কেমন করে বেঁচে আছি এই করোনায়: পর্ব-৬

দিলীপ মজুমদার

পৃথিবীর করোনা-প্রবণ দেশগুলিতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা মাঝে মাঝে লিখে রেখেছি । আজ ৩০ নভেম্বরে করোনা আক্রান্তের সংখ্যাটা এই রকম : বিশ্ব ৬২,৩৬৩,৫২৭ ; আমেরিকা- ২৬,৪৫২,০৫৫, ইউরোপ-১৮,৬৬০,৮৫৪, দঃ পূর্ব এশিয়া-১০,৭৮৮,৭০৪, পূঃ ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল-৪,০৪০,২৪৩, আফ্রিকা- ১,৫০০,০৬৮, পঃ প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চল- ৮৮ও,৮৬২ । বিশেষ কয়েকটি দেশের হিসেব : আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র-১৩,০৮২,৮৭৭, ভারত- ৯,৪৩১,৬৯১, ব্রাজিল- ৬,২৯০,২৭২, রাশিয়া- ২,২৯৫,৬৫৪, ফ্রান্স- ২,১৭৯,৪৮১, স্পেন- ১,৬২৮,২০৮, ইংল্যাণ্ড- ১,৬১৭,৩৩১, ইতালি- ১,৫৮৫,১৭৮, মেক্সিকো- ১,১০০,৬৮৩, জার্মানি- ১,০৫৩,৮৬৯ ।
এই পর্যন্ত লেখার পরে কলিংবেল বাজল । গত সাত-আট মাস এই বেল বাজত না । কারণ বাইরের গেট তালাবন্ধ থাকত । গেটের বাইরে আগন্তুক চিৎকার করে উপস্থিতি জানান দিত । তারপর মুখে মাস্ক এঁটে তালা খুলে আগন্তুককে আসতে বলতাম । ঘরে ঢোকার আগে হাতে স্যানিটাইজার ঢালতে হত । জামা-কাপড়ে স্যানিটাইজার স্প্রে করতে হত । ঘরে ঢুকলে অনেকটা দূরে চেয়ারে বসতে হত । এসব বিধি-বিধান এখন অনেকটা কমে এসেছে ।দরজা খুলে দেখি বেহালার এক উঠতি কবিকে । তিনি ব্রেসব্রিজে ট্রেন ধরবেন । যাওয়ার পথে আমার সঙ্গে দেখা করে গেলেন ।নানা কথার পরে তিনি বললেন, ‘করোনাভাইরাস নামের কাঁটাওয়ালা যে রঙিন গোলক আমরা সর্বত্র দেখি, তার আয়তন একটা ফুলস্টপ চিহ্নের দশ হাজার ভাগের এক ভাগের সমান । গত জানুয়ারিতে করোনাভাইরাসের এই ছবিটা এঁকেছিলেন সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনসন সংস্থার মেডিকেল আর্টিস্ট এলিজা একার্ট এবং তাঁর সহকর্মী ড্যান হিগিনস । তাঁদের কাজ ছিল, ছবিটা এমন আঁকতে হবে, যাতে, দেখলেই মানুষের মনে প্রভাব পড়ে । ছবিটা নভেল করোনাভাইরাস জীবাণুর কাছাকাছি নিশ্চয়, কুন্তু হবহু নয় । তৈরি করা ছবি ।’
এ তথ্য আমার জানা ছিল না । প্রশ্ন করলাম, ‘ এ তথ্য তুমি কোথা থেকে পেলে কবি ?’
তিনি বললেন, ‘ ফরিদ জাকারিয়ার বই থেকে ।’
-‘নাম কী বইটার ?’
-‘টেন লেশনস ফর আ পোস্ট-প্যানডেমিক ওয়ার্ল্ড ।কবি বলে যেতে লাগলেন, ‘ ফরিদ জাকারিয়ার মতে আমাদের শেখানো হয় বড় করে ভাবতে । কিন্তু বোধ হয় আমাদের দরকার একটু ছোট করে ভাবতে শেখা । চেনা বড় বিপদ, যে সবের সামনে আমরা পড়তে পারি বা পড়ি, সে সবে আমাদের অসুবিধা হয় না ।যেমন সেনা হামলার পাল্টা আরও বড় সেনা হামলা, এ সবে আমাদের দক্ষতা বেড়েই চলেছে । প্রায় সব ধরনের সরকার লক্ষ-কোটি ডলার খরচ করে

সেনাবাহিনীর পিছনে । প্রয়োজনে সম্ভাব্য শত্রুদের যোগ্য জবাব দেওয়ার জন্য । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একাই বছরে এক ট্রিলিয়ন ডলারের চার ভাগের তিন ভাগ খরচ করছে সামরিক বাজেটে । তারপরেও মানুষ ফুলস্টপ চিহ্নের দশহাজার ভাগের এক ভাগের সমান একটা ক্ষুদ্র জীবাণুর আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে দিশাহারা ।অতি অতি ক্ষুদ্র এই জীবাণু তছনছ করে দিয়েছে সভ্যতার সাজানো বাগান । বিধ্বস্ত বিশ্ব অর্থনীতি । সেই বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে টেনে তুলতে না পারলে সর্বনাশ নেমে আসবে । কবি ফরিদ জাকারিয়ার কথা বলছিলেন। জাকারিয়ার মতে অতিমারির সময়ে সকলের সহযোগিতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন আত্মত্যাগের । প্রতিটি দেশের সরকারকেও ভাবতে হবে । দেশের সমস্ত নাগরিক যাতে উপকৃত হয়, সে রকম ব্যবস্থা নিতে হবে । মনে রাখতে হবে বাজার শেষ কথা নয় । অর্থনীতিতে আরও বেশি সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে সরকারকে । পাবলিক সার্ভিসের জন্য সরকারি ব্যয়কে দেখতে হবে বিনিয়োগ হিসেবে । শ্রমের বাজারকে দিতে হবে নিরাপত্তা ।করোনার ধাক্কা সামলে বিশ্ব অর্থনীতি কী ভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারে সে সম্পর্কে এক রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপুঞ্জ । ন্যূনতম আয়ের উপর জোর দিয়েছেন তাঁরা । রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘ সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প কেমন হওয়া উচিত, সেই সম্পর্কিত গবেষণা ও চিন্তা-ভাবনায় সবার আগে গুরুত্ব দেওয়া দরকার জরুরি ন্যূনতম আয় নিশ্চিত করার বিষয়ে ।

কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের কাছে বিশ্ব অর্থনীতির পুনরুদ্ধার বোধহয় তেমন জরুরি নয়।এই অতিমারির সময়েও অব্যাহত আছে রাজনীতির খেলা । করোনা সংক্রমণের জন্য এতদিন কাঠগোড়ায় তোলা হচ্ছিল চিনকে।এখন চিন আবার জাতিবৈষম্যের পাল্টা অভিযোগ তুলতে শুরু করেছে । বলতে শুরু করেছে করোনাভাইরাসের উঃস চিন নয় ।চিনের সরকারি সংবাদমাধ্যমের বক্তব্য : উহানের বাজারে মাংসের মধ্যে ভাইরাস পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু সেটাই ভাইরাসের উঃস নয় । ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের আগেই চিন সীমান্তের বাইরে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছিল । তারপরে এসেছে চিনে ।চিনর ‘পিপলস ডেইলি’ পরিষ্কারভাবে বলেছে যে তাদের হাতে যে সব তথ্যপ্রমাণ আ্ছে তাতে স্পষ্ট উহান থেকে ভাইরাসের উঃপত্তি হয় নি । সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের প্রাক্তন প্রধান এপিডিমিয়োলজিস্ট জেং গুয়াং বলেন, ‘ উহানে প্রথম ভাইরাসটি চিহ্নিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা বলে উহান এই ভাইরাসের উঃস নয় ।চিন এ বিষয়ে একটি গবেষণাপত্র আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানবিষয়ক জার্নাল ‘ল্যানসেটে’ জমা দিয়েছে । সে রিপোর্টে বলা হয়েছে যে মানুষ থেকে মানুষের দেহে সার্স-কোভ-২ সংক্রমণ উহানে প্রথম হয় নি । ভারতের দিকে আঙুল তুলেছে চিন । ভারতের বসু ইন্টারন্যাশনাল থেকে মাছ আমদানি করে চিন । কিংদাও শহরের বন্দরে আমদানিকৃত এক হিমায়িত মাছের প্যাকেটের উপর থেকে সক্রিয় নভেল করোনাভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ করেছে তারা । প্রথম দিকে চিন ইউরোপের দিকে আঙুল তুলেছিল, এখন ভারতের দিকে নজর তাদের । ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষ শুরু হয়েছে । এই অভিযোগ নতুন রসদ জোগাবে ।যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রথম দিকে চিনের পক্ষ নিয়েছিল, সেই সংস্থা এখন ভিন্ন কথা বলছে । সংস্থার জরুরি স্বাস্থ্য পরিস্থিতি বিষয়ক বিভাগের ডিরেক্টর মাইক রায়ান বলেছেন : চিন এ রোগের উঃস নয়, এমন অনুমান একেবারেই ভিত্তিহীন ।করোনাভাইরাসের উৎস চিন নয়, ইউরোপ বা ভারত, চিনের এই দাবি অন্য কোন দেশ স্বীকার করে না । তার কারণ আছে । চিনের যদি স্বচ্ছতা থাকত, তাহলে অন্য কথা হত । কিন্তু আজ পর্যন্ত চিন কোন নিরপেক্ষ তদন্তকারী দলকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে নি । বেশ কয়েক মাস আগে উহানে একটি তদন্তকারী দল পাঠিয়েছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা । কিন্তু চিনা প্রশাসন সেই দলকে উহানের বাজারে ঢুকতে অনুমতি দেয় নি শেষপর্যন্ত । তাই লোকে বলে ডালমে কুছ কালা হ্যায় ।একটা বছর শেষ হতে চলল । করোনা প্রতিরোধের সঠিক পথ আবিষ্কৃত হল না । করোনার টিকা নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার প্রতিযোগিতা অব্যাহত ।জার্মান সংস্থা বায়োএনটেকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এমআরএন-এ প্রযুক্তির সাহায্যে ফাইজারের টিকা তৈরি করেছে আমেরিকা । বলছে এই টিকা ৯০% কার্যকর । তৃতীয় ধাপের অন্তর্বর্তী ট্রায়ালে সফল ।রাশিয়ার ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ফাণ্ড থেকে জানানো হয়েছে তাদের তৈরি স্পুটনিক ভি তৃতীয় দফা ট্রায়ালে ৯২% কার্যকর ।
আমেরিকার ওষুধপ্রস্তুতকারী সংস্থা মর্ডানার দাবি তাদের করোনা টিকা ৯৫% কার্যকর । অ্যান্টনি ফাউচিও এ দাবিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন ।প্রতিষেধকের দৌড়ে কে কোথায় একবার দেখে নেওয়া যাক।পর্যায়গুলি এ রকম : ১] টিকা, ২] গবেষণাসংস্থা, ৩] ভারতে সহযোগী, ৪] পরীক্ষার কোন পর্যায়ে ৫], কবে আসতে পারে, ৬] দাম।

কোভিশিল্ড অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রোজেনেকা- সিরাম ইন্সটিটিউট- ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল ২০২১—২ ডোজ ১০০০টাকার কাছাকাছি । কোভ্যাক্সিন ভারত বায়োটেক ও আইসিএমআর তৃতীয় পর্যায়ের গোড়ায়—

মার্চ-মে ২০২১- জানা যায় নি ।
স্পুটনিক ভিগামালিয়া ইন্সটিটিউটরেড্ডিজ ল্যাব দ্বিতীয় ও তৃতীয় ফেব্রুয়ারি মার্চ ২০২১ দাম ঠিক হয় নি ।ফাইজারের টিকা—ফাইজার ও বায়োএনটেক তৃতীয় পর্যায়ের শেষে ডিসেম্বরে ইংল্যাণ্ডে ২০ ডলার ।জাইকোভ ভিজাইডাস ক্যাডিলা দ্বিতীয় পর্যায়ের শেষে—২০২১ এর মাঝামাঝি ভারতে—দাম ঠিক হয় নি ।মর্ডানার টিকা মর্ডানা ও আমেরিকার ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ হেল্থ তৃতীয় পর্যা্য়ের শেষে ডিসেম্বরে আমেরিকায়—৩৭-৪০ ডলার।নোভাভ্যাক্সের টিকাসিরাম ইন্সটিটিউট দ্বিতীয় পর্যায়ফেব্রুয়ারি ২০২১ আমেরিকায়—১৬ ডলার ।হতদরিদ্র সাধারণ মানুষ কিন্তু টিকার ভরসায় রুদ্ধঘরে দিন কাটাতে পারে না।জীবিকার টানে পথে তাদের নামতেই হবে।পথে এবার নামো সাথি,পথেই হবে এ পথ চেনা ।

লেখক: কলামিষ্ট, ফেলোশীপ প্রাপ্ত গবেষক, সত্যবাণীর কন্ট্রিবিউটিং কলামিষ্ট।

 

You might also like