সৈয়দ আব্দুল হান্নান: রাজনীতির এক সাহসি পুরুষ
সৈয়দ আনাস পাশা
‘একে একে সব নিভিছে দেউটি’। দীর্ঘদিন রোগশয্যায় থেকে শেষ পর্যন্ত চলে গেলেন সিলেটের ন্যাপ নেতা সৈয়দ আব্দুল হান্নান। (ইন্না লিল্লাহ ই ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। রাজনীতির স্বর্ণযুগে রাজপথ দাপিয়ে বেড়ানো মানুষগুলো একে একে চলে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে মনে প্রশ্ন জাগে, এই মানুষগুলো কি বর্তমান রাজনীতির দৈন্যদশা দেখে অভিমান করেই চলে যাচ্ছেন?
আমার নিজ গ্রামের সন্তান ও আত্মীয় পরিচয়ের বাইরেও সৈয়দ আব্দুল হান্নানের সাথে ছিলো আমার রাজনৈতিক সম্পর্ক। আশির দশকের পুরো সময়ই আমি ছিলাম তাঁর আমৃত্যু রাজনৈতিক ঠিকানা ন্যাপের একজন কর্মী। সম্পর্কে চাচা প্রয়াত এই রাজনীতিকের দুই ছেলেও আমার স্কুল জীবনের ঘনিষ্ট সহপাঠি। ১৯৮১ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ন্যাপ, সিপিবি ও সম্মিলিত প্রগতিশীল সংগঠনগুলোর প্রার্থী ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের নির্বাচনী ক্যাম্পেইন থেকে শুরু করে স্বৈরশাষক এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের পুরো সময়টা প্রয়াত সৈয়দ আব্দুল হান্নানের সাথে কাজ করেছি ঘনিষ্টভাবে।
এসএসসি পরীক্ষার পর অনেকটা পারিবারিক উত্তরাধিকার নিয়েই ন্যাপ রাজনীতির সাথে আমার সম্পৃক্ততা। ১৯৭০/৭১ সালে আমার বাবা মরহুম সৈয়দ আহবাব আলী ছিলেন তৎকালীন সুনামগঞ্জ মহকুমা ন্যাপের সহ সভাপতি। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে পেশাগত কারনে ঢাকায় বসবাস করলেও এলাকার সাথে ছিলো তাঁর ঘনিষ্ট যোগাযোগ। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অভিবক্ত ভারতের পক্ষে ভূমিকা রাখতে গিয়ে আমার বাবা একই সাথে জেল খেটেছেন তৎকালীন জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের খ্যাতিমান নেতা মাওলানা জমিলুল হক সাহেবের সাথে। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে স্থানীয় পর্যায়ে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছেন নিজ গ্রামের সন্তান সদ্য প্রয়াত ন্যাপ নেতা সৈয়দ আব্দুল হান্নান, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে তাঁর কারাগার সহযাত্রী মাওলানা সৈয়দ জমিলুল হকের ছেলে মরহুম মাওলানা সৈয়দ শফিকুল হক ও স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে সিলেট এমসি কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি, তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মরহুম সৈয়দ আমিরুল ইসলাম ফখরুলসহ অন্যান্যদের সাথে নিয়ে। ১৯৭২ সালে পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর ১৯৮৩ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় তাঁর শেষ জীবনটি অবসরেই কাটিয়েছেন আমার বাবা। আসলে আমাদের পুরো পরিবারটাই ছিলো বাম ঘেষা। স্কুল শিক্ষিকা দাদী, দুই ফুফু, চাচা সবার মধ্যেই ছিলো প্রগতিশীল রাজনীতি ও সংস্কৃতি চর্চা। পরিবারের প্রগতিশীল রাজনীতি চর্চার এই উত্তরাধিকার নিয়েই মূলত আমার রাজনীতিতে হাতেখড়ি।
রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই স্থানীয় পর্যায়ে নেতা হিসেবে পাই প্রয়াত সৈয়দ আব্দুল হান্নানকে। খদ্দরের সাদা পাজামা পান্জাবী পরিহিত সুদর্শন এই মানুষটি সভা সমাবেশের বক্তৃতায় তখন খুব সহজেই মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারতেন। তাঁর কাছ থেকেই শুনেছি, তরুণ বয়সে চাকুরীর খোজে আদমজি জুট মিলে গেলে শ্রমিক নেতাদের সংস্পর্ষে এসে রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন তিনি। ৩/৪ বছর কাজ করেই আবার ফিরে আসেন নিজ গ্রামে। ইতোমধ্যে ন্যাপ রাজনীতির সাথে গড়ে উঠে তাঁর সম্পর্ক। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানসহ প্রতিটি আন্দোলনে রাজপথে ভূমিকা রাখলে স্থানীয় পর্যায়ে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন তিনি। আমার বাবার প্রতি ছিলো তাঁর অসীম শ্রদ্ধা। ৭০ এর প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সেই জোয়ারের সময় ন্যাপের প্রার্থী হতে যেখানে অনেকেই উৎসাহ দেখাননি বা সাহস করেননি, সেখানে সৈয়দ আব্দুল হান্নান তাঁর প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছের কথা প্রকাশ করেন আমার বাবাসহ সুনামগঞ্জ মহকুমা ন্যাপ নেতৃবৃন্দের কাছে। মহকুমা কমিটির পক্ষ থেকে পার্টির কেন্দ্রিয় পর্যায়ে সৈয়দ আব্দুল হান্নানের মনোনয়নের জন্য সুপারিশ করা হলে জগন্নাথপুর-দক্ষিন সুনামগন্জ এলাকায় তাকে নমিনেশন দেয়া হয়। কুঁড়েঘর প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্ধিতা করেন তিনি। নৌকার জোয়ারে ভেসে গেলেও নির্বাচনে অংশ গ্রহনের তাঁর ঐসময়ের সাহসি ইচ্ছে সবার কাছেই প্রশংসিত হয়। ঐ নির্বাচনে আমাদের এলাকায় ষাটের দশকের মধ্য বা শেষ ভাগে ন্যাপ থেকে আওয়ামী লীগে যোগদান করা আব্দুস সামাদ আজাদ জাতীয় পরিষদ সদস্য এবং আওয়ামী লীগের এডভোকেট আব্দুর রইস প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ন্যাপের পক্ষ থেকে কুঁড়েঘর প্রতিক নিয়ে জাতীয় পরিষদে প্রার্থী ছিলেন ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলনের কিংবদন্তী নেতা গুলজার আহমেদ এবং দুটো প্রাদেশিক পরিষদ আসনে প্রার্থী ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও সৈয়দ আব্দুল হান্নান। সারা দেশে ন্যাপের একমাত্র সুরঞ্জিত সেনই নির্বাচিত হয়েছিলেন।
৭১ এ সাড়ে নয় মাসের প্রথম দিকে স্থানীয় পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে আমার বাবার সহযোগী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন সৈয়দ আব্দুল হান্নান। এতদঞ্চলের ন্যাপ, কমিউনিষ্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীদের যারাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন তাদের সবারই মেন্টর, গাইড ও সাহায্যকারী হিসেবে তখন কাজ করেছেন সৈয়দ আহবাব আলী, মাওলানা সৈয়দ শফিকুল হক, সৈয়দ আব্দুল হান্নান ও সৈয়দ আমিরুল ইসলাম ফখরুল, এই চারজনের টিম।
১৯৭৭ সালে যখন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ে, তখন কাকে প্রার্থী করা যায় এনিয়ে গ্রামের মুরুব্বীরা পরামর্শের জন্য আসেন, আমাদের এলাকা তথা বৃহত্তর সিলেটের তৎকালীন সময়ের স্বনামধন্য সালিশ বিচারক, আমার দাদা (বাবার চাচা) মরহুম সৈয়দ আব্দুল মান্নান মাষ্টারের কাছে। দাদা একবাক্যে তাঁর মতামত জানিয়ে বললেন, ‘হান্নানকে দাঁড় করাও, এই ছেলেটার সাহস আছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সাহসি জনপ্রতিনিধি হলো জনগনের ভরসার জায়গা, হান্নানের উপর ভরসা করা যায়।’ এবছরের নির্বাচনে আমাদের ইউনিয়ন সৈয়দপুর-শাহারপাড়ার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন সৈয়দ আব্দুল হান্নান বিপুল ভোটে।
দাদা মরহুম মন্নান মাষ্টার সাহেবের কথাই ঠিক। সৈয়দ আব্দুল হান্নান যে একজন সাহসি মানুষ এর অনেক প্রমান পরবর্তীতে আমরা পেয়েছি, রাজনৈতিকভাবে ঘনিষ্ট থাকায় এধরনের কিছু ঘটনার স্বাক্ষি আমি নিজেও। এই মানুষটি রাজনীতিতে যেমন স্পষ্টভাসি ছিলেন, জনপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালীন সময়েও তিনি ছিলেন তাই। যে বিষয়টি সঠিক মনে করতেন, তা অকপটে স্পষ্টভাষায় বলতেন, কোন পক্ষ বা গোষ্ঠির অসন্তুষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও।
প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রীধারী কোন শিক্ষিত হয়তো তিনি ছিলেন না, কিন্ত ছিলেন স্বশিক্ষিত। রাজনীতিসহ সমসাময়িক বিশ্ব সম্পর্কে ছিলো তাঁর প্রচুর জ্ঞান। স্ববিরোধী ভন্ড শিক্ষিতদের তিনি পছন্দ করতেন না, প্রকাশ্যেই তাদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। আর একারনে আমাদের তরুণ বয়সে দেখেছি ‘শিক্ষিত’ একটি গ্রুপ সব সময়ই তাঁর বিরোধীতায় থাকতেন। দূর্নীতিবাজ সরকারী কর্মকর্তাদের আতঙ্ক ছিলেন সৈয়দ আব্দুল হান্নান। জগন্নাথপুর থানা সদরে যেদিন সৈয়দ হান্নানের উপস্থিতি থাকতো, সেদিন অফিস পাড়ার অফিসাররা থাকতেন সতর্ক। ব্যক্তিগত জীবনে ধার্মিক হলেও ধর্মের নামে ভন্ডামীর কঠোর সমালোচক ছিলেন তিনি। মাদ্রাসা ছাত্রদের সাথে মেলা বিরোধী আন্দোলনে তিনি যেমন থাকতেন সামনের সারিতে, ঠিক তেমনি হুজুরের মুখের সুপারী খেতে পেরেসান মুরিদদের ‘ফেরৎ’ বলে গর্জেও উঠতেন তিনি। শুধু গর্জন নয়, মুরিদদের কাছে নিজের বাবার চেয়েও শ্রদ্ধেয় ঐ হুজুরকে হুঙ্কার দিয়ে বলতেন, ‘আপনার মুখ থেকে ফেলা সুপারী খাওয়ার জন্য এরা পাগল হয়ে যায়, অথচ আপনি কিছু বলেননা, এ কেমন আলেম আপনি? ধর্মের নামে ভন্ডামী আর কত করবেন?’
একবার সম্ভবত আশির দশকের মধ্যভাগে জগন্নাথপুর উপজেলা সদরে সৈয়দ আব্দুল হান্নানের সাথে বসে আছি থানা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে। নতুন যোগদান করেছেন ইউএনও। এমনি সময় একটি সামাজিক সংগঠনের অনুষ্ঠানের জন্য ইউএনও’র কাছে চাঁদা সংগ্রহ করতে আসে কয়েকটি ছেলে। ইউএনও তাদের চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, ‘আমি মসজিদ মাদ্রাসা ছাড়া আর কেথাও চাঁদা দেইনা’। ছেলেগুলো ফিরে যাচ্ছে দেখে আব্দুল হান্নান ইউএনও কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন, ‘মসজিদ মাদ্রাসায় চাঁদা দিলে ঘুষের টাকাগুলো হালাল হয়, তাই না?’ কয়েক সেকেন্ডের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় ইউএনও রেগে গিয়ে চেয়ার থেকে উঠে জনাব আব্দুল হান্নানকে অফিস থেকে বের হয়ে যেতে বললে, হাতের ছাতা দেখিয়ে ইউএনও’র উদ্দেশ্যে তিনি গর্জে উঠলেন, ‘তুমার মতো অসৎ অফিসারদের শায়েস্তা করতে আমার এই ছাতাই যথেষ্ট’। শোরগোল শুনে অন্যান্য পুরোনো অফিসাররা জড়ো হয়ে দুজনকেই শান্ত করলে, ‘ওঁকে ভালো হয়ে চলতে বলো’ বলে আমাকে নিয়ে বেড়িয়ে আসেন সৈয়দ আব্দুল হান্নান। আজকের দিনে যখন দেখি রাজনীতিক, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যানরা কথায় কথায় ইউএনওসহ সরকারী কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ বলতে অজ্ঞান তখন ঐ ঘটনা আমার চোখের সামনে ভাসে।
গ্রাম পর্যায়ে মামলা মোকদ্দমার সুযোগ নিয়ে পুলিশের হয়রানী বর্তমান সময়ে ‘স্বাভাবিক’ ঘটনা হলেও আগেও মাঝে মাঝে এধরনের ঘটনা ঘটতো। যেখানেই পুলিশী হয়রানী, সেখানেই সৈয়দ আব্দুল হান্নানের ছিলো সাহসি উপস্থিতি। এমনও ঘটনা ঘটেছে, নিজেদের সাহায্যে সৈয়দ আব্দুল হান্নানের উপস্থিতি পেয়ে স্থানীয় জনগন এমন সাহসি হয়ে উঠে যে, পুলিশকে ধরে আটকিয়ে রাখলে জেলা থেকে এসপি গিয়ে এই পুলিশকে ছাড়িয়ে আনতে হয়েছে। বিনিময়ে পুলিশ এসল্টের মামলার আসামী হয়ে আদালতে দৌড়ঝাপ করতে হতো সৈয়দ আব্দুল হান্নানকে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে বিষয়টি সবচেয়ে বড় ব্যতিক্রম, তাহলো ক্ষমতার লোভে দল বদল না করা। প্রয়াত সৈয়দ আব্দুল হান্নান ছিলেন এই ব্যতিক্রমী রাজনীতিবিদদের একজন। আজীবন একই সংগঠন ন্যাপের পতাকাতলে কাটিয়েছেন তিনি। তাঁর সাহসিকতার কারনে পার্টি প্রধান প্রয়াত জননেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ তাকে সম্বোধন করতেন ‘আমাদের পাগলা চেয়ারম্যান’ বলে। ছাত্র সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত সভা, নারায়গঞ্জ সামাজিক বিজ্ঞান পরিষদে পার্টির প্রশিক্ষন, ধানমন্ডি পার্টি অফিসের কোন সভা, যেখানেই দেখা করতে গিয়েছি, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ জানতে চেয়েছেন, ‘আমাদের পাগলা চেয়ারম্যান কেমন আছেন’। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের এমনই প্রিয়পাত্র ছিলেন তিনি, যে কারনে মতাদর্শগত কারনে বারবার ন্যাপে ভাঙ্গাগড়ার ‘খেলা’ চললেও সৈয়দ আব্দুল হান্নান কখনও মোজাফফর আহমদকে ছেড়ে যাননি।
জন্ম মাটির প্রতি ছিলো সৈয়দ আব্দুল হান্নানের আলাদা একটি টান। শিকড় প্রেমিক এই মানুষটি নিজ গ্রামেই থাকতে স্বাচ্ছন্ধ্য বোধ করতেন। এলাকার কৃষক, শ্রমিক শ্রমজীবী মানুষ ছিলেন তাঁর আত্মার আত্মীয়। জগন্নাথপুর ও সুনামগন্জ এলাকাই ছিলো মূলত তাঁর রাজনীতির চারণভূমি। সিলেট শহরে নিজেদের পারিবারিক বাড়ী থাকলেও নব্বই দশকের শেষ পর্যন্ত গ্রাম সৈয়দপুর ছেড়ে আসার চিন্তা করেননি কখনও। ১৯৯৫ সালে আমি ব্রিটেন প্রবাসী হওয়ার পর সম্ভবত তিনি সিলেট শহরে এসে বসবাস ও রাজনীতি শুরু করেন। সন্তানদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে সহযোগীতা করা বাবা হিসেবে তাঁর আরেকটি দায়িত্ব, এটি মনে করেই হয়তো সিলেট শহরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। দেশ ছাড়ার পর সৈয়দ আব্দুল হান্নানের সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হলেও, ব্যাক্তিগত যোগাযোগ ছিলো সব সময়। দেশে গেলে তাঁকে দেখতে যেতাম তাঁর বাসায়। একবার আমার সন্তানদেরও নিয়ে গেলাম। তারা মাটি ও মানুষের নেতা সৈয়দ আব্দুল হান্নানের মুখে শুনলো তাদের গর্বিত পূর্বসূরী দাদা মরহুম সৈয়দ আহবাব আলীর গল্প। সর্বশেষ দেশে যাই ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। কিন্তু ব্যস্থতার কারনে ঐসময় তার সাথে আর দেখা করতে পারিনি। এখন অনুসূচনায় ভুগছি, শেষ দেখাটা দেখতে পারলামনা। এখন আর কেউ বলবেনা, ‘ও বেটা আমারে ফালাইয়াতো তুমরা বিদেশ গেলায়গি। বাঁধাতো দিতাম পারিনা, ইটা সময়র দাবী। আমরা রাজনীতিবিদরা একটা সুন্দর সমাজ বানাইতে পারলে, তুমরার মতো টেলেন্ট ফুয়াইনতর তো আর বিদেশ যাওয়া লাগতো না। ই ব্যর্থতাতো আমারার’।
সৈয়দ আব্দুল হান্নান একজন মানুষ ছিলেন, ফেরেস্তা নয়। দীর্ঘ রাজনৈতিক ও জনপ্রতিনিধিত্ব কালের সময়ে তারও হয়তো অনেক অনিচ্ছাকৃত ভুলত্রুটি আছে। এগুলো সংশ্লিষ্ট সবাই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন এই প্রত্যাশা থেকেই তাঁকে নিয়ে আমার এই স্মৃতিচারণ। তাঁর মৃত্যুশোক সামলে উঠতে বেশ কদিন সময় নিতে হলো। পূর্ব প্রজন্মের কাছ থেকে শোনা ও আমার নিজের দেখা সময়কে পূজি করেই আমার এই স্মৃতিচারণ। সৈয়দ আব্দুল হান্নানকে মহামানব বানিয়ে অতিরঞ্জিত ইতিহাস রচনা বা তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অর্জনকে অবহেলা, স্মৃতিচারণের সময় এই দুটি বিষয় খুবই সতর্কতার সাথে মাথায় রেখেছি আমি।
প্রয়াত এই দেশপ্রেমিক মানুষটিকে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখার জন্য স্বীকৃতি দেয়া হলোনা বলে সোস্যাল মিডিয়ায় অনেকের হতাশা লক্ষ্য করলাম। তাদেরকে বলি, সৈয়দ আব্দুল হান্নানরা কোন স্বীকৃতির জন্য রাজনীতি বা মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখেননি। বৃহত্তর সিলেটের অবিসংবাদিত বাম রাজনীতিক, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে বালাট সাব সেক্টরের এডমিনিষ্ট্রেটর প্রয়াত জননেতা গুলজার আহমদও নিরবে প্রস্থান করেছেন এই পৃথিবী থেকে, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোন স্বীকৃতি পাননি। আমার বাবার নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তুলার চেষ্টা করতে অনেকেই অনুরোধ করেছেন আমাকে। আমি সবাইকে বলেছি, বাবার দেশপ্রেমের স্বীকৃতি যেখানে বেঁচে থাকতে উনি নিজে চাননি, সেখানে সন্তান হয়ে সেই স্বাকৃতির লোভ করা আমার জন্য অপরাধ। সৈয়দ আব্দুল হান্নানের সন্তানদেরও বলি, আপনাদের বাবার নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ স্বাধীনতা পদকের অফার ফিরিয়ে দিতে গিয়ে বলেছিলেন ‘কোন স্বীকৃতির জন্য নয়, দেশের জন্য কাজ করেছি দেশপ্রেম থেকে’। সৈয়দ আব্দুল হান্নান সেই নেতার ফলোয়ার, সহযোদ্ধা। এই বিষয়টা স্মরণে রাখলে স্বীকৃতি না পাওয়ার ঘটনায় কষ্ট পাবেন না।
যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন হে সাহসি পুরুষ। যখনই সাধারণ মানুষ শোষনের শিকার হবে, প্রশাসনিক নির্যাতন যখনই নেমে আসবে কোন এলাকার উপর, তখনই আপনার নাম মনেকরে সাহসি হয়ে উঠবে সাধারণ মানুষ, এটি আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি।
সৈয়দ আনাস পাশা: সাংবাদিক, সত্যবাণীর প্রধান সম্পাদক। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে সিলেট জেলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।