হাওর বাংলার পরাণ পাখি (১৯৬৩-২০২০)
অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ মনির উদ্দিন
হাওর বাংলায় সম্পদ ভরপুর কতো কিছু। এসব সম্পদে একদিন সম্পন্ন হবে সকল হাওর জনপদ, মানুষ। এমন স্বপ্ন দেখার একজন সাহসী মানবিক বিপ্লবী পরাণ পাখি মইনুদ্দিন আহমদ জালাল হঠাৎ উড়াল দিয়ে কোথা যে হারিয়ে গেলেন।
মইনুদ্দিন আহমদ জালাল মানেই যেন মহাকাশসম অন্তর। বড় বেশি অসময়ে তাঁর চলে যাওয়া। হাওর ঋষি-মানব বরুণ রায়ের কাছে তিনি নিয়েছিলেন মানুষ, জীবন, সমাজ, পৃথিবীকে ভালোবাসার পাঠ। পার্থিব বিষয় সম্পদ তাকে এতটুকু টানেনি কখনও। তিনি নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সবার জন্য। তাঁর আবেষ্টন আর বাতাবরণ ছিলো হাওর বাংলা আর মাতৃভূমি ছাড়িয়ে পৃথিবী জুড়ে। অকালে এমনি চলে যাওয়ায় কেঁদেছে মানুষ এবং প্রকৃতি। কেঁদেছে সুরমা-কুশিয়ারা জলপ্রবাহ। নিদানকালে পরম নির্ভরতার কাণ্ডারী মানুষটির আকস্মিক প্রয়াণে তাই স্বজন হারানোর বেদনায় কষ্টনীল হয়েছে অজস্র স্বজন পৃথিবী প্রান্তর জুড়ে।
চিরতারুণ্যে অমিত তেজি যুবনেতা মইনুদ্দিন আহমদ জালাল! তাঁর কর্ম ও স্মৃতি সমাজের সর্বব্যাপী বিস্তৃত। ব্যক্তি ও পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন না কখনও। ব্যক্তিকে খুঁজে নিয়েছিলেন সমষ্টির মাঝে। তাঁর সবকিছু ছিলো সর্বজনীন। এবং নৈতিক ও মহান আদর্শের। সমাজপ্রগতির সংগ্রামকে আদর্শ হিসেবে দীক্ষা নিয়েছিলেন দুরন্ত-কৈশোর থেকেই। অসীম সাহসে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো এক উত্তম বিরল যুবরাজনীতিবিদ। চিরযৌবনের সারথিদের যুথবদ্ধ করে কর্মসৃজন করেছেন বিশ্ব-মানবিকতার।
জীবনের পাঠশালা ছিল তাঁর ছাত্র ইউনিয়ন। তারপর যুব ইউনিয়ন। সাম্যময় এক পৃথিবীর স্বপ্নে নিমজ্জমন তাঁর দিনরাত্রি। তিনি প্রকৃতি-পরিবেশের সপক্ষ অবস্থান নিয়েছিলেন সাম্য পৃথিবীর আকাংখার সাথে সুসমঞ্জস থেকেই। তিনি ছিলেন সাহসী ঝড় আর ঝড়ের খেয়া। কখনো একা হলেও দানবের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে এতটুকু দ্বিধা করেননি।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও শোষণ-বঞ্চনামুক্ত রাষ্ট্র বিনির্মাণের এই সমাজবিপ্লবী মইনুদ্দিন আহমদ জালাল গত ১৮ অক্টোবর ২০১৮ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার সকালে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলংয়ে আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। মাত্র চুয়ান্ন বছর বয়সেই এই সুরমা সন্তানের চলে যাওয়া।
প্রয়াত মইনুদ্দিন আহমদ জালাল’র বংশপরম্পরার নিবাস সিলেট শহরের প্রান্তিক দক্ষিণসুরমা উপজেলার তেতলী ইউনিয়নের ধরাধরপুর গ্রামে। হাজি ইছকন্দর আলী ও সিতারা খানম’র পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি পুত্রসন্তান ছিলেন। পাকিস্তান আমলের শুরুরদিকে জীবিকার প্রয়োজনে তাঁর বাবা-চাচা সুনামগঞ্জ শহরে ঠাঁই নেন। সেখানেই ১৯৬৩ সনের ২৪ ডিসেম্বর মইনুদ্দিন জালাল জন্মগ্রহণ করেন। পিটিআই প্রাথমিক বিদ্যালয়, বিসি হাই স্কুল শেষে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে পড়াশোনা করেন। স্কুলের ছাত্র হিসেবেই প্রগতিশীল শিশু-কিশোর সংগঠন খেলাঘরের সাথে তিনি যুক্ত হন।
স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়ে ১৯৮৩ সালে একমাস সুনামগঞ্জ জেলে কারাভোগ করেন। পাঠশালা, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক সুনামগঞ্জ থেকেই পাশ করে এম.সি. কলেজ সিলেটে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে সিলেট ছাত্র ইউনিয়ন’র সাথে সম্পৃক্ত হয়ে ছাত্র-আন্দোলনে কাজ করতে থাকেন। এরপরে ১৯৯২ এবং ১৯৯৭ সালের সম্মেলনে বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন সিলেটের পরপর দু’বার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন’র সভাপতিম-লীর সদস্য হিসেবে একাধিকবার দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করেছেন। বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন’র প্রতিনিধি হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিম-লে প্রায় ৩২টি দেশে প্রতিনিধিত্ব করেছেন এবং বিশ্বের প্রায় ৬২টির মতো দেশ ভ্রমণ করেছেন। উল্লেখ্য যে, ডব্লিউএফডিওয়াই কর্তৃক আয়োজিত ১৪তম বিশ্ব ছাত্র ও যুব উৎসব ১৯৯৭ সালে কিউবার হাভানা, ১৫তম ২০০১ সালে আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্স, ১৬তম ২০০৫ সালে ভেনিজুয়েলার রাজধানী কারাকাস, ১৭তম ২০১০ সালে সাউথ আফ্রিকার প্রেটোরিয়া শহরে, ১৮তম ২০১৩ সালে ইকুয়েডর, ১৯তম ২০১৭ সালে রাশিয়ার সোচি শহরে অনুষ্ঠিত হয়। সবকটি উৎসবের প্রতিনিধি দলের মূল ভূমিকা পালন করেন তিনি। ২০০৬ সালে তিনি বিশ্ব সোশাল ফোরাম পোট এলিগ্রো, ব্রাজিলে বাংলাদেশ থেকে একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন।
স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র সাথে হয়ে কাজ করেছেন। আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ আমাদের জনগণের। ঢাকা-সিলেট তের দিনের পদযাত্রায় সিমিটার কোম্পানির লুণ্ঠন পরিকল্পনাকে ধ্বসিয়ে দিয়েছিলো সেসময়কার বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন। যে সংগ্রামে লীন ছিলেন সহযোদ্ধা জালাল। সমাজের বিভিন্ন অংশকে যুক্ত করে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। গণআন্দোলনের মুখে সিমিটারের সাথে ভুয়া চুক্তি বাতিল হয়েছে। গঠিত তদন্ত কমিশনের মাধ্যমে মামলা করে সিমিটারের হাত থেকে বাংলাদেশের জাতীয় সম্পদ রক্ষা করে বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন। এটা ছিল প্রথম জাতীয় সম্পদ রক্ষা আন্দোলন। বহুজাতিক গ্যাস কোম্পানি সিমিটার বিরোধী আন্দোলন সিলেটে তিনি যুক্ত ছিলেন। বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন ১৯৯৭ সালে মৌলভীবাজারের মাগুরছড়ায় গ্যাস পুড়িয়ে ধ্বংস করার প্রতিবাদে আন্দলন, ২০০২-২০০৩ সালে গ্যাস রফতানী করার প্রতিবাদে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র রক্ষার আন্দোলন, ২০০৫ সালে টেংরাটিলা গ্যাস বহুজাতিক কোম্পানি কর্তৃক পোড়ানো, জাতীয় স্বার্থবিরোধী ২০০৫ সালে ফুলবাড়ি কয়লা খনি থেকে উম্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের বিরুদ্ধে সংগঠিত আন্দোলন, ২০১৩ সালে সুন্দরবন রক্ষার প্রতিবাদসহ প্রতিটি গণ ও ন্যায্য সংগ্রামে তিনি নানাভাবে সক্রিয় ছিলেন।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হলসমূহ নামকরণের সেই উত্তাল সময়ে সিলেট দেখেছে অনন্য এক যুবনেতা জালালের দীপিত পথচলা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৯ সালে ৮৭তম সিন্ডিকেট সভায় বিভিন্ন হলের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাহানারা ইমামসহ অন্যান্যের নামে নামকরণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিলো। মৌলবাদী সংগঠন জামায়াত-শিবির নামকরণ বিরোধী আন্দোলন শুরু করলে ২০০০ সালের ০৬ মে ৮৯তম সিন্ডিকেট সভায় হলের নামকরণে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ স্থগিতাদেশ জারি করেন। সিলেটে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের নামকরণ নিয়ে কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ আহুত অনশন আয়োজন করেছিলেন। মইনুদ্দিন আহমদ জালাল’র নেতৃত্বে যুব ইউনিয়নের বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী এতে অংশগ্রহণ করেছিলো। এ অনশন আয়োজনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন মইনুদ্দিন আহমদ জালাল’র নেতৃত্বে বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’র বিভিন্ন হলের নামকরণ বিরোধী বিশেষ মহলের আন্দোলনকে প্রতিহত করতে তিনি জীবনবাজী রেখে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিলেন। সিলেটের সিংহবাড়ি রক্ষা, অর্পিত সম্পত্তি প্রতিরোধ আন্দোলনে তাঁর অংশগ্রহণ ছিলো সুচিহ্নিত।
বরাক-সুরমা-মেঘনার টুঁটি টিপে ধরার বেনিয়া প্রকল্প টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের এতটুকু ভিত্তিপ্রস্তর আজো গড়তে পারেনি বাংলাদেশ এবং ভারতের মনিপুর অঞ্চলের গণমানুষের মিলিত সংগ্রামের ফলশ্রুতিতে। আর বাংলাদেশ তথা সিলেট অঞ্চলে অঙ্গীকার বাংলাদেশের প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসাবে টিপাইমুখ বাঁধ প্রতিরোধের বীরসেনানী ছিলেন উজানমাঝি মইনুদ্দিন আহমেদ জালাল। সারা পৃথিবীতে বাঁধবিরোধী সংগ্রামে এমন সাফল্য বিরল। পরিবেশ-প্রতিবেশ, প্রকৃতি ও নদী রক্ষায় তিনি নানা অভিনব প্রতিবাদ কর্মসূচি অঙ্গীকার বাংলাদেশ সংস্থার মাধ্যমে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের গণমানুষকে সচেতন করেছিলেন।
মইনুদ্দিন আহমদ জালাল তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ ঢাকা থেকে স্নাতকোত্তর এবং ঢাকা ল কলেজ থেকে এলএল.বি পাশ করেন। তিনি ১৯৯৪ সালে ৩০ এপ্রিল বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে নিবন্ধিত হয়ে সদস্যপদ লাভ করেন। সিলেট আইনজীবী সমিতিতে ১৯৯৪ সালের ১৯ মে যোগদান করেন। একাধারে সুনামগঞ্জ আইনজীবী সমিতি এবং সিলেট কর আইনজীবী সমিতির সদস্য ছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সুনামগঞ্জের জনপ্রিয় গণমাধ্যম সুনামগঞ্জের খবর পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক ছিলেন। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ড পৃষ্টপোষকতা ও জড়িত থেকে কাজ করেছেন। সিআরপি (পক্ষঘাতগ্রস্থদের চিকিৎসা কেন্দ্র)কে সিলেটের চণ্ডিরপুলনামক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পয়ত্রিশ শতক ভূমি দান করেছেন। ইছকন্দর-সিতারা সিআরপি সিলেট শাখা হিসেবে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
মইনুদ্দিন আহমদ জালাল আজ দৈহিকভাবে অনুপস্থিত। তাঁর কর্ম ও অবিনাশী প্রেরণা বিদ্যমান আছে। তাঁর সত্য-সাহস মনন-মগজে মাথা উঁচিয়ে ঋজু হয়ে পথ চলার এক অনন্য পাথেয়। এবং প্রাণস্পর্শ বাতিঘর হয়ে আলো দেখাবে দ্রোহী তারুণ্যকে। আদর্শের অঙ্গীকার হয়ে রইবেন যুগ-যুগান্তর। আজীবন সমাজপ্রগতির কাজে নিজেকে নিবেদিত করে একটি প্রগতিশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে অনন্যমাত্রায় অধিষ্টিত করে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন।
আজ তাঁর প্রয়াণের দুই বছর। মানবিক বিপ্লবী মইনুদ্দিন আহমদ জালালকে জানাই সশ্রদ্ধ অভিবাদন।
(লেখক: আইনজীবী, প্রাক্তন সদস্য, সিপিবি, সিলেট জেলা কমিটি)