২০ শে মে চুকনগর গণহত্যা দিবস

পাকিস্তানী হানাদার বাহিনি ন্যূনতম দশ হাজার মানুষকে হত্যা করে লাশ ভাসিয়ে দিয়ে রক্তাক্ত করেছিল চুকনগরের ভদ্রা নদী 

নিলুফা ইয়াসমীন 
বার্তা সম্পাদক,
সত্যবাণী

লন্ডন: মানব ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ এবং বীভৎস গণহত্যা ঘটেছিল ১৯৭১ সালের ২০শে মে খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগরে। সেদিন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনি ন্যূনতম দশ হাজার মানুষকে হত্যা করে লাশ ভাসিয়ে দিয়ে রক্তাক্ত করেছিল চুকনগরের ভদ্রা নদী।

চুকনগর গণহত্যা ও জেনোসাইডের ৫১ বছর উপলক্ষে জাতিসংঘ কর্তৃক এই গণহত্যার স্বীকৃতির দাবীতে  আগামী ২০শে মে বাংলাদেশ সময় সকাল এগারটায় চুকনগর ভদ্রা নদীর তীরে হাজার হাজার শহীদের প্রতি পুষ্প – শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ করা হবে।

অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল, মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, ১৯৭১: গণহত্যা- নির্যাতন আর্কাইভ ও যাদুঘর, উত্তরবঙ্গ মিউজিয়াম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ, যশোর উদীচীসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত থাকবেন।

‘আমরা একাত্তর’ এবং ‘যশোর উদীচী’র যৌথ উদ্যোগে ২০ শে মে সন্ধ্যায় চুকনগর বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে লাইট এন্ড সাউন্ড যোগে চুকনগর বর্বর হত্যাকান্ড কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হবে।

চুকনগর গণহত্যার দিন-২০ মে বৃহস্পতিবার

খুলনা জেলার ডুমুরিয়া, বটিয়াঘাটা, দাকোপ, বয়রা এবং বাগেরহাট জেলার রামপাল, ফকিরহাট, মংলাসহ বৃহত্তর ফরিদপুর ও বরিশাল জেলার অগণিত নির্যাতিত পরিবার দেশ ত্যাগের উদ্দেশ্য নিয়ে একাত্তরের ২০শে মে চুকনগরে পৌঁছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চুকনগর জনসমুদ্রে রূপ নেয়। দীর্ঘ পথ চলার ক্লান্তিতে সবাই অবসন্ন। অনেক পরিবার খাবারের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এমন সময় এগারোটা নাগাদ সাতক্ষীরা সড়ক ধরে পাক বাহিনির দুটি ট্রাক বর্তমান চুকনগর কলেজের (৭১-এ কলেজ ছিল না) পশ্চিম পাশে কাউতলার এসে পৌঁছে।

ট্রাক থেকে নেমেই পাক সেনারা গুলি করতে শুরু করে। পরবর্তী তিন/চার ঘন্টার পাক বাহিনির নারকীয় হত্যাযজ্ঞে চুকনগর পরিণত হয় এক মৃতের জনপদে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কয়েক হাজার লোক লাশে পরিণত হয়ে যায়। যে যেদিকে পারছে ছুটছে দিগবিদিক, জ্ঞান নেই। পায়ের নীচে লাশ, রক্তের নহর। পেছনে তাড়া করছে মৃত্যু। পাশ্ববর্তী তিনটি পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ছে হাজার হাজার মানুষ। মাঠে লাইন করে দাঁড় করিয়ে হত্যা করেছে। পুকুরের চারদিকে ঘেরাও করে রেখেছে, পানি থেকে কেউ মাথা উঠালেই গুলি করে মেরেছে। এক সময় পুকুরের পানি রক্তে লাল হয়ে যায় ।

গাছের উপর যারা লুকানোর চেষ্টা করেছিল, তাদের পাখির মত গুলি  করে মেরেছে। এক একটি গুলিতে কয়েকটি করে লাশ মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। কয়েক ঘন্টা গোলাগুলির পর হানাদার বর্বর বাহিনী গুলি খরচ করতে চায়নি, বরং বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছে। গণহত্যা চালাবার সময়ও পাকবাহিনির নৃশংস ধর্ষণ কার্য বন্ধ হয়নি।

চুকনগর গণহত্যার সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহের জন্য দু’হাজার সালের ৮ ও ৯ সেপ্টেম্বর  চুকনগর কলেজ এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’দিনব্যাপি ‘মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্প’ আয়োজন করে । চুকনগর গণহত্যার প্রতক্ষদর্শী প্রায় দু’শ জনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয় সেই সময়ে।

চুকনগর হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দী

পূর্ণ চন্দ্র রায়: পিতা-মৃত প্রসন্ন কুমার রায়, বয়স ৮০, গ্রাম বয়ার গঙ্গা, থানা বটিয়াগাটা। ‘জৈষ্ঠ্য মাসের ৫ তারিখ বৃহস্পতিবার সকালে চুকনগর এসে পৌঁছাই। লোকজনের মধ্যে একটা ভয় ভাব দেখতে পেলাম। বেলা ১১ টার দিকে চুকনগরের পূর্ব-দক্ষিণ কোণ থেকে গুলির আওয়াজ আসে। কেউ বলছে পাকবাহিনি, ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কিন্তু গুলির শব্দ যখন ক্রমশ: নিকটবর্তী হচ্ছে তখন আর ধৈর্য ধরে থাকতে পারলাম না। আমরা নদীর ওপারে যাবার জন্য তৈরী হই। বড়দা আর আমার এক খুড়তুত ভাই বললো, আমরা তো বুড়ো মানুষ, মারে তো যুবকদের, আমাগো মারবে না। এ দৃঢ় বিশ্বাস থেকে তারা রয়ে গেলেন। আমি ছেলেমেয়েসহ নদীর গর্তের মধ্যে লুকালাম। যদিও জানতাম যে জৈষ্ঠ্য মাসে লোনার সময়ে নদীতে কুমির থাকে। প্রাণের ভয়ে আর কোন বিকল্প চিন্তা মাথায় আসেনি। এই অবস্থায় শুনলাম নদীতে গুলি করতে পাকবাহিনি এগিয়ে আসছে। বুঝলাম, এখানে থাকলে গুলি খেতে হবে। তখন নৌকা দিয়ে নদীর উত্তর পাড়ে গিয়ে নামলাম। সংবাদ পেলাম ডাঙ্গা দিয়ে ওরা আসছে গুলি করতে করতে।

একজন এসে জানালো যে, আমার দাদা পাকবাহিনির গুলিতে মারা গেছেন। দাদার মৃত্যু সংবাদ শুনে ঠিক করলাম, লাশ দেখতে যাই। এসে যে বীভৎস দৃশ্য দেখলাম সে  দৃশ্য জীবনে কোনদিন দেখি নাই। গুলি খাওয়া মানুষের রক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। আর আহত মানুষ কেউ হাত নাড়ছে, কেউ মাথা নাড়ছে। আমি তখন ঐ একেকটা আহত, নিহত লোকের উপর দিয়ে ডিঙ্গিয়ে সেখানে যেয়ে দেখি আমার খুড়তুত দাদা, আমার ভাই ওনাদের বুকে গুলি লেগেছে। যেদিকে তাকাই কেবল লাশ আর লাশ। ছোট ছোট বাচ্চা মরা মায়ের বুকের ওপর দুধ খাচ্ছে। লাশের গন্ধে গ্রামে বসবাস অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তাই আমাদের পরিবার সবাই ভারতে চলে গেলাম।’

স্বরস্বতী মন্ডল : বয়স ৫০। গ্রাম আলদিপুর, ইউনিয়ন মাগুরাঘালি

 ‘মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই রাজাকাররা বিভিন্ন গৃহস্থালি সামগ্রী, গরু-ছাগল, নিয়ে যেতে থাকে। বৈশাখ মাসের শেষ দিকে রাজাকাররা ধরে ধরে জবাই করতে শুরু করে। আমাদের গ্রামের খোকন মিয়া, ইউসুফ মিয়াসহ সর্দার বাড়ির বাবুদের খুন করে। এই ঘটনার তিনদিন পরে পালিয়ে ভারতে যাবার উদ্দেশ্যে পরিবারের সবাই জৈষ্ঠ্য মাসের চার তারিখে চুকনগরে যাবার জন্য রওনা হই। পরের দিন সকাল ১০টার দিকে চুকনগরে পৌঁছাই। এমন সময় দেখলাম, পাকা রাস্তা ধরে মিলিটারির গাড়ি এসে থামলো। ১০/১২ জন খান সেনা রাইফেল হাতে লাফিয়ে নামলো। নেমেই গুলি করা শুরু করলো।

আমার একটা মেয়ে ছিল পাঁচ মাস বয়সের। সেই মেয়ে নিয়ে পুটিয়ার খালে লুকালাম। এভাবে বহুকষ্টে নিজের জীবন রক্ষা করলাম। গোলাগুলি বন্ধ হলে জানলাম আমার স্বামী এবং শশুরকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্য করেছে। আমার মনে হয় আট/নয় হাজার মানুষ সেদিন হত্যার শিকার হয়। কারণ যেদিকে তাকিয়েছি শুধু  বেশুমার লাশ দেখেছি, বিশাল প্রান্তর লাশ আর রক্তে পূর্ণ ছিল। মহিলা এবং তরুণীদের পাকবাহিনি ধরে নিয়ে যায়।’

‘আমরা একাত্তর’ এর  উদ্যোগে ২০মে চুকনগরের গণহত্যা ও জেনোসাইড এর স্থল  খুলনার  চুকনগরে সমবেত হবার উদ্যেশে গত ৯ই মে ভার্চুয়াল  পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে অংশগ্রহণ ছিল খুবই উৎসাহজনক। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, খুলনার গণহত্যা মিউজিয়াম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ, উত্তর বঙ্গ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এর  সবাই অংশগ্রহণ করেছিলেন। এতে যুক্ত হয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ডঃ নুরুন নবী, যুক্তরাজ্য থেকে আনসার আহমেদ উল্লাহ ও সত্যব্রত দাস স্বপন, সিঙ্গাপুর থেকে প্রদীপ কুমার দত্ত। চুকনগর, খুলনা, যশোর সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যোগ দিয়েছিলেন অনেকে। তাঁরা সবাই মুক্তিযুদ্ধ, এর ইতিহাস, গণহত্যা, নতুন প্রজন্মের কাছে একাত্তরকে তুলে ধরার  কাজে নিয়োজিত। সকলের পরামর্শ ও বক্তব্যের ভিত্তিতে ২০ মে চুকনগরের কর্মসূচি প্রনয়ণ করা হয়েছে।

ইতোমধ্যে ‘আমরা একাত্তর’-এর পক্ষ থেকে কর্মসূচী পালনে প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। যশোর জেলা উদিচী, রোটারি ক্লাব সহ অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। স্থানীয় প্রশাসন, স্কুল, কলেজ, জনগণও উৎসাহ নিয়ে যুক্ত হচ্ছে। ‘আমরা একাত্তর’ সবাইকে একত্রিত করে, সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যেতে চায়। সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে ইতিহাসের বীভৎসতম চুকনগর গণহত্যার কাহিনী জানাবার পাশাপাশি ১৯৭১ সালের জঘন্যতম জেনোসাইডের বিশ্ব স্বীকৃতি আদায়ের জন্য কাজ করবে। ৫১ বছর পরে হলেও প্রকৃত ইতিহাসের প্রয়োজনে এই স্বীকৃতি আমাদের দরকার

পাকিস্তানি হানাদারদের গণহত্যার প্রথম দিন ছিল ২৫ মার্চ ১৯৭১। তারপর মুক্তিযুদ্ধের সময়ের নয় মাস সারাদেশে গণহত্যা চালিয়েছিল হানাদার বাহিনি।

একাত্তরের ২৫ মার্চের নিরস্ত্র জনতার উপর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর আক্রমণ ছিল সামরিক ক্ষেত্রে সর্বকালের নিকৃষ্টতম কাজ। ঢাকার রাজারবাগ ও পিলখানার এবং চট্টগ্রাম কুমিল্লা ও যশোহর ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি বাহিনি যথাক্রমে বাঙালি পুলিশ, ইপিআর এবং ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট এর সৈন্যদের  পাইকারিভাবে হত্যা করে।

পাকিস্তানি সেনাদের ভয়াবহ গণহত্যা থেকে শিশু নারীসহ বয়স্ক লোকজন কেউ বাদ যায়নি। নারী নির্যাতনের কারণ এবং প্রকৃতিও ছিল নজরবিহীন। কিশোরী, গর্ভবতী, বৃদ্ধা কাউকেই ক্ষমা করেনি নরপশুরা। স্বামীর সামনে স্ত্রীকে, বাবা-মায়ের সামনে কন্যাকে, ভাইয়ের সামনে বোনকে প্রকাশ্য দিবালোকে চোখের সামনে ধর্ষণ করেছে পাক হ্যায়েনার দল। শাঁখারী বাজার, তাঁতী বাজার এলাকার হত্যাকান্ড সংঘটিত হয় সম্ভবত সবচেয়ে বেশী। নিরীহ জনসাধারণকে ঘর থেকে বের করে দল বেঁধে হত্যা করে। ট্যাঙ্ক, রিকয়েলস রাইফেলের গুলি এবং পেট্রোল ঢেলে হিন্দুদের বাড়িঘর ধ্বংস করে দেয়া হয়। বহির্বিশ্বের কাছে এই গণহত্যা আড়াল করার জন্য পাকিস্তানী শাসকবর্গ ৩০/৩৫ জন বিদেশী সাংবাদিককে দেশত্যাগে বাধ্য করে। তরপরও বিভিন্নভাবে বিশ্বের প্রধান প্রধান সংবাদপত্রে গণহত্যার খবর গুরুত্ব সহকারে পরিবেশিত হয়। নিউইয়র্ক টাইমস, বাল্টিমোর সান, ওয়াশিংটন পোস্ট, ক্রিশ্চিয়ান স্যায়েন্স মনিটর, ডেইলি টেলিগ্রাফ, গার্ডিয়ান, নিউ স্টেটসম্যান, টাইমস, ইকোনমিস্ট, বিবিসি, সিডনি মর্নিং হেরাল্ড উল্লেখযোগ্য।

মে মাসে দা গার্ডিয়ানে প্রকাশিত রিপোর্টের এই বিবরণ থেকে তার কিছুটা অনুমান সম্ভব। ‘‘Villages have been surrounded, at any time of day or night, and the frightened villagers have fled where they could, or been slaughtered where they have been found, or enticed out to the fields and mown down in helps. Women have been raped, girls carrie off to barracks, unarmed peasants battered  or bayoneted by the thousand’’.

 ‘’We Saw the amputation of a mother’s arm and a Child’s foot. These were too far from the border and gangrene developed from their bullet –wounds. Many saw their daughters raped and the heads of their children smashed in. Some  watched  their  husbands, sons and grandsons tied up at the wrists and shot in more selective male climination. (East Bengal Tragedy, The Guardian, London, May 27, 1971.)

You might also like