সেজানের পোড়া কারখানা থেকে বের হলো ৫২ মরদেহ
নিউজ ডেস্ক
সত্যবাণী
নারায়ণগঞ্জ রূপগঞ্জে: নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের জুসের কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৫২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। শুক্রবার (৯ জুলাই) বিকাল ৩ টার দিকে হাসেম ফুড কারখানাটির চতুর্থ তলা থেকে এ লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা।ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক অপারেশন অফিসার জিল্লুর রহমান লাশ উদ্ধারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এর আগে গত বৃহস্পতিবার বিকালে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দুই নারী স্বপ্না রানী ও মিনা আক্তার নিহত হন। পরে রাত ১১ টার দিকে মোরসালিন (২৮) নামে আরও এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। অগ্নিকাণ্ডের এ ঘটনায় অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছেন। এর রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ৬ তলা ভবনটির মধ্যে চতুর্থ তলা পর্যন্ত আগুন নির্বাপণ সম্পন্ন হয়েছে। পঞ্চম তলা ও ষষ্ঠ তলার আগুন নির্বাপণের কাজ চলছে।
নিহতদের স্বজনরা কারখানার চারপাশে ভিড় জমিয়েছেন। স্বজনদের আহাজারিতে কারখানার আশপাশের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে।এদিকে, আগুন নেভাতে দেরি হওয়ায় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা বিক্ষোভ মিছিল ও ভাংচুর চালায় আশপাশের এলাকায়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা হাসেম ফুডের আনসার ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে আনসারদের মারধর করে। অস্ত্রাগার থেকে চারটি শটগান লুট করে নিয়ে যায় বলে জানান উপজেলা আনসারদের ইনচার্জ নাছিমা বেগম।স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, উপজেলার কর্ণগোপ এলাকায় অবস্থিত সজীব গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড লিমিটেড কারখানায় প্রায় ৭ হাজার শ্রমিক কর্মচারী কাজ করে। ছয় তলা ভবনে থাকা কারখানাটির নিচ তলায় কার্টুন এবং পলিথিন তৈরির কাজ চলে। সেখান থেকেই হঠাৎ করে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভবনে। এসময় কালো ধোয়ায় কারখানাটি অন্ধকার হয়ে যায়। এক পর্যায়ে শ্রমিকরা ছুটাছুটি করতে শুরু করেন। কেউ কেউ ভবনের ছাদে অবস্থান নেয়।
তবে চারতলায় থাকা প্রায় ৭০-৮০ জন শ্রমিক আটকা পড়ে। অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে চারতলার শ্রমিকরা ছুটাছুটি করতে থাকলে ওই তলার দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তারক্ষী গেইটে তালা দিয়ে রাখেন। আগুন নিভে যাবে বলে তালা দিয়ে শ্রমিকদের ওই তলাতেই বসিয়ে রাখেন তিনি। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অন্যান্য তলার শ্রমিকরা বের হতে পারলেও চারতলার শ্রমিকরা বের হতে পারেননি।আগুনের খবর পেয়ে কেউ কেউ ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়তে শুরু করে। এর আগে বৃহস্পতিবার বিকেলে আগুন থেকে বাঁচতে রানী, মিনা আক্তার ও মোরসালিন হক নিহত হয়। এছাড়া এ ঘটনায় প্রায় অর্ধশতাধিক শ্রমিক আহত হন। এদের মধ্যে ১০ জনকে গুরুতর অবস্থায় ঢাকা মেডিকলে কলেজ ও বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।শুক্রবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান, জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ, পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম, উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শাহ নূসরাত জাহান, সহকারী কমিশনার (ভূমি) আতিকুল ইসলাম।
এদিকে, শুক্রবার বেলা ১১ টা পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নেভাতে ব্যর্থ হলে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা রাস্তায় বিক্ষোভ শুরু করেন। এক পর্যায়ে পুলিশের সদস্যদের সঙ্গে শ্রমিকদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এ সময় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা কারখানাসহ ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের চলাচলরত গাড়িসহ মোট অর্ধশতাধিক গাড়ি ভাংচুর করে।বিক্ষুব্ধরা পরে আনসার ক্যাম্পে প্রবেশ করে ব্যাপক ভাংচুর চালায়। ক্যাম্পের অস্ত্র সংরক্ষণাগারের তালা ভেঙ্গে তিনটি শটগান লুট করে নেয়। এ সময় শ্রমিকদের হামলায় কাউসার, বিশ্বজিত, ফারুক, মোশরাকুলসহ ৫ আনসার সদস্য আহত হয়।শ্রমিক ও নিহতের স্বজনরা অভিযোগ করে বলেন, হাসেম ফুড কারখানাটি অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে চলতো। এ কারখানাটিকে অগ্নি নির্বাপণের কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এছাড়া কারখানাটিতে বেশিরভাগই শিশু শ্রমিক কাজ করতো। কারখানাটির খাদ্য পণ্যে অতিরিক্ত ক্যামিকেল ব্যবহার করতো। এ কারণেই অতিরিক্ত ক্যামিকেলের কারণে আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের এতো দেরি হয়। এছাড়া কারখানাটির ভবন থেকে বের হতে শ্রমিকদের জন্য কোন ইমারজেন্সি এক্সিটের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। নিহত শ্রমিকদের মধ্যে বেশিরভাগই শিশু শ্রমিক বলে দাবি তাদের।
১২ বছর বয়সী শিশু শ্রমিক বিশাখা রানী ক্ষোভের সুরে বলেন, বাবা-মাসহ আমাদের ৫ বোনের সংসার। বেতন ভাতা ও ওভার টাইম না পাওয়ায় আমরা খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছিলাম। এ কারণে আমরা শ্রমিকরা বেতন ভাতার দাবিতে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করি। আর এ ক্ষোভেই মালিকপক্ষ আগুন লাগিয়ে আমার সপ্না রানীসহ অন্যান্য শ্রমিকদের হত্যা করে। আমরা এ হত্যার বিচার চাই।
নিখোঁজ শ্রমিক তাছলিমা আক্তারের বাবা আক্তার হোসেন বলেন, মালিক পক্ষের দোষেই কারখানায় আগুন লাগে। শ্রমিকদের চারতলায় আটকে রেখে হত্যা করেছে। আমরা এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।নিখোঁজ শ্রমিক ওমৃতা রানীর (১৭) বোন রোজিনা আক্তার জানান, তার বোন ওমৃতা আক্তার চারতলায় কাজ করছিল। ওমৃতা রানী বলছিল মালিকপক্ষ তাদের আটকিয়ে রেখে জোর করে ১২ ঘণ্টা ডিউটি করাতেন। ঘটনার দিনও তারা কেচিগেট তালা দিয়ে রাখায় চারতলার কোন শ্রমিক বের হতে পারেনি। হাসেম ফুড লিমিটেড কারখানাটির যে ভবনটিতে আগুন লেগেছে সে ভবনটি বিল্ডিং কোড না মেনে করা হয়েছে। অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কারখানাটি পরিচালনা করায় এ অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়।কারখানার অন্যান্য শ্রমিকদের অভিযোগ, কারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের বেতন ভাতা ঠিক মতো পরিশোধ করেন না। শ্রমিকরা বেতন চাইলে মালিকপক্ষ তাদের মারধরসহ চাকরীচ্যুত করার হুমকি ধমকি দেয়।কারখানাটিতে দুটি গেট থাকলেও একটি গেট কারখানা কর্তৃপক্ষ বন্ধ করে রাখে। কোন দুর্ঘটনা হলে শ্রমিকরা দ্রুত গতিতে বের হতে গেলেও শ্রমিকদের পদদলিত হওয়ার শঙ্কা থাকে।
জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে সাত সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডে যারা নিহত হয়েছেন তাদের প্রত্যেকের পরিবারকে লাশ দাফনের জন্য নগদ ২৫ হাজার টাকা ও আহতদের নগদ ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে।ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) জিল্লুর রহমান বলেন, গত বৃহস্পতিবার বিকেল ৫ টা থেকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা হাসেম ফুডে আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ শুরু করেন। চারতলা পর্যন্ত আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। চতুর্থ তলায় এ পর্যন্ত ৫২ টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। লাশ গুলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।তবে পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলার আগুন এখনো থেমে থেমে জ্বলছে। পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলার আগুন পুরোপুরি নির্বাপণ করলে বুঝা যাবে হতাহতের সংখ্যা বাড়বে কিনা।