১/১১ এ লন্ডন ক্যাম্পেইন, অতঃপর শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
সত্যবাণী

লন্ডন:  ৭ মে’ ২০০৭ সাল। ১/১১ খ্যাত তৎকালীন তত্বাবধায়ক সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে লন্ডন হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন শেখ হাসিনা। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা শেষে শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরাকালে তদানীন্তন তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাঁর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার ঐকান্তিক দৃঢ়তা, ব্রিটেনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত অভিবাসী বাংলাদেশী ও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর রাজনীতিকসহ গণতন্ত্রকামী দেশবাসীর চাপে শেষ পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

দেশে ফেরার পথে শেখ হাসিনা লন্ডনে অবস্থান করেন বেশ কিছুদিন। এই সময়ে ব্রিটেনের রাজনীতিক ও এমপিসহ প্রবাসে সক্রিয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা তাঁর দেশে ফেরার দৃঢ় অঙ্গীকারের সমর্থনে পাশে দাঁড়ান শেখ হাসিনার। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানার নেপথ্য উৎসাহ ও পরামর্শে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নেত্রীর দেশে ফেরার পক্ষে বাংলাদেশের অগণতান্ত্রিক সরকারের উপর চাপ প্রয়োগের জন্য ব্রিটিশ সরকার ও রাজনীতিকদের কাছে লাগাতার ক্যাম্পেইন চালাতে থাকেন।  জাতীর জনকের পদস্পর্শধন্য , মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজরিত লন্ডনের ঐতিহাসিক দিলচাঁদ রেষ্টুরেন্ট এসময় হয়ে উঠে ক্যাম্পেইনের অন্যতম লিয়াজো কেন্দ্র। রেষ্টুরেন্টটির অন্যতম স্বত্বাধিকারী যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের তৎকালীন অন্যতম শীর্ষনেতা পরবর্তীতে সিলেট-২ আসনের এমপি শফিকুর রহমান চৌধুরী তখন দেশের মাটিতে অগণতান্ত্রিক তত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে জনমত সংগ্রহে ব্যস্থ। তিনি স্বশরীরে উপস্থিত নেই তো কি হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধসহ বাঙালির বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে প্রবাসীদের অন্যতম শলাপরামর্শের কেন্দ্রস্থল দিলচাঁদ রেষ্টুরেন্ট তখন আবারও  হয়ে উঠে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র। এই কেন্দ্রে নিয়মিতই আন্দোলন নিয়ে পরামর্শে মিলিত হন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা আলহাজ্ব শামসুদ্দিন খান, সুলতান শরীফ, অধ্যাপক আবুল হাশেম, এম এ গনি, জালাল উদ্দিন, হরমুজ আলী, সাবেক কাউন্সিলার এম এ রহিম, সৈয়দ ফারুক, নঈমুদ্দিন রিয়াজ, মারুফ চৌধুরী, সৈয়দ আবুল কাশেম ও তৎকালীন যুবনেতা আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীসহ অনেকেই।

পূর্ব লন্ডনের দিলচাঁদ রেষ্টুরেন্টে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছেন শেখ হাসিনা। পাশে বোনঝি আজমিনা সিদ্দিক রুপন্থী, বোন শেখ রেহানা ও সমকালের তৎকালীন লন্ডন করেসপন্ডেন্ট ও বর্তমানে সত্যবাণীর প্রধান সম্পাদক সৈয়দ আনাস পাশা।

বাংলাদেশ সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারনে দেশে যাওয়ার উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনা লন্ডন  হিথরো বিমান বন্দরে পৌছার পরও ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ তাঁকে বোর্ডিং পাস দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় বাধ্য হয়ে এয়ারপোর্ট থেকে ফেরত আসেন শেখ হাসিনা।

লন্ডনের বাংলা মিডিয়ার সাংবাদিকরা তখন বঙ্গবন্ধু কন্যার সাথে কথা বলতে উদগ্রীব। এমনি এক সময়ে পিতা বঙ্গবন্ধুর পদস্পর্শধন্য দিলচাঁদ-এ সিনিয়র সাংবাদিকদের শুধুমাত্র ভোজ ও সৌজন্য আড্ডার শর্তে মিলিত হন শেখ হাসিনা। তাঁর পাশেই অবস্থান নেন বোন শেখ রেহানা ও বোনঝি আজমিনা সিদ্দিক রুপন্থী। আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে সাংবাদিকরা বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চান শেখ হাসিনার কাছে, কিন্তু রাজনীতি নিয়ে কোন কথাই বলছেন না তিনি। এমনি এক পর্যায়ে সমকাল-এর লন্ডন করেসপন্ডেন্ট ও বর্তমান সত্যবাণীর প্রধান সম্পাদক সৈয়দ আনাস পাশা পাশেই উপবিষ্ট শেখ রেহানাকে কানে কানে বলেন, ‘আপা, দেশের পত্রিকাগুলো নেত্রীর প্রতিক্রিয়া জানতে উদগ্রীব। আমাদের চাকুরী রক্ষার স্বার্থে হলেও অন্তত নেত্রীর কিছু বলা উচিত।’  শেখ রেহানা তখন বোনকে হেসে হেসে বলেন, ‘আপা তাদের চাকুরীই নাকি ঝুকিতে, কিছু একটা বলো।’ এরপরও যখন কথা বলছিলেন না শেখ হাসিনা, তখন সৈয়দ আনাস পাশা তাঁর উদ্দেশ্যে বলে উঠেন, ‘আপা, তত্বাবধায়ক সরকার মাইনাস-২ ফর্মূলা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করছে। আপনি নাকি বলেছেন মাইনাস-২ নয়, মায়নাস-১ হলে আপনি রাজি আছেন?’ সাথে সাথেই তীব্র প্রতিবাদ করে উঠেন শেখ হাসিনা। কথা বলা শুরু করেন। বলেন, মাইনাস-১ এর কথা বলেছি আমি, এমন অভিযোগ ডাহা মিথ্যে।’ উত্তরে সৈয়দ আনাস পাশা বলেন, ‘এই মিথ্যে অভিযোগ আসলে আমিই উত্তাপন করেছি শুধুমাত্র আপনাকে কথা বলানোর জন্য, সরি।’ হেসে উঠেন সবাই, কথা বলা শুরু করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, বন্দী সব রাজনৈতিক নেতাকর্মীর মুক্তি ও গণতান্ত্রিক অধিকার চাই আমি। আমার বাবা বাঙালির মুক্তির লক্ষ্যে তাঁর জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দিয়েছেন, কারো রক্তচক্ষুর পরোয়া করেননি। আমি সেই বাবার সন্তান। দেশ ও জনগনের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে আনতে আমিও জীবন দিতে প্রস্তুত, হুমকি ধামকি ও রক্তচক্ষু দেখিয়ে লাভ নেই। ঐদিনই শেখ হাসিনা অবিলম্বে নির্বাচনের তারিখ ঘোষনা দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ দ্রুত প্রসস্থ করার দাবি জানান  ১/১১ এর তত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি।

এরপরতো বাকী ইতিহাস। বিশ্ব জনমতের চাপে শেখ হাসিনার দেশে ফেরার নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন সরকার। জরুরি অবস্থার মধ্যেই যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের বেশ কজন নেতাকর্মী পরিবেষ্টিত হয়ে ৭ই মে ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণ করেন শেখ হাসিনা,  লাখো জনতা জানায় তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে মিছিল শোভাযাত্রা সহকারে তাকে ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবনে নিয়ে আসা হয়। পরবর্তীতে তত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই গ্রেফতার করে তাঁকে। তাঁর সঙ্গী হয়ে দেশে যাওয়া যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতাদেরও করা হয় গ্রেফতার। গ্রেফতার হন, লন্ডনে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন আন্দোলনের ক্যাম্পেইন কেন্দ্র দিলচাঁদ রেষ্টুরেন্টের স্বত্বাধিকারী, যুক্তরাজ্য ও সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের নেতা শফিকুর রহমান চৌধুরীও।

২০০৮ সালের ১১ জুন প্যারোলে মুক্তি পাওয়ার আগ পর্যন্ত কারান্তরীণ রাখা হয় শেখ হাসিনাকে। প্যারোলে মুক্তি পেয়ে চিকিৎসার জন্য তিনি বিদেশ যান এবং চিকিৎসা শেষে ৪ ডিসেম্বর দেশে ফিরে আসেন আবার।

অতঃপর আন্দোলনের মুখে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয় জোরপূর্বক রাষ্ট্র ক্ষমতায় চেপে বসা তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট।

You might also like