৭ উপজেলায় ব্যাপক ক্ষতি তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় নদী পানি ধরে রাখতে পারছে না সুরমা-কুশিয়ারার ২ হাজার ৮৬০ মিটার ডাইক ক্ষতিগ্রস্ত
চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী
সিলেট থেকেঃ চলতি বন্যায় সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ (ডাইক) ভেঙে সিলেটের ৭ উপজেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বানের পানিতে সুরমা-কুশিয়ারা নদীর ডাইকের ৩৮টি স্থান ভেঙে গেছে। ভেঙে গেছে দু’টি রেগুলেটরও। ডাইকের ৫২টি স্থানে বাঁধ উপচে পানি ঢুকে ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়। ভাঙনের ফলে ডাইকের কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা নির্ধারণে কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।পাউবো’র সিলেট জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমদ জানিয়েছেন, ডাইক ভেঙে অনেক গ্রাম-ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়। অনেক ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে। ডাইক ভেঙে আমাদের কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা নিরূপণে পাউবো লোকজন কাজ করছেন। ভেঙে যাওয়া ৩৮টি স্থানের মধ্যে কয়েকটিতে ভাঙন বন্ধ করার কাজ শুরু করা হয়েছে। অন্যগুলোতেও কাজ করা হবে।
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, চলতি বন্যায় সিলেটের সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ (ডাইক) ৩৮টি স্থানে ভেঙে যায়। এতে মোট ২ হাজার ৮৬০ মিটার ডাইক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে জকিগঞ্জের কুশিয়ারা নদীর ১১টি স্থানে ডাইক ভেঙে ৭০০ মিটার জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিয়ানীবাজার উপজেলায় কুশিয়ারা নদীর ৪টি স্থানে ডাইক ভেঙে ১৪০ মিটার জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জকিগঞ্জের সুরমা নদীর ডাইক ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫৪০ মিটার জায়গা। কানাইঘাট উপজেলার সুরমা নদীর ১১টি স্থানে ডাইক ভেঙে ৩৯৫ মিটার জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিয়ানীবাজার উপজেলায় সুরমা নদীর ১টি স্থানে ডাইক ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৩৫ মিটার জায়গা। দক্ষিণ সুরমা উপজেলায় সুরমা নদীর ৩টি স্থানে ডাইক ভেঙে ১ হাজার মিটার জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সিলেট সদর উপজেলায় সুরমা নদীর ১টি স্থানে ডাইক ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৫০ মিটার জায়গা। জৈন্তাপুর উপজেলার সারি নদীর রেগুলেটর ভেঙে ২০ ভেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়াও, গোলাপগঞ্জ উপজেলার সুরমা নদীর রেগুলেটর ভেঙে ২ ভেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে পাউবো সূত্র জানিয়েছে। ১১ মে বন্যা শুরুর পর থেকে গত ২২ মে পর্যন্ত বানের পানিতে ডাইক ভেঙে এই ক্ষতি হয়।
এদিকে, জকিগঞ্জে ১৬টি স্থান, কানাইঘাট উপজেলায় ২৬টি স্থান, বিয়ানীবাজার উপজেলায় ৫টি স্থান, দক্ষিণ সুরমা উপজেলায় ৪টি স্থান, গোলাপগঞ্জ উপজেলার ৪টি স্থান দিয়ে প্রবাহিত হয় বন্যার পানি। এছাড়া, জৈন্তাপুরে (সারী-গোয়াইন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ) উপচে বন্যার পানিতে বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়। অস্বাভাবিকভাবে পানি বেড়ে সুরমা নদীর বাম তীর ও কুশিয়ারা নদীর ডান তীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ উপচে ৫২টি স্থান দিয়ে ও ৩৮টি স্থান ভেঙে বানের পানিতে অসংখ্য ঘরবাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাস্তা-ঘাট, কৃষি জমি তলিয়ে যায়। বানের পানিতে ২১ কোটি ৭৩ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে বলে জানিয়েছেন সিলেটের মৎস্য অফিসার মো: আবুল কালাম আজাদ। এছাড়া, ১৫ কোটি টাকারও অধিক কৃষি খাতের ক্ষতি হয়েছে। তবে, বন্যার পানি এখনো রয়ে যাওয়ায় ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে এখনও নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না।এ প্রসঙ্গে পাউবো সিলেটের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এসএম শহিদুল ইসলাম বলেন, সিলেট অঞ্চলের প্রধান নদী সুরমা-কুশিয়ারা নাব্যতা হারিয়ে যাওয়ায় নদী এখন আর পানি ধরে রাখতে পারছে না। ফলে নদী উপচে সিলেট নগরসহ বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়। নদী ড্রেজিং হলে এ রকম অবস্থা আর হবে না। তিনি জানান, সুরমা-কুশিয়ারা ড্রেজিং করতে দু’টি বৃহৎ প্রকল্প গ্রহণ করেছে পাউবো।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনসহ (বাপা) সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ভরাট হয়ে গেছে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর উৎস মুখ। আমলসীদ থেকে লোভা মুখ পর্যন্ত ৪২ কিলোমিটার ভরাট হয়ে অসংখ্য চর পড়েছে। বছরের বেশিরভাগ সময় বরাক নদী থেকে সুরমা নদী বিচ্ছিন্ন থাকে। শুকনো মৌসুমে বরাকের পানি শুধুমাত্র কুশিয়ারা নদীতে চলে যায়। এ সময় অনেক জায়গা পায়ে হেঁটে সুরমা নদী পার হওয়া যায়। বছরের প্রতিটি দিন সুরমায় ফেলা হয় নাগরিক বর্জ্য। প্লাস্টিক বর্জ্যে সুরমার তলদেশ কয়েক ফুট পর্যন্ত ভরে গেছে। কেবল এই ৪২ কিলোমিটারই নয়, সিলেট ও সুনামগঞ্জের সুরমা নদীতে মোট কতটি চর পড়েছে তার হিসেব এখনো কারো কাছে নেই। প্রতিবছর উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের সাথে আসা বালি ও পলিতে প্রায় পুরো সুরমা নদী ভরাট হয়ে গেছে। শুকনো মৌসুমে জকিগঞ্জ থেকে সিলেট পর্যন্ত শতাধিক স্থানে জেগে ওঠে ধু-ধু বালুচর। কানাইঘাট, দক্ষিণ সুরমা, গোলাপগঞ্জ, সিলেট সদর উপজেলার টুকেরবাজারসহ অসংখ্য স্থানে নদীর জেগে ওঠা চরে শুকনো মৌসুমে সবজি চাষ করা হয়। বিশেষ করে কানাইঘাটে সুরমার তীরে ও জেগে ওঠা চরে শীতকালীন সবজি চাষ যে কারো নজর কাড়বে বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন। কানাইঘাট ও গোলাপগঞ্জ পৌরসভার বর্জ্য সুরমা নদীর পার্শ্বে ফেলা হয় বলে জানা গেছে।
সুরমা ভরাট হয়ে যাওয়ার বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা নানা কারণ জানিয়েছেন। এরমধ্যে রয়েছে, নদীর গতি প্রবাহ থেমে যাওয়া। নদীর নিয়মিত ড্রেজিং না করে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন অন্যতম। আগে বৃষ্টি বা পাহাড়ি ঢলের পানি সিলেটের সুরমা হয়ে, সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ হয়ে নেত্রকোনা জেলার ধনু নদী দিয়ে এক সময় মেঘনায় গিয়ে পড়ত। ধনু নদীর সাথে বেশ কয়েকটি ছোট-বড় খালও ছিল। সুরমা নদীর পানি ওই খাল সমূহেও কোনো ধরনের বাধাবিপত্তি ছাড়াই চলে যেতে পারত। কিন্তু এখন আর ওই খালগুলো যেমন হারিয়ে গেছে। তেমনি ধনু নদীর উজানেও গতিপথ ভরাট হয়ে গেছে। এসব কারণে চলতি বন্যার পানিও একেবারে ধীর গতিতে কমছে। গেল অকাল বন্যার পানিও ধনু নদীতে তেমন গতিতে যেতে পারেনি। ফলে দীর্ঘদিন সুরমায় উপচে পড়া পানিতে সুনামগঞ্জের অনেক হাওরের ফসল তলিয়ে যায়। এজন্যে সুরমা-কুশিয়ারার মুখ থেকে ড্রেজিং শুরু করার দাবি জানানো হয়েছে। পাশাপাশি গতি প্রবাহ ঠিক করতে ধনু নদীসহ প্রয়োজনীয় জায়গা ড্রেজিং করারও দাবি জানানো হয়। একই সাথে সিলেট শহরের আশপাশের হাওর, ছোট ছোট খালগুলো ভরাট করা, পুকুর-দীঘি ভরাট করার ফলে সামান্য বৃষ্টিতে এখন নদীতে পানি উপচে পড়ে বলেও বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।