প্রসঙ্গে বলেন, নদী ড্রেজিং করতে ২০১৭ সাল থেকে আমরা আন্দোলন করে আসছি। সম্প্রতি সুনামগঞ্জে অকাল বন্যার সময় পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক ১৪টি নদী ড্রেজিংয়ের ওপর জোর দিয়েছেন। আমাদের দাবীর মধ্যে থেকে কয়েকটি নদী বাদ পড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, কেবল সুনামগঞ্জের নদী ড্রেজিং করলেই হবে না; আশুগঞ্জ পর্যন্ত ড্রেজিং করতে হবে। উজানের পানি যাতে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই ভাটিতে চলে যেতে পারে। নদীগুলো ড্রেজিং করা হলে সুনামগঞ্জের ফসল আগাম বন্যা থেকে রক্ষা পাবে। প্রকল্পটি দ্রুত অনুমোদন দেয়া জরুরি। কারণ শুকনো মৌসুমে ড্রেজিং করা সম্ভব নয়। ড্রেজিং করতে হবে বর্ষায়। চলতি বর্ষায় যাতে নদীর ড্রেজিং কার্যক্রম শুরু করা হয়; এজন্যে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নদী ড্রেজিংয়ে যাতে কোনো ধরনের দুর্নীতি না হয়; সেদিকেও কঠোর নজরদারি রাখার তাগিদ দেন তিনি।
পাউবো’র সিলেট বিভাগের (উত্তর-পূর্বাঞ্চল) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এস. এম. শহিদুল ইসলাম জানান, সুনামগঞ্জের ১৪টি নদী ড্রেজিং করতে অনেক যাচাই-বাছাইয়ের পর ডিপিপি প্রস্তুত করা হয়। প্রকল্পটি নিয়ে মন্ত্রণালয়ে সভাও হয়েছিল। ডিপিপি সংশোধিত করার পরে আবারও সমীক্ষা চলছে। চলতি বছর প্রকল্পটি চূড়ান্ত অনুমোদন পেতে পারে। পাউবো’র মডেল অনুযায়ী ড্রেজিং করা হয়। নদীগুলো ড্রেজিং করা হলে সুনামগঞ্জের ফসল আগাম বন্যার ক্ষয়ক্ষতি থেকে মুক্ত থাকবে।প্রসঙ্গত, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে গেল ২ এপ্রিল থেকে শুরু করে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত বাঁধ ভেঙ্গে ও পানি উপচে সুনামগঞ্জ জেলার ছোট-বড় ৩১টি হাওর বন্যা কবলিত হয়। এতে প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমির ইরি-বোরো ফসল তলিয়ে যায়। এতে ১ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন ধান পুরোপুরি ক্ষতি হয়। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৩০০ কোটি টাকারও বেশি।