স্মরণ: এ যেন এক নরকলীলা…..

 চৌধুরী ফরহাদ

 

২৭ জানুয়ারি ২০০৫, দুপুর ২.৩০টা। হবিগঞ্জ ষ্টাফ কোয়াটার রোডে বন্ধু ও যুব নেতা আবুল হাসানের দোকানে জম্পেশ আড্ডা দিচ্ছিলাম!
হঠাৎ চীর রসিক রাজন ভাই (তৎকালীন জেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সম্পাদক রাজন চৌধুরী বর্তমানে লন্ডন প্রবাসী) আমাদের আড্ডার মাঝে উপস্থিত হলেন সাথে নীলা ভাবী । রাজন ভাই তার স্বভাবজাত বেশ কিছু মজার চুটকি বলেন, খুনসুটি করেন। নীলা ভাবী, হাসান ও আমাকে কিছু চকলেট দিয়ে রাজন ভাই বললেন এই ন্যাপিস্টরা আমি বৈদ্যেরবাজারে জনসভায় যাচ্ছি তোদের ভাবীকে দেখে রাখিস……! এই কথা শুনে আমি তখন বললাম, ভাই দেইখেন ২১শে আগষ্টের মতো পাঞ্জাবি ছাড়া শুধু পায়জামা পড়নে দৌড়ানি না খান!? ( ২১শে আগষ্ট ২০০৪ সালে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ-এ আওয়ামীলীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হলে রাজন ভাই লোকজনের ধাক্কাধাক্কিতে আহত হন এবং শরীরে পাঞ্জাবি গেঞ্জি ভিড়ের ভিতর লোকজনের টানাটানিতে ছিঁড়ে যায়। শুধু কোন রকম পায়জামাটা বাঁচিয়ে ঢাকা থেকে হবিগঞ্জে আসেন।)

এই কথা বলে আমরা সবাই প্রচুর হেঁসেছিলাম, রাজন ভাই হেঁটে যাচ্ছেন ভাবী তাকিয়ে আছেন..! প্রায় ঘন্টা দেড়েক পরে আমাদের আড্ডা তখনো চলছে..। পুরাতন খোয়াই নদীর পাড় ধরে কেউ একজন ‘খবর দেও রে, মাইরা লাইছে রে…!’ বলে চিৎকার করতে করতে আমাদের দিকে দৌড়ে আসছে!!
কি সেই খবর? খবর পেলাম বৈদ্যেরবাজারে কিবরিয়া সাহেবের জনসভায় বোমা হামলা হয়েছে । আমাদের পাশেই হবিগঞ্জ সদর হাসপাতাল, আড্ডা ফেলে সবাই দৌড়ে গেলাম..! হাসপাতালের জরুরী বিভাগে গিয়ে দেখি জরুরী বিভাগের ভিতরে ও বারান্দায় ৫ জনের রক্তাক্ত দেহ পড়ে আছে। আহতরা যন্ত্রনায় আত্মচিৎকার করছে!! আমি দেখছি কিবরিয়া সাহেবের বুক থেকে পা পর্যন্ত ঘন রক্তে লাল হয়ে আছে, রক্ত বন্ধ হচ্ছে না। স্ট্রেচার থেকে আমরা যখন কিবরিয়া সাহেবকে ঢাকা’র উদ্দেশ্যে অ্যাম্বুলেন্সে তুলছিলাম তখন মনে হল দেহটা হাড়গোড় বিহীন মাংস পিন্ডের মতো। আমরা যখন হাসপাতালে যাই তখনো কিবরিয়া সাহেব জীবিত, অস্পষ্ট স্বরে বলেন “ওরা আমাকে কেন মারলো”। খবর পেয়ে কিবরিয়া সাহেবকে দেখতে আসা জনস্রোতের উপর পুলিশ তীব্র লাঠিচার্জ করছে! এমন কি হাসপাতালের ভিতরে আমাদের তো মারছেই সাথে ভর্তি সাধারন রোগীদের পর্যন্ত লাঠি পেটা করছে। সেদিন স্থানীয় আওয়ামীলীগের মাত্র ৪/৫ জন এবং আমরা ৩ জন হাসপাতালের ভিতরে লাঠি পেঠা খেয়েও দাঁড়িয়ে ছিলাম। এই ৭/৮ জন সিদ্ধান্ত নিলাম যত ইচ্ছা মারতে পারে মারুক তবু আমরা হাসপাতাল ছাড়বো না! জরুরী বিভাগে ডাক্তার নাই, সেবাদানকারী নার্স-বয় কেউ নাই! হাসপাতাল কোয়ার্টার থেকে এক ডাক্তারকে এক প্রকার টেঁনে হিঁচড়ে ধরে আনা হল। অক্সিজেন সিলিন্ডার নাই….! হাসপাতালের দোতলায় অপারেশন থিয়েটারের দরজার লক ভেঙ্গে আমি, সুজন ভাই এবং হাসান সিলিন্ডার বের করে আনি।

হবিগঞ্জ- ৩ আসনের বর্তমান সাংসদ ও জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি আবু জাহির চাচা ও রাজন ভাই মুমূর্ষ অবস্থায় ষ্ট্রেচারে পড়ে আছেন!
তৎকালীন স্পিকার ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারকে ফোন করা হল একটা হেলিকপ্টার যেন ব্যবস্থা করা হয়! মিঃ সরকার ধমকের সুরে জবাব দিলেন ‘এটা আমার কাজ নয়’। জেলা প্রশাসক এমদাদুল হক কে বলা হল, সেও রহস্যজনক ভাবে এড়িয়ে গেল! সেদিন রহস্যজনক ভাবে পুলিশ আমাদের লাঠিচার্জ করেছে, হবিগঞ্জে এ্যাম্বুলেন্স নেই!! ডাক্তাররা লাপাত্তা!
সেদিন এক টাকার ঔষধ কিবরিয়াসহ আহত কারো ভাগ্যে জুটে নাই , উল্টো প্রশাসনের মারমুখী আচরনে ভয়ে আহতরা হাসপাতাল ছাড়ে গিয়েছেন।

এ যেন নরকলীলা…..!
চোখের সামনে সেদিন কত কিছু ঘটতে দেখেছি; আজও ভাবি কেন এমন আচরন করলো?

দেখতে দেখতে ১৬/১৭ বছর হয়ে গেল! তবুও মনে হয় এইতো সেদিনের কথা।

আমি বৈদ্যেরবাজারে গ্রেনেড হামলার সুষ্ঠ ও সঠিক দ্রুত বিচার দাবি করছি। জনাব শাহ এএমএস কিবরিয়াসহ নিহত সকলের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। গ্রেনেড হামলায় সকল আহতদের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি । তীব্র যন্ত্রনাময় গ্রেনেডের স্পিন্টার নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর সুস্থতা ও দীর্ঘায়ুঃ কামনা করছি।

চৌধুরী ফরহাদ: রাজনীতিক, সাধারণ সম্পাদক, হবিগন্জ জেলা ন্যাপ

You might also like