স্বাধীনতা সংগ্রামী শহীদ বাঘা যতীনের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সমাবেশ ও আলোচনা সভা

নিউজ ডেস্ক
সত্যবাণী

ঢাকাঃ উনিশ শতকের শেষার্ধে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষের বিপ্লবীরা যে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা করেছিলেন ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় তার চূড়ান্ত অভিব্যক্তি ছিল ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়। স্বাধীন বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর একাধিক ভাষণে স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, মাষ্টারদা সূর্যসেন, বাঘা যতীন, ক্ষুদিরাম প্রমুখের অবদান স্মরণ করেছেন।বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (১৮৭৯-১৯১৫), যিনি বাঘা যতীন নামে খ্যাত, জন্মগ্রহণ করেছেন কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর কয়া গ্রামে তাঁর মাতুলালয়ে। ছাত্রজীবনেই তিনি অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের সংস্পর্শে আসেন এবং দেশমাতৃকার মুক্তির শপথ গ্রহণ করেন। ১৯১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তিনি ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়ে উড়িষ্যার বালাশোরে শহীদ হন।আজ ১০ সেপ্টেম্বর (২০২৩) কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কয়া মহাবিদ্যালয়ে শহীদ বাঘা যতীনের ১০৮তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে এক নাগরিক সমাবেশ ও আলোচনা সভার আয়োজন করে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি কুমারখালী শাখা। স্বাধীনতা সংগ্রামের এই মহান শহীদকে স্মরণ করার পাশাপাশি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বহুমাত্রিক ষড়যন্ত্র এবং একে প্রতিহত করার লক্ষে নাগরিক সমাজের করণীয় সম্পর্কে এই সমাবেশে আলোচনা করা হয়। সভায় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি কুমারখালী শাখার সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এ টি এম আবুল মনছুর মজনুর সভাপতিত্বে প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্র্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক সমাজকর্মী কাজী মুকুল; বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কুমারখালী পৌরসভার মেয়র জনাব শামসুজ্জামান অরুণ, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্র্মূল কমিটির আইটি সেলের আহ্বায়ক শহীদসন্তান নাট্যজন আসিফ মুনীর তন্ময়।

আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কুমারখালী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব বিতান কুমার ম-ল, কুমারখালি সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জনাব শরিফ হোসেন, কুমারখালী নাগরিক পরিষদের সভাপতি জনাব আকরাম হোসেন, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি কুমারখালী শাখার সাধারণ সম্পাদক সমাজকর্মী মমতাজ বেগম, কুমারখালীর কয়া মহাবিদ্যালয় সভাপতি এডভোকেট নিজামুল হক চুন্নু, বীর মুক্তিযোদ্ধা সোলাইমান জোয়াদ্দার, কয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্জ্ব মো: আলি হোসেন, কয়া মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ জনাব হারুন-অর-রশীদ।অনুষ্ঠানের প্রধান বক্তা নির্র্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক সমাজকর্মী কাজী মুকুল বলেন, ‘আমরা ভারতবর্ষ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে দেখতে পাই বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির পাশাপাশি শৃঙ্খলমুক্ত মানুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য বাঘা যতীনসহ আরো অনেক বিপ্লবী সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। অন্যদিকে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস অহিংস আন্দোলন পরিচালনা করে। এই দুই আন্দোলনের যুগপৎ ব্যবহার করেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অহিংস আন্দোলন চালিয়ে গেলেও প্ল্যান বি হিসেবে ভেবে রেখেছিলেন সশস্ত্র আন্দোলন এবং গোপনে এর প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন। অবশেষে তিনি বাংলার নির্যাতিত মানুষকে পাক হানাদারদের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার জন্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দেন এবং চূড়ান্ত বিজয়ের পরে তিনি বলেন, যে লড়াই প্রীতিলতা, মাস্টারদা সূর্যসেন, বাঘা যতীন এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু শুরু করেছিলেন তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা পাওয়ার মাধ্যমে পূর্ণতা পেয়েছে।কাজী মুকুল আরও বলেন, ‘আমরা এমন এক সময় অতিবাহিত করছি যখন বাংলাদেশসহ গোটা উপমহাদেশে মানবতার চিরশত্রু মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক অপশক্তি তাদের ভয়াল ফণা বিস্তার করে বার বার ছোবল দিচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও মানবিক মূল্যবোধের উপর। আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছিÑ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমাদের সাফল্য ও উন্নয়নের এই ধারা স্তব্ধ করে, যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার বন্ধ করে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানের মতো ব্যর্থ, সন্ত্রাসী, জঙ্গি রাষ্ট্র বানাবার জন্য জামায়াত-বিএনপির মতো ’৭১ ও ’৭৫-এর খুনিরা আবার মাঠে নেমেছে। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তারা আন্দোলনের নামে তা-ব করছে এবং গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়ে বিদেশী হস্তক্ষেপ ও আগ্রাসনের ক্ষেত্র তৈরি করছে। আমরা চাই ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের মূল্যে অর্জিত পবিত্র জাতীয় সংসদে আমাদের জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে তারাই যাবেন যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করেন, যারা জনগণের সম্পদ আত্মসাৎ করেন না, যারা দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত নন, যারা প্রকৃত অর্থে এ দেশের মাটি ও মানুষকে ভালবাসেন।

কাজী মুকুল বলেন, ‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোট জনগণের মৌলিক অধিকার। আপনাদের কাছে আমাদের আবেদনÑ যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, যারা ’৭১-এর গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে, যারা গণতন্ত্রের নামে গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়ে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতো ব্যর্থ, সন্ত্রাসী, দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়, যারা বাংলাদেশকে জঙ্গি মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছিল, যারা বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বছরের পর বছর দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন বানিয়েছিলÑ তাদের দ্বারা প্রতারিত হবেন না। যারা ’৭১-এর ঘাতক, দালাল এবং তাদের সহযোগী ও উত্তরাধিকারীদের ভোট দেবেনÑ তারা ৩০ লক্ষ শহীদের পবিত্র রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করবেন।শহীদ স্বাধীনতাসংগ্রামী বাঘা যতীনের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নির্র্মূল কমিটির আইটি সেলের আহ্বায়ক শহীদসন্তান নাট্যজন আসিফ মুনীর তন্ময় বলেন, ‘অতীতে আমরা দেখেছি নির্বাচনের প্রাক্কালে স্বাধীনতাবিরোধী, মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক অপশক্তি কীভাবে সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভোটারদের বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে তাদের ভোটদানে বিরত রাখে। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীদের তা-বে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রায় ৭০ শতাংশ ভোটার ভোট দিতে পারেননি। তাদের হত্যা করা হয়েছে, নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছে, গৃহে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। আগামী নির্বাচনে যাতে দেশের সকল নাগরিক শান্তিপূর্ণভাবে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন তা সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে পূর্বাহ্নে নিশ্চিত করতে হবে। যে সব এলাকায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আবাস তুলনামূলকভাবে বেশি সে সব অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ব্যক্তিদের নিয়ে প্রতিরোধ কমিটি গঠন করুন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার দায় একা শুধু সরকারের নয়, আমাদের সকলের।’
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি কুমারখালী শাখার সাধারণ সম্পাদক সমাজকর্মী মমতাজ বেগম বলেন, ‘বাঘা যতীনের লড়াইয়ের ইতিহাস এবং তার দর্শন ও চেতনাকে যেমন জানতে হবে তেমনি মা শরৎশশী দেবী কীভাবে সন্তান যতীনকে বিপ্লবী বাঘা যতীন হিসেবে গড়ে তুললেন তার ইতিহাসও জানতে হবে। আজ সাম্রাজ্য বিস্তারকারী শকুনের দৃষ্টি চারিদিকে। আমরা যদি আমাদের সন্তানদের বাঘা যতীনদের বিপ্লবের ইতিহাস গাথা পৌঁছে না দিই তাহলে দেশের ক্রান্তিলগ্নে শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে কে?একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি কুমারখালী শাখার সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এ টি এম আবুল মনছুর মজনু সভাপতির ভাষণে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ যখন সারাবিশ্বের কাছে রোল মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে তখন পঁচাত্তরের সেই অপশক্তি উঠেপড়ে লেগেছে বাংলাদেশকে পাকিস্তানিকরণের জন্য। তারা শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে চায়। ১৯ বার চেষ্টাও করেছে। আমরা তা আর হতে দেব না। এই অপশক্তির ষড়যন্ত্র আমরা যেকোনো মূল্যে রুখে দেব এবং আসন্ন নির্বাচনে তাঁকে নির্বাচিত করবো।’
সভার সকল আলোচকবৃন্দ কয়া মহাবিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে ‘শহীদ বাঘা যতীন কলেজ’ নামকরণের করার দাবি জানান।

১০ সেপ্টেম্বর (২০২৩) কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কয়া মহাবিদ্যালয়ে শহীদ বাঘা যতীনের ১০৮তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি কুমারখালী শাখা আয়োজিত এক নাগরিক সমাবেশ ও আলোচনা সভায় প্রধান বক্তার বক্তব্য প্রদান করছেন নির্র্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক সমাজকর্মী কাজী মুকুল। সভায় উপস্থিত (প্রথম সারির ডান থেকে) কুমারখলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুকল্যাণ বিশ্বাস, কুমারখলী উপজেলার সহকারী কমিশনার আমিরুল আরাফাত, নির্র্মূল কমিটির আইটি সেলের আহ্বায়ক শহীদসন্তান নাট্যজন আসিফ মুনীর তন্ময়, নির্মূল কমিটি কুমারখালী শাখার সাধারণ সম্পাদক সমাজকর্মী মমতাজ বেগম, কুমারখালি সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জনাব শরিফ হোসেন, (দ্বিতীয় সারির ডান থেকে) বীর মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর শেখ,অবসারপ্রাপ্ত শিক্ষক নাসির উদ্দিন, কয়া মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ জনাব হারুন-অর-রশীদ, নির্মূল কমিটি কুমারখালী শাখার সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এ টি এম আবুল মনছুর মজনু, বীরমুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার ও বীরমুক্তিযোদ্ধা রিয়াজ উদ্দিন মিয়া

You might also like