স্মরণ: “তুমি যে চেয়ে আছ আকাশ ভরে”
দ্বীপা দাশ
“তুমি যে চেয়ে আছ আকাশ ভ’রে”-উক্ত পংক্তিটি রবি ঠাকুরের গানের। রাগ: সাহানা।
তাল: দাদরা। রচনাকাল তেরশো বিশ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসের তেরো তারিখ। গানটির প্রকাশনাকাল চৈত্রমাস চোখে পড়লেও আমার স্মৃতিতে পরশ বোলাচ্ছে ভাটির হাওরের এক প্রান্তিক গ্রামের বর্ষার শ্রাবণ মাসের। ষড়ঋতুর হিসেব মতে বর্ষাকালের শেষ মাস শ্রাবণ মাস। ঘরে ঘরে শ্রাবণী/মনষা দেবীর পূজার আমেজ। পূজা শেষে রাত্রিবেলা পদ্মপুরাণ পড়ার জন্য পাশের বাড়িতে ঘরের মহিলারা সবাই গিয়েছিলো। বয়সে ছোট হওয়াতে রাতের সময় আর পদ্মপূরাণ পড়তে না পারায়, বাবা আমাকে ওদের সাথে যেতে নিষেধ করছিলো। তখন আমি ঘরে বসে কাঁদছিলাম। ঐ সময়ে ভাইয়ার চোখে পড়ায় ভাইয়া নিজে আমাকে নিয়ে তাদের সঙ্গে বসিয়ে কিভাবে পদ্মপূরাণ পড়তে হয় শিখিয়েছিলেন। ভাইয়া পদ্মপূরাণ পড়তে অনেক সুন্দর সুন্দর দোহা শিখিয়ে দিতেন। শিখিয়ে দিতেন লয়,কায়দা,তাল সহ অনেক দিশা।
কথা বলছিলাম ভাইয়া কমরেড শ্রীকান্ত দাশকে নিয়ে। জন্ম ১৯২৪ সালের ৫ জুলাই সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা উপজেলার আঙ্গারুয়া গ্রামে। প্রয়াত ২০০৯ সালের ১৯শে নভেম্বর। মাতা জ্ঞানদায়িনী ও পিতা যোগেন্দ্র কুমার দাশের একমাত্র সন্তান ছিলেন। শৈশবেই বিশ্ব বরেন্য নেতাজী সুভাষ বসু, ইন্দিরাগান্ধি, সহ বহু রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জ্ঞানতাপসদের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন।
ভাইয়া সমাজতন্ত্রে একনিষ্ট সিপিবির নিভৃত মৌলিক মানুষ হলেও ঠাম্মা ছায়া রানীর নামে আনাতেন “একতা” পত্রিকা। তাছাড়াও সিলেট বা বাহিরে আসা যাওয়া করলে আনতেন দৈনিক পত্রিকা। ছোটকাকু যখন সিলেট থেকে বাড়ি আসতেন দেখতাম ভাইয়া আর ছোট কাকু সারা দিনরাত রাজনীতি আর রাজনীতির মাথ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন । বাপ-পুতে খেলতেন দাবা খেলা। আর ঠাম্মা আমাদের আঙ্গুল দিয়ে দেখাতেন দেখ- “ বাপ-পুতের কি ভাইয়াপ”(বন্ধুত্ব)। ভাইয়া প্রচুর বই পড়াশুনা করতেন। আমাদেরকে খেলায় মত্ত করে, অনেক সময় শীতের দিনে উঠানে পাটি(চাটি) বিছিয়ে আবার গরমের দিনে অনেক সময় গাছের নিছে বই-পত্রিকা এসব পড়তেন। পড়তে পড়তে ভাইয়া কিংবা খেলতে খেলতে আমরা যখন ক্ষুধার্ত হইতাম তখন মা,মনি(পিসি মনিকে আমরা শুধু মনি বলি) ওদেরকে কিছু খানা-খাবারের কথা বললে ওরা দিয়ে যেতো এবং দিলেই ভাইয়া নিজে খাইতেন এবং আমাদের খাওয়াইয়ে দিতেন। খেলার সুরতে খেলা-সুলভ শেখাতেন বিভিন্ন ছড়া-কবিতা। খেলতে গিয়ে ভাইয়া একটি ছড়াও শিখিয়েছিলেন। ছড়াটি হলো-
“ যে দিকেতে সূর্য্য ওঠে ইহাই পূর্বদিক
পশ্চিমিতে অস্ত যায় জানি আমি ঠিক।
উত্তরেতে শীতকালে শীতল বাতাস বয়
দক্ষিনেতে বসন্তে বয় রে মলয় “।
এই কবিতাটির কবির নাম কি যেমন জানিনা ঠিক কবিতাটি কি ভাইয়াই লিখেছেন তাও জানি না কিন্তু ভাইয়ার শেখানো উক্ত কবিতাটির প্রত্যেকটি লাইন আজও মনে রয়েছে।
মনে আসছে আমার গান শেখার প্রথম হাতেকড়ি হয় আমার ভাইয়ার হাতে। ভাইয়াই আমাকে প্রথম সা-রে- গা-মা শিখিয়েছিলেন। কিন্তু ভাইয়ার কাছে গান শেখা আমি সম্পূর্ন করতে পারিনি। সেদিন শ্রদ্ধাষ্পদ লেখক তাজুল দাদু এসে ভাইয়াকে আরো পরিস্কার ভাবে দেখিয়ে গেলেন। পারিবারিক ও একজন শিশুমনের অন্তরে জানার ও চিন্তার বাহিরে সমাজ বিনির্মানে ভাইয়ার সুচিন্ত মস্তিষ্কের প্রখরতা। দেখতে পেলাম ভাইয়ার হাতের স্বচ্ছ পরিস্কার লেখা। দারুন ভাবে শব্দ চয়নের ভঙ্গিমা।
ভাইয়া ভালভাবে জানতেন মটর সাইকেল,বাই সাইকেল দৌড়ানো। ছিলেন হোমিও চিকিৎস, ইনকামটেক্স লেখক ও ভাল মানের টেইলর। শুনেছি ভাইয়া টেইলারিং শিখেছিলেন তখনকার রাজধানী কলকাতা থেকে। ভাইয়া স্নো,পাউডার, ক্রিম,সেন্ট এই ধরনের কসমেটিক ব্যবহার করতে কখনো দেখিনি তবে হাতে হাত ঘড়ি দিতে পছন্দ করতেন। এখনো ট্রাংক খুললে ভাইয়ার বিয়ের হাত ঘড়ি আমরা দেখি। ভাইয়া ইস্ত্রি করা সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পড়তেন ও ব্যবহার করতে সাচ্ছন্দ বোধ করতেন রুমাল।
আমি তো ছোট ছিলাম তাই ভাইয়ার সাথে কোন জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার তেমন কোন সৌভাগ্য আমার হয়নি তবে একবার আমি দূর্গাপূজা দেখতে গিয়েছিলাম যা ছিল ভাইয়ার সাথে প্রথম ও শেষ দূর্গাপূজা(২০০৯)। দিনটি ছিলো দূর্গাপূজার নবমী দিন। ভাইয়া আমি আর আমার পিসতুতো(মনি) দু’বোনকে নিয়ে দূর্গাপূজা দেখার জন্য শাল্লা সদরে নিয়ে যান। দূর্গাপূজা দেখিয়ে আমাদেরকে ডুমরা মনির মেসোশ্বশুর এর বাড়িতে রেখে কি একটা দরকারে আবার বাজারে যান। আমরা প্রায় সারাদিন সেখানে ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করি। আনুমানিক সন্ধ্যার আগ-সময় ভাইয়া আমাদেরকে বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য সেখানে যান। মনির মেসোশ্বশুর আমাদেরকে তাদের বাড়িতে থাকার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু ভাইয়া বলেন বাড়িতে কেউ নেই তাই আমাদের নিয়ে বাড়িতে ফিরতে হবে। তাই আমরা বাড়িতে যাওয়ার জন্য উনাদের বাড়ি থেকে রওয়ানা হই। কিন্তু আমরা যখন ভাইয়ার ভাবশিষ্য ও উদীচী প্রিয়
প্রাণকৃষ্ণ কাকুর বাড়ির সামনে হাঁটা অবস্থায় দেখি ভাইয়ার শরীর খারাপের দিকে, ভাইয়া বলতেছেন( আমাদেরকে ভাইয়া সম্বোধন করে)আমি আর এখন হাঁটতে পারবোনা। একটু জিরিয়ে আবার হাঁটবো। কিছুক্ষন পর হাঁটার বদলে ভাইয়ার শরীর আরো খারাপ হতে থাকে এমনকি,দেখছি সঠিক ভাবে কথাও বলতে পারছেন না। সেখানে আমরা কাউকে তেমন চিন্তাম না।
তাই ভয় পেয়ে কাঁদতে শুরু করি। তখন প্রাণকৃষ্ণ কাকু আমাদের কাঁদতে নিষেধ করেন। ভাইয়াকে নিয়ে যাওয়া হয় শাল্লা সদর হাসপাতালে। সেখানকার ডাক্তার জানান এখানে চিকিৎসা হবে না, যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব ভাইয়াকে সিলেটে নিয়ে যেতে হবে। সংগে সংগে হাসপাতাল থেকে প্রাণকৃষ্ণ কাকু আরো কয়েকজনকে সাথে নিয়ে একটি ট্রলার রিজার্ভ করে সিলেটের দিকে রওয়ানা হন। এবং রাস্তায় আমাদেরকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যান। মনি (পিসি) ও ঠাম্মা একই ট্রলারে ভাইয়ার সাথে সিলেটে যান। এর মাস-কয়েকদিন পর ভাইয়া আমাদেরকে চিরদিনের মতো ছেড়ে চলে যান।
ভাইয়ার মৃত্যুর সময় আমি এতোটাই ছোট ছিলাম যে ভাইয়ার মৃত্যু খবর শুনে মনি যেভাবে কাঁদছিলেন আমি মনিকে অনুসরণ করে ঠিক সেভাবেই কাঁদতে লাগছিলাম।
ভাইয়া কী-ধরনের মানুষ ছিলেন তখন বোঝিনি। ছোট বেলা থেকে আমি আমাদের বাড়িতে ভাইয়ার শুয়ে থাকার পালং-এর(চৌখি) এক প্বার্শে বিশ্বের বিখ্যাত কয়েকজন মনীষীদের ছবি দেখে আসছি।
যাঁদের মধ্যে রয়েছেন বিশ্ব মানবতার সাম্যের অন্যতম ও সমাজতন্ত্রের চিন্তক ফ্র্যাডরিক এঙ্গেলস,কার্ল মার্ক্স,বিশ্ব শ্রমিক শ্রেনীর মহান নেতা ও রুশ বলশেভিক বিপ্লবের মহানায়ক ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানড লেনিন। দেশ বরেণ্য ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছে কমরেড মনি সিং,ঊদীচীর প্রতিষ্ঠাতা সত্যেন সেন,রণেশ দাশগুপ্তদের মতো সমাজ হিতৈষী মহামানবদের ছবি। সত্যি বলতে কি ভাইয়ার প্রতিটা বিষয়ে ইতিহাসের গন্ধ পাই। দেশ,মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম,রাজনীতি ভাইয়ার জীবনের প্রতিটা বাকে ইতিহাসের রন্ধ্রে।
ভাইয়া এমন এক ব্যক্তি যিনি অজো পাড়া গাঁয়ের মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে হয়েও দেশ বরেণ্য ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। আমি আমার বাবার কাছ থেকে শুনেছি ভাইয়া একবার রিক্সা করে সিলেটের কোন এক জায়গায় যাচ্ছিলেন। সেদিন ছিল ২১শে ফেব্রুয়ারি। হঠাৎ তিনি রাস্তার মধ্যে দেখলেন একদল শিশুরা প্রভাতফেরীর রেলী করে যাচ্ছে। এই রেলী দেখা মাত্র তিনি রিক্সা থেকে নেমে পড়লেন এবং নিজের জুতা বগলে নিয়ে তিনিও শিশুদের সাথে প্রভাতফেরীতে যোগদিলেন। এ থেকে বুঝা যায় তিনি নিজের দেশকে ও ভাষাকে কতোটুকু ভালবাসতেন। তিনি মানুষকে এতোটাই ভালবাসতেন যে নিজের দেহ মানুষের কল্যাণের জন্য দান করে যান। যা সাধারণ সমাজ ব্যবস্থায় এখনো কল্পনীয়।
ভাইয়ার একটি শোকসভায় উপস্থিত হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। এটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল সিলেট সিটি কর্পোরেশন হলরুমে ২৩/০১/২০১০ সালে। সেখানে রাজনীতিক, সামাজিক,সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গের আলোচনা এবং শিশুচোখে দেখা বাড়িতে জ্ঞানতাপসদের আনাগোনা পদার্পনে, সত্যি আজ এসে বুঝতে পারলাম ভাইয়া ছিলেন এক অনন্য চরিত্রের অধিকারী।
আজ সমাজকর্মের মতো পঠিত বিষয়ে যখন বিদ্যাপীঠের এক বিল্ডিং হতে আরেক বিল্ডিংয়ে যাই, খেতে বসে যখন হোস্টেলে প্রতিদিনের সংবাদপত্র হাতে নেই, পড়তে বসে যখন বইয়ের পাতা উল্টাই কিংবা হোস্টেলের বারান্দা হতে গভীর চন্দ্রিমার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারটি চোখে পড়ে তখন প্রতিটা পরতে পরতে বুঝি উঁকি দেয় ভাইয়াকে নিয়ে রবি ঠাকুরের গানের পংক্তিদ্বয় “তুমি যে চেয়ে আছ আকাশ ভরে, নিশিদিন অনিমেষে দেখছ মোরে॥”
লেখক পরিচিতি- দ্বীপা দাশ
স্নাতক ২য় বর্ষ(সম্মান) সমাজকর্ম বিভাগ।
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর।
(কমরেড শ্রীকান্ত দাশের জেষ্ঠপুত্রের ১ম তনয়া)