৭১-এর গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে জটিলতা নিরসনে প্রধান বিচারপতিকে স্মারকপত্র প্রদান করে নির্মূল কমিটি
নিউজ ডেস্ক
সত্যবাণী
ঢাকাঃ ২০১০ সালে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে ’৭১-এর গণহত্যাকারী মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণে যে জটিলতা ও অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তা নিরসনের জন্য সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় প্রধান বিচারপতিকে স্মারকপত্র প্রদান করেছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।আজ ২৪ জানুয়ারি (২০২৪) বেলা ১.৩০ মিনিটে সংগঠনের সভাপতি লেখক চলচ্চিত্রনির্মাতা শাহরিয়ার কবিরের নেতৃত্বে নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, অধ্যাপিকা মাহফুজা খানম, সহসভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, কেন্দ্রীয় নেতা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ স্বাধীনতা সংগ্রামী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পৌত্রী মানবাধিকার নেত্রী আরমা দত্ত, নির্মূল কমিটির আইটি সেলের প্রধান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর পুত্র আসিফ মুনীর তন্ময় ও সাধারণ সম্পাদক সমাজকর্মী কাজী মুকুলের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিনিধিদল মাননীয় প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের সঙ্গে তাঁর সুপ্রিম কোর্টের কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করে এ স্মারকপত্র প্রদান করেন।
স্মারকপত্রের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে নির্মূল কমিটির ১৫টি প্রকাশনাও মাননীয় প্রধান বিচারপতিকে প্রদান করা হয়। স্মারকপত্রের ভাষ্য নিম্নরূপ ১৯৭১-এর গণহত্যাকারী, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বিরাজমান মন্থরতা ও জটিলতা নিরসনে সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানকে প্রদত্ত স্মারকলিপি মাননীয় প্রধান বিচারপতি মহোদয় এ বিষয়ে অবগত আছেন যে, ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য বিগত ৩২ বছর আন্দোলন করছে। গণহত্যার ভিকটিমদের ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি সংবিধানের মর্যাদা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাই আমাদের এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য।মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার ’৭১-এর ঘাতক-দালালদের বিচারের জন্য অধ্যাদেশ জারি করে সারা দেশে ৭২টি ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিলেন, গণহত্যাকারীদের শাস্তি প্রদানের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের পরিবার এবং বিচারপ্রত্যাশী গোটা জাতিকে ন্যায়বিচার প্রদানের জন্য। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় এ সব ট্রাইব্যুনালে আড়াই হাজারেরও বেশি ব্যক্তির বিচার হয়েছিল এবং ৭৫২জনকে মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন সহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয়¾ ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতাদখলকারী প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান দালাল আইন বাতিল করে শুধু বিচার কার্যক্রমই বন্ধ করেন নি, সাজাপ্রাপ্ত ও বিচারাধীন সকল গণহত্যাকারীর কারামুক্তির পথও সুগম করে দিয়েছিলেন।১৯৯২ সালে ’৭১-এর গণহত্যাকারীদের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারের দাবিতে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের শহীদ পরিবার, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দ ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠন করেন, যা অচিরেই মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী সংগঠনের সমর্থনে দেশের সর্ববৃহৎ নাগরিক আন্দোলনে পরিণত হয়। এই নাগরিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ১৯৭৩ সালে প্রণীত ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ আইনে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের প্রায় ৪০ বছর পর ’৭১-এর গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে জাতিকে মুক্ত করার পথ সুগম করেন।এই বিচারের বিরুদ্ধে দেশে ও বিদেশে বহু ষড়যন্ত্র হয়েছে, বিচারক ও প্রসিকিউটরদের বাড়িতে হামলা হয়েছে, সাক্ষীদের ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে, গুম করা হয়েছে, এমনকি দুজন সাক্ষীকে হত্যাও করা হয়েছে। এতদসত্ত্বেও ট্রাইব্যনালের বিচারক, আইনজীবী ও তদন্ত সংস্থা অত্যন্ত সাহস, সততা ও দক্ষতার সঙ্গে এই বিচারকার্য পরিচালনা করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রশংসিত হয়েছেন।
আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি¾ ২০১৫ সালে বিচারপতি এস কে সিনহা প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণের পর ’৭১-এর গণহত্যাকারীদের চলমান বিচারের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক মন্থরতা ও জটিলতা দেখা দিয়েছে। তিনি প্রথমেই দুটি ট্রাইব্যুনালের ভেতর একটির কার্যক্রম বন্ধ করে দেন এবং বিচারিক কার্যক্রম অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেন। নির্মূল কমিটি এবং সমমনা অন্যান্য নাগরিক সংগঠনের প্রবল বাধার কারণে বর্তমান ভবন থেকে ট্রাইব্যুনাল সরিয়ে নেয়া সম্ভব না হলেও এই সব মামলার আপিল শুনানি তিনি বন্ধ করে দেন। এরপর থেকে যে গতিতে ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছিল সেখানে শুধু ভাটাই পড়েনিÑ একরকম স্থবির হয়ে গিয়েছে। এর ফলে আপনজনদের হত্যার বিচার না পেয়ে মুক্তিযুদ্ধের শহীদ পরিবারের সদস্যরা সময়ের দীর্ঘ ব্যবধানে মৃত্যুবরণ করছেন, অন্যদিকে গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীরাও শাস্তি না পেয়েই মারা যাচ্ছেন, যা আইনের শাসনের শুধু পরিপন্থী নয়, মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশা ও মর্যাদার প্রতিও আঘাতস্বরূপ।মাননীয় প্রধান বিচারপতি, আপনি নিজেও একসময় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। এই বিচারের গুরুত্ব সম্পর্কে আপনি সম্যক অবগত আছেন। ট্রাইব্যুনাল ব্যক্তি হিসেবে কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় গণহত্যাকারী ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীর বিচার করলেও এখন পর্যন্ত গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী সংগঠনসমূহ এবং ’৭১-এ পাকিস্তানি হাইকমান্ডের বিচার কার্যক্রম আরম্ভ হয় নি।
আপনার নিকট আমাদের বিনীত নিবেদন
১) প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা কর্তৃক স্থগিত দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল দ্রুত পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করুন।
২) আপিলের জটিলতা নিরসনের জন্য আপিল বিভাগে আরও বিচারপতি নিয়োগের উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি অপেক্ষমান মামলাগুলি দ্রুত শুনানির ব্যবস্থা করুন।
৩) কম্বোডিয়া ও অন্যান্য কয়েকটি দেশে যুদ্ধাপরাধের মামলায় আপিল বিভাগের একটি বেঞ্চ ট্রাইব্যুনালে গিয়ে দ্রুত আপিল শুনানি নিষ্পত্তি করেন। বাংলাদেশের মতো কোথাও এসব ট্রাইব্যুনালের মামলার আপিল শুনানির জন্য সুপ্রিম কোর্টে যেতে হয় না। আমরা মনে করি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কম্বোডিয়ার মতো আপিলের ব্যবস্থা করা হলে ট্রাইব্যুনালের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা যাবে।
৪) পুরনো হাইকোর্ট ভবনে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম আরম্ভ হওয়ার পর আমরা এই বিচার কার্যক্রমের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করে সরকার এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রতি আবেদন করেছিলাম¾ মামলার সকল কার্যবিবরণী ও দলিলপত্র যথাযথভাবে সংরক্ষণ করার জন্য; যাতে করে বিচারকার্য শেষ হওয়ার পর নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের প্যালেস অব জাস্টিসের মতো আমাদের ট্রাইব্যুনালের বর্তমান ভবনটি জাদুঘর ও আর্কাইভে রূপান্তরিত করা যায়। এর ফলে আগামী প্রজন্ম এবং বিশ্ববাসী ’৭১-এর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের ব্যাপকতা ও ভয়াবহতার পাশাপাশি জানতে পারবে কী ধরনের প্রতিকূলতার ভেতর এবং কী ধরনের মেধা ও দক্ষতার সঙ্গে বাংলাদেশ গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হওয়ার ৪০-৫০ বৎসর পরও সাফল্যের সঙ্গে বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পেরেছে।আমরা আশা করব মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লক্ষ শহীদ পরিবার এবং বিচারপ্রত্যাশী গোটা জাতির স্বার্থে আপনি আমাদের আবেদন বিবেচনা করবেন।এই স্মারকপত্রের অনুলিপি আজ বিকেলে মাননীয় আইন,বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হক এমপি-কে পাঠানো হয়েছে।