নির্মূল কমিটির সেমিনার: স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অস্বীকারকারীদের রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে বিচার করতে হবে

নিউজ ডেস্ক
সত্যবাণী

ঢাকাঃ আজ (১০ এপ্রিল) বিকেল ৩ টায় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এক আন্তর্জাতিক ওয়েবিনারের আয়োজন করেছে। ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অস্বীকার রাষ্ট্রদ্রোহিতাতুল্য অপরাধ’ শীর্ষক ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়-এর মাননীয় মন্ত্রী এডভোকেট শ. ম. রেজাউল করিম এমপি এবং প্রধান বক্তা ছিলেন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের রচয়িতা ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম।

নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই ওয়েবিনারে বক্তা ছিলেন নির্মূল কমিটির আইন সহায়ক কমিটির সভাপতি বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, ১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর-এর সভাপতি বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, শহীদ ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পৌত্রী সমাজকর্মী আরমা দত্ত এমপি, নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় নেতা ব্যারিস্টার ড. তুরিন আফরোজ, নির্মূল কমিটি আইটি সেল-এর সভাপতি, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর পুত্র আসিফ মুনীর তন্ময়, নির্মূল কমিটির সর্বইউরোপীয় শাখা সভাপতি মানবাধিকার নেতা তরুণকান্তি চৌধুরী, নির্মূল কমিটির যুক্তরাজ্য শাখা সভাপতি সমাজকর্মী নূরুদ্দিন আহমেদ, নির্মূল কমিটির আইন সহায়ক কমিটির দপ্তর সম্পাদক এডভোকেট আসাদুজ্জামান বাবু ও নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল।

সভাপতির সূচনা বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধ গবেষক শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ হচ্ছে স্বাধীনতাকামী কোন দেশের স্বাধীনতার পক্ষে দৃঢ়োক্তি বা দাবি। এই ঘোষণাপত্র আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা তখনই বৈধতা লাভ করে যখন তা প্রদান করেন দেশের বা জাতির নির্বাচিত প্রতিনিধিরা বা স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদী নেতৃত্ব। ২০০৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি জারীকৃত কসোভোর একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা সার্বিয়া যখন আন্তর্জাতিক আদালতে চ্যালেঞ্জ করে তখন (জুলাই ২০১০) আদালতের রায়ে এই নিরিখে বলা হয় ‘কসোভোর স্বাধীনতার ঘোষণা আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করেনি।’

‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন স্বাধীনতাকামী জাতির অবিসংবাদী নেতা হিসেবে, নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি হিসেবে। আন্তর্জাতিক আইন অন্য কাউকে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানের অনুমোদন করে না। কোনও দেশে কেউ যদি তা করেও থাকেন তার কোন আন্তর্জাতিক বৈধতা নেই। দালাইলামা তিব্বতের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন ১৯৫৯ সালে। যেহেতু তিনি নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি ছিলেন না সেহেতু তাকে এবং স্বাধীনতাকামী তিব্বতীদের আশ্রয়দানকারী ভারতও দালাইলামার স্বাধীনতার ঘোষণাকে স্বীকৃতি দিতে পারে নি।

‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছেÑ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোন প্রেক্ষাপটে ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এবং ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা বাঙালি জাতির অবিসংবাদী নেতা বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা অনুমোদন করেছেন, যে কারণে ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত। ‘বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন নি’ এ কথা বলার অর্থ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অস্বীকার করা, আন্তর্জাতিক আইনে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের বৈধতা অস্বীকার করা এবং ইতিহাস অস্বীকার করা। যারা এ ধরনের রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক অপরাধ করবে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।’

ওয়েবিনারের প্রধান বক্তা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের রচয়িতা ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের সংবিধান ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সৃষ্টি এক রক্তক্ষয়ী ঐতিহাসিক সংগ্রামের প্রেক্ষিতে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুযায়ী ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ তারিখ থেকে কার্যকর এবং এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক উক্তরূপ স্বাধীনতার ঘোষণা দৃঢ়ভাবে অনুমোদন ও সমর্থন করা হয়েছে। এই ঘোষণাপত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর অস্থায়ী সংবিধান ঘোষণা করা হয়, যেখানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের স্বীকৃতি রয়েছে। একইভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সমর্থন ও স্বীকৃতি মেলে সংবিধানের প্রস্তাবনার প্রথম বাক্যে এবং সংবিধানের ১৫০ (৩) অনুচ্ছেদে। যেখানে বলা হয়েছে “স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এতদ্বারা অনুমোদিত ও সমর্থিত হইল এবং তাহা আইন অনুযায়ী যথার্থভাবে প্রণীত, প্রযুক্ত ও কৃত হইয়াছে বলিয়া ঘোষিত হইল”। সে কারণে ৮ম সংশোধনী মামলার রায়ে বিচারপতি জনাব বদরুল হায়দার চৌধুরী স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র-কে বলেছেন “Genesis of Constitution” এবং এ কারণে, আমাদের Constitution unquie ।’

ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম আরও বলেন, ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং সংবিধান এর সহজপাঠ আমাদের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা সহ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করলে তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। কারণ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তির সনদ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও বাংলাদেশের সংবিধানের প্রতি আন্তরিক ও অকৃত্রিম আনুগত্যই শুধু পারে এদেশবাসীকে দলমত নির্বিশেষে এক্যবদ্ধ করতে। এমন একটি ঐক্যই শুধু পারে সম্ভাবনাময় বাংলাদেশকে উন্নয়নের শিখরে পৌঁছাতে।’

প্রধান অতিথি মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়-এর মাননীয় মন্ত্রী এডভোকেট শ. ম. রেজাউল করিম এমপি বলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সূতিকাগার বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। এ জায়গা বাংলাদেশের অস্তিত্বের শিকড়। সংবিধানের ৭(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের বিরোধিতা রাষ্ট্রদ্রোহিতা। ২৬ বছর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ক্ষমতায় ছিল। তারা বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। তারা স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতকে বাংলাদেশে রাজনীতি করার অধিকার দিয়েছে এবং সংবিধানে বিভিন্ন অনুচ্ছেদ কাঁটাছেড়া করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানুষের চিন্তা চেতনা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এগুলো সবই রাষ্ট্রদ্রোহিতা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আমাদেরও ব্যর্থতা আছে। আমরা ঐক্যবদ্ধ নই। অনেক ক্ষেত্রে আমরা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কথা বা বাঙালি জাতীয়তাবাদ-এর কথা বলি না। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিও দ্বিধাগ্রস্ত। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে আমরা রক্ষা করতে পারিনি। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি কখনও হেফাজত, কখনও জামায়াত, কখনও নেজামে ইসলামÑ একেক সময়ে একেক নামে আসে এবং বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার অপচেষ্টা করে। শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলেও তাদের উত্তরসূরিরা এখনও শক্তিমান এবং প্রশাসন, শিক্ষাক্ষেত্র সহ সমাজের সকল স্তরে তারা অপতৎপরতা অব্যহত রেখেছে। ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতার পূর্বের মতো এই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তিকে প্রতিহত করতে হবে।’

নির্মূল কমিটির আইন সহায়ক কমিটির সভাপতি বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র আমাদের প্রথম সংবিধান। এই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করেছে আমাদের ২৬৯ জন গণপ্রতিনিধি। সেজন্য তা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। ভারত, ভূটানসহ বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি অর্জনের ক্ষেত্রে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বঙ্গবন্ধুর পূর্ণ নির্দেশনায় ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি সংবিধান প্রণয়ন করেন, যার মূল ভিত্তি ছিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র।’

১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর-এর সভাপতি বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘১৭ বছর ধরে আমরা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র দিবস পালন করছি কিন্তু রাষ্ট্র এই দিবস পালন করছে না। বার কাউন্সিলসহ অন্যান্য আইনজীবী সংগঠনগুলো এই দিবস পালন করতে পারে। ধর্মনিরপেক্ষতাসহ মুক্তিযুদ্ধের দর্শনগত যেসব বিষয়বস্তু বঙ্গবন্ধু সংবিধানে এনেছেন, সেগুলো তার দল বর্তমানে সম্মুখে ব্যক্ত করতে অনীহা প্রকাশ করছে। এসব বিষয় অগ্রাহ্য করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার বেশিদূর এগোতে পারবে না। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়Ñ সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার। এগুলো আমরা সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে পারছি না। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের বিরোধিতা অবশ্যই রাষ্ট্রদ্রোহিতা। কিন্তু সরকার এসব বিষয়ে নিরব। মন্ত্রী, এমপিরা আমাদের সামনে এসব কথা বলেন, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে নিরব ভূমিকা পালন করেন। আমরা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য শিক্ষামন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দিতে পারি। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র দিবস পালন করার জন্য সংসদে প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য এমপিদের অনুরোধ করতে পারি। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের বিরোধিতাকারীদের রাষ্ট্রদ্রোহিতার শাস্তির জন্য আইনজীবীরা কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন।’

You might also like