কারি লাইফ অ্যাওয়ার্ডের ১৫তম আসর: সরগরম আয়োজনে রেস্টুরেন্ট খাতের সাফল্য উদ্যাপন
নিউজ ডেস্ক
সত্যবাণী
লন্ডন: সেন্ট্রাল লন্ডনের ম্যাফেয়ারের অভিজাত লন্ডন ম্যারিয়ট হোটেলের সুপরিসর বলরুমে ১৩ অক্টোবর রোববার অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৫তম কারি লাইফ অ্যাওয়ার্ডস ও গালা ডিনার। মর্যাদাপূর্ণ এই অ্যাওয়ার্ডস ও গালা ডিনারের দেড় যুগ পূর্তির বিশেষ এই আয়োজন উদ্যাপন করা হয় সর্বোচ্চ ৫১টি পদক প্রদানের মাধ্যমে যুক্তরাজ্যের ডান্ডি থেকে কর্নওয়াল—সব অঞ্চলের শীর্ষ রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীদের মিলনমেলা হিসেবে ধরে নেওয়া হয় এই বার্ষিক আয়োজনকে। এবারও এর ব্যত্যয় ঘটেনি; বরং সবার স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতিতে অনুষ্ঠান ছিল উৎসবমুখর। যুক্তরাজ্যে কারি ইন্ডাস্ট্রির শীর্ষ এই সম্মাননা অনুষ্ঠানে এবারও রেস্টুরেটার্স ও খাদ্যরসিকদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। পাঁচ শতাধিক অতিথির উপস্থিতিতে সরগরম ছিল অনুষ্ঠানস্থল। উপস্থিত ছিলেন ব্রিটিশ রাজনীতিক, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের স্বনামখ্যাত ব্যক্তিরা। যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসেন কারি ইন্ডাষ্ট্রির শীর্ষস্থানীয় নেতারা, রেস্টুরেন্ট মালিক ও শেফরা।
সম্মননা স্মারক হাতে বিজয়ী
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন যুক্তরাজ্যের হেলথ অ্যান্ড সোশ্যাল কেয়ার মন্ত্রী ওয়েস স্ট্রেটিং এমপি। তিনি অ্যাওয়ার্ড বিজয়ীদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, হসপিটালিটি খাত দেশের অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রাখছে। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যে হসপিটালিটি ইন্ডাস্ট্রি এবং কারি হাউস আমাদের কমিউনিটিকে একত্র করছে, সবাইকে মিলিত করছে, একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করছে। আমাদের ব্যবসাকেন্দ্রগুলোকে আরও সমৃদ্ধ করছে, যেখানে মানুষ পরিবার ও বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে যাওয়া–আসা করেন। কারি ইন্ডাস্ট্রির অর্জন, সম্ভাবনা ও সংকট নিয়ে নিয়মিত প্রকাশনা ও বিভিন্ন দেশে ‘ব্রিটিশ কারি ফেস্টিভ্যাল’ আয়োজনের মাধ্যমে কারি লাইফ ইতিমধ্যে ব্রিটিশ কারি ইন্ডাস্ট্রির বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য মুখপত্র হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় যুক্তরাজ্যের কালিনারি ক্যালেন্ডারের অন্যতম সেরা আয়োজন হিসেবে স্থান করে নিয়েছে মর্যাদাপূর্ণ কারি লাইফ অ্যাওয়ার্ডস। যুক্তরাজ্যে রেস্টুরেন্ট খাতে বাংলাদেশিদের কৃতিত্ব ও অবদানকে মূলধারায় তুলে ধরার পাশাপাশি কারি শিল্পে নিবেদিত ব্যক্তিদের উৎসাহিত করার লক্ষ্যে ২০০৩ সালে ‘কারি লাইফ’ ম্যাগাজিন চালু করেন দুই সহোদর সৈয়দ নাহাস পাশা এবং সৈয়দ বেলাল আহমদ। কারি লাইফ ম্যাগাজিনের উদ্যোগে ২০০৯ সালে চালু করেন কারি লাইফ অ্যাওয়ার্ডস ও গালা ডিনার।
এবারের আয়োজনে বিশেষ আকর্ষণ ছিল কারি লাইফ এডিটরস চয়েস অ্যাওয়ার্ডস, কারি লাইফ বেস্ট রেস্টুরেন্ট অ্যাওয়ার্ডস, বেস্ট টেক অ্যাওয়ে অব দ্য ইয়ার এবং সাতটি আউটস্ট্যান্ডিং শেফ অ্যাওয়ার্ডস। এ ছাড়া ছিল কারি লাইফ বেস্ট রেকোমেন্ডেড রেস্টুরেন্ট ২০২৪ এবং কারি লিজেন্ড অ্যাওয়ার্ডস। যুক্তরাজ্যের আলোচিত জিবি নিউজের প্রেজেন্টার এবং টেলিগ্রাফের অ্যাসোসিয়েট এডিটর ক্যামিলা টোমিনির উপস্থাপনায় চমৎকার উপভোগ্য হয়ে ওঠে পুরো আয়োজন।মূল আয়োজন শুরু হয় সন্ধ্যা সাতটায়। যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে বছরে প্রায় চার বিলিয়ন পাউন্ডের অবদান রাখে কারি ইন্ডাস্ট্রি। বিশাল এই রেস্টুরেন্ট সেক্টরের সেরাদের সম্মাননা জানানোর অনুষ্ঠানে অতিথিদের মধ্যে ছিলেন যুক্তরাজ্যের হেলথ অ্যান্ড সোশ্যাল কেয়ার বিষয়ক মন্ত্রী ওয়েস স্ট্রেটিং এমপি, কনফেডারেশন অব ব্রিটিশ ইন্ডাস্ট্রিজের (সিবিআই) সাবেক প্রেসিডেন্ট, কোবরা বিয়ারের প্রতিষ্ঠাতা এবং হাউস অব লর্ডসের সদস্য লর্ড করণ বিলিমোরিয়া, কমিউনিটিস অ্যান্ড লোকাল গভর্নমেন্ট বিষয়ক মিনিস্টার রুশনারা আলী, শার্লট নিকোলস এমপি এবং জেড বোটেরিল এমপি।কারি লাইফ অ্যাওয়ার্ডসের অতীতের আয়োজনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমার, ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী অ্যাঞ্জেলা রায়নার, লন্ডনের মেয়র সাদিক খান এবং সাবেক হোম সেক্রেটারি প্রীতি প্যাটেল এমপি উপস্থিত ছিলেন।এবারের আয়োজন ছিল নতুনত্বে ভরা। নজরকাড়া সাংস্কৃতিক আয়োজনের পাশাপাশি ছিল নানা সুস্বাদু পদে রসনাতৃপ্তির আয়োজন। অ্যাওয়ার্ড বিজয়ীদের মঞ্চে নেওয়া হয় বিশেষ মর্যাদায়। আবার পুরো অনুষ্ঠান বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।এবারের আয়োজনে টাইটেল স্পন্সর ছিল ওয়ার্ক পারমিট ক্লাউড। আরও সহযোগিতায় ছিল কোবরা বিয়ার, ইউনিসফট এবং হিলসাইড ট্রাভেলস।
অনুষ্ঠান শুরু হয় কারি লাইফ ম্যাগাজিনের প্রধান সম্পাদক সৈয়দ নাহাস পাশার সূচনা বক্তব্যে। কারি লাইফ অ্যাওয়ার্ডসের ১৫তম আয়োজন ছিল একটি বিশেষ কারণে গুরুত্বপূর্ণ। চলতি বছর কারি লাইফ ম্যাগাজিন প্রকাশনার ২১ বছর পূর্ণ হয়েছে। তিনি বলেন, তিনি ও তাঁর ভাই সৈয়দ বেলাল আহমদ ১৯৭০ দশকে যুক্তরাজ্যে আসার পর কারির প্রতি ব্রিটিশদের আগ্রহের মাত্রা দেখে অবাক হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে নিজেদের অভিজ্ঞতাকে এই শিল্পে কাজে লাগিয়ে তাদের পাশে থাকার অভিপ্রায়ে এই উদ্যোগ নেন।
সৈয়দ নাহাস পাশা বলেন, রেস্টুরেন্টগুলো কর্মচারী–সংকটের কারণে এখন সপ্তাহে এক দিন বন্ধ রাখছে। তদুপরি রান্নার উপকরণের উচ্চমূল্যের কারণে ক্যাটারিং সেক্টর এক মহাসংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই সংকট উত্তরণে সহযোগিতার জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।
ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে কারির এই নতুন আবাস খুঁজে পাওয়ার বিষয়টিকে তাঁরা উদ্যাপন ও সামনে এগিয়ে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেই ২০ বছর আগে কারি লাইফ ম্যাগাজিন শুরু করেন। এরপর ২০০৯ সালে শুরু করেন কারি লাইফ অ্যাওয়ার্ডস। তিনি বলেন, এখন ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলংকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ ব্রিটিশ কারির কদর করেন। কারণ, ব্রিটিশ কারি একটি স্বতন্ত্র স্বাদ ও বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে এবং এর বৈচিত্র্য অব্যাহতভাবে বিকশিত হচ্ছে।রেস্টুরেন্ট সেক্টরের নানা চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করে সৈয়দ নাহাস পাশা বলেন, রেস্টুরেন্ট সেক্টরের ন্যায্য দাবির পক্ষে কারি লাইফ টিম অব্যাহতভাবে প্রচারণা চালিয়ে যাবে।১৫তম বার্ষিক কারি লাইফ অ্যাওয়ার্ড সম্পর্কে কারি লাইফ মিডিয়া গ্রুপের সম্পাদক সৈয়দ বেলাল আহমেদ বলেন, কারি লাইফ অ্যাওয়ার্ডসের একটি প্রধান লক্ষ্য হলো কারি শিল্পে সেরা চর্চার অনুশীলনকে তুলে ধরা। যাতে প্রত্যেকের শেখার সুযোগ থাকে। কারি লাইফ ম্যাগাজিনের পেছনেও সেরা চর্চার অনুশীলন চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে।
সৈয়দ বেলাল আহমেদ আরও বলেন, ‘অনেক বছর ধরে আমরা সম্মাননা প্রদানের এই অনুষ্ঠান করে আসছি। আমরা রসনাবিলাসীদের কাছে উন্নত মানের নানা পদের চাহিদা যেমন ক্রমাগত বাড়তে দেখেছি, ঠিক তেমনি রেস্টুরেন্টগুলোরও ক্রমাগত মানের উন্নতি লক্ষ্য করেছি। রেস্টুরেন্ট খাতে খাবারের যে বৈচিত্র্য ও মানের যে উন্নয়ন ঘটছে, সেটি চমৎকার প্রশংসাযোগ্য।লর্ড বিলিমোরিয়া মনে করেন, ব্রিটেনের অর্থনীতি ষষ্ঠ অবস্থানে উন্নীত হওয়া সম্ভব ছিল না অভিবাসী বাঙালিদের অবদান ছাড়া। এ জন্য তিনি অভিবাসীর সংখ্যা বেড়ে গেছে বলে নেতিবাচক প্রচারণা বন্ধের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। রেস্টুরেন্ট ও হসপিটালিটি সেক্টরসহ দেশের বিভিন্ন সেক্টরে কর্মী–সংকটের দিকে নজর দেওয়ারও আহ্বান জানান তিনি।ব্রিটিশ কারি ইন্ডাস্ট্রির মুখপত্র হিসেবে কারি লাইফ ম্যাগাজিনের বিশেষ ভূমিকার প্রশংসা করে করণ বিলিমোরিয়া বলেন, তাদের কল্যাণে এখন ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশে ব্রিটিশ কারি ফেস্টিভ্যাল হচ্ছে। ব্রিটিশ কারির বৈচিত্র্যের কথা প্রশংসনীয়ভাবে তারা বিশ্বের কাছে তুলে ধরছেন।
রুশনারা আলী এমপি বলেন, ব্রিটিশ কারি ইন্ডাস্ট্রির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি শুধু ব্রিটিশ এশিয়ান কমিউনিটির জন্য সুযোগ সৃষ্টি করছে না, এটি একটি মাল্টি বিলিয়ন পাউন্ড ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলেছে। এটি দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে দেখে ভালো লাগছে। তিনি সব কারি লাইফ অ্যাওয়ার্ড বিজয়ীকে অভিনন্দন জানান।