সুনামগঞ্জে সহকর্মীদের হয়রানির শিকার নারী পুলিশ

চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী

সিলেট থেকেঃ ‘কনস্টেবল অজয় বিশ্বাসের কথা অনুযায়ী আমি সামনের সিটে উঠে বসার পর সে গাড়ি স্টার্ট করে থানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে। থানায় আসার পথিমধ্যে অজয় আস্তে আস্তে ডান হাত দিয়া গাড়ি চালায় এবং বাম হাত দিয়ে আমার শরীরের বিভিন্ন স্থানে স্পর্শ করার চেষ্টা করে। আমি আপত্তি করলেও সে আমার হাতে, ঘাড়ে, পিঠেসহ বিভিন্ন স্থানে স্পর্শ করতে থাকে। আমাকে বলে আমি তো তোমার ব্যাচম্যাট, ভালো লাগেনানি। দেখি তোমার শরীর শক্ত না’।সুনামগঞ্জ সদর থানার এক নারী কনস্টেবল পুলিশ সুপার বরাবরে করা অভিযোগে এভাবেই কর্মক্ষেত্রে সহকর্মী কর্তৃক যৌন হয়রানির বর্ণনা দিয়েছেন।নিজ বাসা থেকে থানায় ডিউটিতে আসার পথে সহকর্মীর এমন যৌন হয়রানির শিকার হন ওই নারী কনস্টেবল। তদন্তে ঘটনার সত্যতাও পাওয়া যায়। এজন্যে অজয় বিশ্বাসের বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশও করা হয়েছে।

আরেক নারী কনস্টেবল সুনামগঞ্জ জেলা পুলিশ লাইনসের হাবিলদার মেজর মো. রাসেল কর্তৃক হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে পুলিশ সুপারের নিকট লিখিত অভিযোগ করেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।জানতে চাইলে সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ এহসান শাহ ১৭ মে বুধবার রাতে বলেন, অভিযুক্ত কনস্টেবলের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। অপরাধ করলে শাস্তি তো পেতেই হবে। পুলিশের অভ্যন্তরেও কেউ অন্যায়-অপরাধ করে পার পাবেনা। অপরাধীর কোনো ছাড় নেই।
সুনামগঞ্জ থেকে সংবাদদাতা জানান, ওই নারী কনস্টেবলকে গত ১৮ মার্চ রাত ২টা থেকে রাত ৪টা পর্যন্ত সুনামগঞ্জ সদর থানায় সেন্ট্রি ডিউটির দায়িত্ব দেয়া হয়। পনাতীর্থ ও শাহ আরেফিনের মাজারে আইনশৃংখলা ডিউটি উপলক্ষে অনেক ফোর্স সেখানে নিয়োজিত থাকায় এবং ওইরাতে থানায় একাধিক মহিলা আসামি অবস্থান করায় নারী কনস্টেবলদেরকে সেন্টি ডিউটি দেয়া হয়। ওই কনস্টেবল স্বামীর সাথে সুনামগঞ্জ জেলা কারাগারের কোয়ার্টারে থাকেন। তার স্বামী একজন কারারক্ষী। কনস্টেবল থানার মুন্সী কনস্টেবল ছাব্বিরকে তাকে কারাগারের কোয়ার্টার থেকে নেয়ার জন্যে ডিউটি গাড়ী পাঠানোর অনুরোধ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাত পৌনে ২টার দিকে কনস্টেবল অজয় বিশ্বাস নারী কনস্টেবলকে একা নিয়ে যেতে পিকআপ গাড়ি নিয়ে আসেন। নারী কনস্টেবল গেইটের বাইরে এসে উক্ত পিকআপের মাঝের দরজা খুলে উঠার সময় ড্রাইভার অজয় বলে ‘গাড়ির মাঝের সিটে স্যারদের মালামাল আছে। আমি তোমার ব্যাচমেট, সামনের সিটে উঠে বস’। তার কথা অনুযায়ী গাড়ির সামনের সিটে উঠার পর সে গাড়ি স্টার্ট করে থানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে। থানায় আসার পথে অজয় গাড়ী আস্তে আস্তে ডান হাত দিয়া চালায় এবং বাম হাত দিয়ে আমার শরীরের বিভিন্ন স্থানে স্পর্শ করার চেষ্টা করে যৌন হয়রানি চালায়।পরবর্তীতে থানার গেইটের সামনে আসার পর নারী কনস্টেবল নামিয়ে দিতে বললে সে বলে ‘রাগ করিসনা সরি’ বলে থানার ভেতরে এসে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যায়। ঘটনার শিকার নারী কনস্টেবল পুলিশ সুপারের নিকট করা অভিযোগে উপরোক্ত ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।

তিনি এও বলেন, কনস্টেবল অজয়কে ব্যাচমেট হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে চিনেন না। থানায় আসার পরপরই ডিউটি অফিসার এসআই মীর্জা মাহমুদুল করিম ও তার এক ব্যাচমেট নারী কনস্টেবলের নিকট ঘটনাটি জানান। ডিউটি শেষে বাসায় ফিরে কারারক্ষী স্বামীকে, পরবর্তীতে থানার মুন্সী ও ওসিকে মৌখিকভাবে ঘটনাটি জানিয়েছেন।পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে জগন্নাথপুর সার্কেলের পুলিশ পরিদর্শক শিবেন্দ্র চন্দ্র দাশকে ঘটনার তদন্ত করতে ১৯ মার্চ দায়িত্ব দেয়া হয়। তদন্ত শেষে পুলিশ সুপারের নিকট তিনি ৫ এপ্রিল ৮ পৃষ্ঠার দীর্ঘ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন।এতে সুনামগঞ্জ সদর থানার ওসি, দু’জন এসআই, ঘটনার শিকার নারী কনস্টেবল,অভিযুক্ত কনস্টেবল অজয় বিশ্বাসসহ ১৪ জনের বক্তব্য গ্রহণ করা হয়। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়।তদন্ত প্রতিবেদনে পর্যবেক্ষণের বলা হয়, সার্বিক অনুসন্ধান, একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী/অভিযোগকারী নারী কনস্টেবলের জবানবন্দি ও তার নিকট থেকে শোনা সাক্ষীদের জবানবন্দি পর্যালোচনায় এবং দালিলিক স্বাক্ষ্য পর্যালোচনায় অভিযুক্ত ক/৬৪৭ অজয় বিশ্বাস এর বিরুদ্ধে অভিযোগকারী নারী কনস্টেবলের হাতে, ঘাড়ে ও পিঠেসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে স্পর্শ করার ঘটনা প্রাথমিকভাবে সত্য বলে প্রমাণিত হওয়ায় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের স্বপক্ষে মতামত ব্যক্ত করে অত্র অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করা হলো। পাশাপাশি ভবিষ্যতে এ ধরণের অনাকাঙ্খিত ঘটনা বা অনাকাঙ্খিত ঘটনার অভিযোগ এড়ানোর জন্য নারী কনস্টেবলদের তাদের বাসা বাড়ি থেকে একাকী না আনার জন্য অত্র জেলার সকল ইউনিটে নির্দেশনা প্রদান করা যেতে পারে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কনস্টেবল অজয় বিশ্বাস ঘটনাটি বানোয়াট বলে দাবি করেন। ১৭ মে বুধবার দুপুরে তিনি বলেন, আমি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছি। মেয়েটি আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। এ রকম কোনো ঘটনা আমি ঘটাইনি। রাতের বেলা থানার ডিউটি থেকে বাঁচার জন্যে মেয়েটি ঘটনাটি সাজিয়েছে বলে তার দাবী। বর্তমানে জেলা পুলিশ লাইন্সে তিনি আছেন বলেও জানিয়েছেন।এদিকে, আরেক নারী কনস্টেবল সুনামগঞ্জ পুলিশ লাইনের হাবিলদার মেজর মো. রাসেল কর্তৃক হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে গত ১ মে পুলিশ সুপারের নিকট লিখিত অভিযোগ করেন। এতে বলা হয়, একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ওই নারী কনস্টেবলসহ দু’জনকে ৩ দিনের পিডি প্রদান করা হয়। ২৯ এপ্রিল পুলিশ লাইন্সে হাজির হয়ে ওই নারী কনস্টেবল হাবিলদার মেজর রাসেলের নিকট রিপোর্ট করেন। যেহেতু একই ঘটনা সংক্রান্তে দু’জনকে পিডি দেয়া হয়েছে তাই একই সময়ে একই স্থানে পিডি না খাটানোর জন্য অনুরোধ করলে হাবিলদার মেজর (এএসআই) রাসেল নারী কনস্টেবলের মা-বাবা তুলে গালিগালাজ করেন। হাত দিয়ে অশ্লীল অঙ্গ-ভঙ্গি করেন। এতে ওই নারী কনস্টেবল মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে ব্যারাকে গিয়ে কান্নাকাটি করেন। ইতোপূর্বেও হাবিলদার মেজর রাসেল ওই নারী কনস্টেবলকে উত্যক্তও করেছেন। আরেক নারী কনস্টেবলের নামে কুৎসা রটনা করেন। তার এ সকল ঘটনার প্রতিবাদ করলে সমানভাবে ডিউটি বন্টন না করে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ওই নারী কনস্টেবলসহ আরও নারী কনস্টেবলদেরকে ইচ্ছাকৃতভাবে অতিরিক্ত ডিউটি বন্টন করে দিতেন। এমনকি ওই নারী কনস্টেবলকে ডিউটি পোস্টে এবং লাইনে অবস্থানকালে একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়াদি নিয়ে বিব্রতকর নানা প্রশ্ন করেন।অভিযোগে নারী কনস্টেবল উল্লেখ করেন, ‘আমি বাংলাদেশ পুলিশের একজন নারী সদস্য। হাবিলদার মেজর মো. রাসেল স্যার এর মতো সদস্যদের কারণে কর্মক্ষেত্রে নারী পুলিশ সদস্যদের দায়িত্ব পালনে প্রচুর সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এরূপ অফিসারদের গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখলে নারী সদস্যদের কর্মের পরিবেশ নষ্ট হয়’। অভিযোগটি বর্তমানে তদন্তাধীন আছে বলে জানা গেছে।অপর অভিযুক্ত হাবিলদার মেজর মো. রাসেলের সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে তার সেলফোনে বুধবার দুপুরে ও সন্ধ্যায় কয়েক দফা কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।

You might also like