স্ট্যান্ডিং অভেশন পেয়েছে নাটক ‘আশালতা’ : দর্শকদের প্রতিক্রিয়া
নিলুফা ইয়াসমীন হাসান
বার্তা সম্পাদক, সত্যবাণী
লন্ডন: ব্রাডি আর্টস সেন্টারে মঞ্চস্থ হয়েছে ট্রিওআর্টস এর প্রযোজনায় অটিজম নিয়ে দর্শকনন্দিত সমাজ সচেতন নাটক ‘আশালতা’। অভিনয় শিল্পীরা সকলেই নিজেদের চরিত্র দারুনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। নাটক শেষে হলভর্তি দশক দাঁড়িয়ে অভিবাদন (স্ট্যান্ডিং অভেশন) জানিয়েছেন।
সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন ও অসামান্য প্রতিভার অধিকারী স্যার আইজ্যাক নিউটন এই দুই মহাবিজ্ঞানী অটিজম সমস্যায় ভুগছিলেন। আশালতা নাটকে তুলে ধরা হয়েছে সুযোগ পেলে অটিজম শিশুও প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পারে।
নাটক মানুষের আত্মিক উন্নয়ন এবং সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাঙালির সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্যে নাটক হলো অন্যতম। এখনকার ডিজিটাল যুগেও কার্যত অপ্রতিদ্বন্দী নাটক।
বাংলা সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে তুলে ধরার প্রয়াস নিয়ে প্রতি বছরের ন্যায় এবারো পূর্ব লন্ডনে শুরু হয়েছে মাসব্যাপী নাট্যোৎসব। এবারের প্রতিবাদ্য বিষয় হলো Hope (আশা)। আশা ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারেনা। এবারের নাটকগুলো দর্শকদের অন্ধকার থেকে আলোতে আসার আশার বাণী শোনাচ্ছে।
৯ই নভেম্বর শনিবার ট্রিওআর্টস এর প্রযোজনায় ‘আশালতা’ মঞ্চস্থ হয়েছে পূর্ব লন্ডনের ব্রাডি আর্টস সেন্টারে। ট্রিওআর্টস লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত একটি সংগঠন, গত পাঁচ বছর ধরেই তারা কাজ করে চলেছে। প্রতি বছর তাদের নতুন নাটক নিয়ে দর্শকদের মাঝে উপস্থিত হয়, এবছরেও তার ব্যাতিক্রম ঘটেনি।
ট্রিওআর্টস এর প্রযোজনা ‘আশালতা’ লিখেছেন শায়লা শারমিন এবং নাট্যরূপ ও নির্দেশনায় ছিলেন রুবাইয়াৎ শারমিন ঝরা। এবারের নাট্যোৎসবের বিষয়বস্তু হচ্ছে ‘আশা’। তাই এই নাটকের প্রধান দুটি চরিত্রে আশা একজন কেয়ারার এবং সামীর একজন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। তাদের দু’জনের সম্পর্কের মাধ্যমে শায়লা শারমিন দেখাতে চেয়েছেন মানুষ কিভাবে পরগাছার মতো একে অপরের উপর অবলম্বন করে বেঁচে থাকে এবং অসহায় মানুষও সুযোগ পেলে সাফল্যের শিখরে পৌঁছাতে পারে ।
এ নাটকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে ব্রিটেনে অবস্থানরত একটি ব্রিটিশ বাংলাদেশী পরিবারের একজন অসহায় মা প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে চলেছে তাঁর বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুটিকে নিয়ে। কিন্তু এই সামাজিক অবস্থা ভেঙ্গে কেয়ারার এর সহযোগিতায় শিশুটি পিয়ানো বাদক হিসেবে প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়। নাটকে দেখানো হয়েছে পরিবার ও সমাজের সহযোগিতা ও পরিপূর্ণ প্রশিক্ষণ পেলে একজন অটিসটিক শিশুও হয়ে উঠতে পারে সমাজ ও দেশের সম্পদ।
অন্য দশটা শিশুর মতো স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে সক্ষম হয়।
নির্দেশক রুবাইয়াৎ শারমিন ঝরা ‘আশালতা’ নাটক নিয়ে বলেন, “আমাদের কমিউনিটিতে এ ধরনের অসহায় মানুষগুলো যে এখনও পুরোপুরিভাবে গ্রহণযোগ্য নয় তা ফুটিয়ে তোলাই ছিল আমার মূল উদ্দেশ্য।”
নাটকে সামীরের ভূমিকায় দারুন অভিনয় করেছে ইহান শাহীদ, আরো যারা অভিনয় করেছেন তাঁরা হলেন মা- মেহবুবা লিথি, আবীর- আযান চৌধুরী, সনিয়া – কাজী ফারহানা আকতার, তামান্না – রুমি হক, পিয়ানো শিক্ষক – সাদেক আহমাদ চৌধুরী এবং কেয়ারার – রুবাইয়াৎ শারমিন ঝরা। এছাড়াও সহযোগিতায় ছিলেন আয়হাম শাহীদ, অপু চৌধুরী, মেসবাহ শাহীদ, মাসুদ জামান এবং শাহ্নূর হোসেন। বিশেষ কৃতজ্ঞতায় কাজী রুকসানা বেগম, সুদীপ চক্রবর্তী, নাঈম হাসান সুজা, রোকসানা খান, মুশাহেদ আহমেদ এবং শামীম আহসান ।
আশালতা নাটক দেখার সময়ে আবেগে অনেকে কান্নায় ভেঙ্গে পরেন। দর্শকদের অনেকেই প্রশংসা করে তাঁদের মতামত ব্যক্ত করেন।
নাট্য ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ রশিদ বলেন, ‘আমার ছেলে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন, মানুষ তাঁকে ঝামেলা বলে মনে করে। ছোটবেলায় বন্ধুরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিতো তারপর আস্তে আস্তে সব বন্ধ হয়ে যায়। আমি এই নাটকে সামীর চরিত্রের মাধ্যমে আমার ছেলের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছি। এ নাটক আরও তুলে ধরেছে যে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুরা আমাদের সমাজেরই অংশ, তাদের অবহেলা করা উচিৎ নয়। আমি এই নাটক থেকে কিছু মূল্যবান তথ্য পেয়েছি যা আমি আমার ছেলের জন্য কাজে লাগাতে পারবো।’
মোহাম্মদ আজিজ আরো বলেন, ‘লন্ডনে এযাবৎ যত বাংলা মঞ্চ নাটক দেখেছি তার মধ্যে অন্যতম ছিল নাটক ‘আশালতা’। অতি সাধারণ ধারণা নিয়ে যে মানবিক গুণাবলী সমন্বয়ে সম্পূর্ণ সময় দর্শকদেরে বিস্ময়কর অনুভূতির মধ্যে শেষ অবদি পর্যন্ত গ্যালারিতে অপলক চোখে বসিয়ে রাখার কৃতিত্ব নাট্যকারের ও পরিচালকের মেধা ও পরিশ্রমের ফসল। অবুঝ কমলমতি শিশুর অভিনয়ও দর্শক নন্দিত হয়েছে।’
সংস্কৃতিজন ঊর্মি মাযহার বলেন, ‘ নাটকটি খুব শক্তিশালী এবং খুব আবেগপূর্ণ ছিল। আমরা দর্শকেরা সামীরকে স্ট্যান্ডিং ওভেশন দিয়ে উৎসাহিত করতে চাই এবং বলতে চাই তুমি দুর্দান্ত এবং তুমি সক্ষম। It was an evening to remember. I was mesmerised with Samir’s acting skills. How he portrayed the role of an autistic boy. He was reminding me of the boy who played the role of an autistic boy in Amir Khan’s Tere Zameen Par. Well done Sameer and Ashalota team.’
সঙ্গীত শিল্পী লুসি রহমান বলেন, ‘এটি একটি বিস্ময়কর নাটক ছিল, পুংখানুপুংখভাবে উপভোগ করেছি। বিশেষ করে দুই ভাই – ক্ষুদে দু’ শিল্পীর অভিনয় আমাদের মুগ্ধ করেছে। মা এবং কেয়ারারের অভিনয়ও ভালো হয়েছে। শুভ কামনা রইলো আগামীর জন্যে।
রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী ডঃ ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘নাটকটি পুরোপুরিভাবে উপভোগ করেছি। সবচেয়ে ভালো লেগেছে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর ভূমিকায় অভিনয়রত রৌদ্র এর অভিনয়।’
বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক মহাপরিচালক এনামুল হক কিসলু বলেন, আমি নাটক দেখে ‘মুগ্ধ হয়েছি’। আমাদের বাংলাদেশ টেলিভিশনের নৃত্য এবং অভিনয় শিল্পী ঝরার অনবদ্য সৃষ্টিশীল কর্মযজ্ঞ বিদেশের মাটিতে এদেশের সংস্কৃতিকে ধারণ করা এবং প্রচারে নিরলস প্রচেষ্টা দেশপ্রেমের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। ভীষণ ভাবে গর্বিত। অনেক ভালবাসা দোয়া আর শুভ কামনা রইল।’
বাংলাদেশ লোক নাট্যদলের কঞ্জুস নাটকের পরিচালক বলেন, ‘ঝরাকে অভিনন্দন। গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বিষয়ে বৃহত্তর সম্প্রদায় সচেতনতা তৈরিতে থিয়েটার ব্যবহার করার জন্য অনেক ধন্যবাদ।’
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হাবীব রহমান বলেন, আশালতা নাটক দেখার সময়ে আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি।
ট্রিও আর্টস এর কর্ণধার রুবাইয়াত শারমিন ঝরা ‘আশালতা’ নাটকের নেপথ্যের কাহিনী তুলে ধরে বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য সমাজের অবহেলিত দিক গুলো নিয়ে কাজ করা তাই প্রতিবারের মতো এবারও আমরা এমন কিছু নিয়ে ভাবছিলাম যেটি একটু ভিন্ন হতে পারে। যখন আমরা জানতে পারি যে ‘সিসন অব বাংলা ড্রামার’ ২০২৪ এর থিম ‘আশা (Hope)’ তখন আমি বাংলাদেশে অবস্থিত ট্রিও আর্টস এর ডিরেক্টর নাঈম হাসান সুজা এবং লেখিকা ও উপন্যাসিক ফারিদা আহমেদ নিকু’র সাথে কথা বলি এবং নাট্যকার শামীম আহসানকে একটি স্ক্রিপ্ট লেখার জন্যে অনুরোধ করি। তিনি বেশ কয়েক মাস পরে আমাকে ‘আশালতা’ নামে একটি স্ক্রিপ্ট পাঠান। পরে ক্রিয়েটিভে ডিরেক্টর মেহবুবা লিথি’র সাথে কথা বলে কেয়ারারদের নিয়ে গল্প লেখার কথা ভাবি। তারপর শায়লা শারমিনকে অটিসম বা ডিমেন্সিয়া’র সাথে কেয়ারার নিয়ে লিখতে অনুরোধ করলে শায়লা শারমিন অটিসম নিয়ে লিখতে রাজি হয় কারন সে লুসি নামের একটি অটিসটীক বাচ্চার অনুষ্ঠান দেখে মুগ্ধ হয়েছিলো। আর এভাবেই ‘আশালতা’র জন্ম হয়। আশালতা টিম এর সকলের কাছে আমি কৃতজ্ঞ তাদের মূল্যবান সময় এবং সহযোগিতার জন্যে, বিশেষ করে সামীর (ঈহান) এবং আবীরের (আযান) কাছে এবং তাদের পরিবারের কাছে।
উল্লেখ্য, মাসব্যাপী সিজন অব বাংলা ড্রামা’
১লা নভেম্বর শুরু হয়েছে এবং আগামী ২৪শে নভেম্বর সমাপনি দিনে আয়না আর্টস পরিবেশিত ‘ঘুর্ণি’ নাটক মঞ্চায়িত হবে। মাসব্যাপী ‘সিজন অব বাংলা ড্রামায় মঞ্চায়িত নাটকগুলো বাঙালি অভিবাসীদের জীবনসংগ্রাম তুলে ধরেছে।
টাওয়ার হ্যামলেটসের এবারের ‘সিজন অব বাংলা ড্রামা’র থিমস হলো ‘হোপ’ বা ‘আশা’। পহেলা নভেম্বর উদ্বোধন হয়েছে পূর্ব লন্ডনের ব্রাডি আর্টস সেন্টারের থিয়েটার হলে। উদ্বোধনী দিনে সন্ধ্যা ৭টায় ছিল ‘মঞ্চশৈলী’ নাট্য সংগঠনের প্রযোজিত নাটক ‘দি থিভস অব হোয়াইটচ্যাপেল’।
নাটক শুরুর আগে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন রেস্টলেস বিয়িংয়ের রহিমা বেগম, হেড অব আর্টসের ক্যাথারিন বইড, ড্রামা ডির্পাটমেন্টের মজিসলা এডিবইও, লীড মেম্বার অব কালচারাল এন্ড রিক্রিয়েশন-এর কাউন্সিলার কামরুল হোসেইন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন টাওয়ার হ্যামলেটসের নাট্যবিভাগের কর্মকর্তা কাজী রোকসানা বেগম। শো শুরু হওয়ার আগে লেবাননী তরুণী আবু লায়লা প্যালেস্টাইনের মুক্তি সংগ্রাম ভিত্তিক স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন।
বাংলা সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে বিলাতের মাটিতে তুলে ধরার ‘সিজন অব বাংলা ড্রামা’র উদ্বোধনী পর্বের পর মঞ্চস্থ হয় নাটক ‘দি থিভস অব হোয়াইটচ্যাপেল’। নাটকটি লিখেছেন কথাসাহিত্যক ও নাট্যকার সাঈম চৌধুরী। পরিচালনা করেন রাজীব দাশ, সহপরিচালক ছিলেন রুহুল আমিন।
এছাড়া, ২রা নভেম্বর শনিবারে সন্ধ্যায় মঞ্চস্থ হয় ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মঞ্চায়নে শিশুশিল্পীদের অভিনীত ‘হোপ হ্যাপিল্যান্ড’। নাটকটি লিখেছেন নাট্যকার বুলবুল হাসান। সহযোগী ক্ষুদে লেখক ছিলেন সিরিনা, ইয়াসনা, রামিরা, আধ্যিয়াত, অনিন্দিতা, সারথি, ইয়ামীর ও সায়মা। পরিচালনা করেন সৈয়দা সায়েমা আহমেদ।
৩রা নভেম্বর রোববার সন্ধ্যায় মঞ্চস্থ হয় লীডসের ‘মুক্তমঞ্চ’ নাট্য সংগঠনের ‘আশার ধ্বনি শুনি’। নাটকটি লিখেছেন রাশিদ গায়েন, পরিচালনা করেন আশরাফ চৌধুরী মিঠু।
প্রতিদিনের প্রতিটি শো’তে ছিল থিয়েটার হল দর্শকে পরিপূর্ণ, কোনো সিট খালি ছিল না। দর্শনীর বিনিময়ে নাটকগুলো উপভোগ করছেন নাটকপ্রিয় দর্শক।
৩রা নভেম্বর রোববারের আরেকটি বিশেষ আয়োজনের মধ্যে ছিল ‘শাড়ী’ প্রদর্শনী ও বিক্রয়। দুপুর ১টা থেকে ব্রাডি আর্টস সেন্টারের মূল হলে আয়োজিত এ শাড়ী মেলায় অংশ নেয় বাঙালি নারীদের ব্যবস্থাপনায় ৮টি স্টল। সঙ্গে ছিল কয়েকটি বাঙালি খাবার দোকানও। মনোমুগ্ধকর এ প্রর্দশনী ও মেলায় খাদ্য রসিকরা যেমন বাঙালি মজাদার খাবার খান, তেমনি শাড়ী ক্রয়-বিক্রয়েও ছিল উল্লেখ্যযোগ্য নারী সমাগম। মন খুলে কেনা-বেচায় নারীদের অংশগ্রহণ ছিল চাঞ্চল্যেপূর্ণ। ব্যতিক্রমী এ আয়োজনটি বেলা বাড়ার সাথে সাথে রূপ নেয় অনন্য মিলনমেলায়।
সিজন অব ড্রামা’র প্রথম দিন থেকে শুরু হয়েছে চিত্র প্রদর্শনী। বাংলাদেশী চিত্রশিল্পীদের আঁকা চিত্র ব্রাডি আর্টস সেন্টারের ভেতরের হলরুমের দেয়াল বর্ণিল চিত্রে রাঙিয়ে উঠেছে। দর্শকরা ঘুরে ঘুরে দেখছেন ও উপভোগ করছেন। প্রতিটি চিত্রে রয়েছে বাংলার প্রকৃতি ও জীবনবৈচিত্রের নানা রূপ।
‘যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ,/ প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল,/ এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি/নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার’ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য-এর কবিতার প্রত্যয় নিয়ে এ সিজন অব ড্রামার ডিসমিস থিয়েটার গ্রুপের নাটক ‘ওয়ান্স ইন এ সঙ্গস’ সম্প্রতি মঞ্চস্থ হয়েছে। গত ৮ নভেম্বর শুক্রবার সন্ধ্যায় কুইনমেরী ইউনির্ভাসিটির প্রিন্টার স্টুডিওতে মঞ্চস্থ হওয়া নাটকে অভিবাসী বাঙালি সমাজের নতুন প্রজন্মের সংকট ও সম্ভাবনা ছিল নাটকের মূল থিম। ১৫ বছর বয়েসী এক তরুণীর স্বপ্ন ও পরিবারের টানাপোড়নের সংগ্রামী বৃত্তান্ত দৃশ্যমান হয় নাটকে।
৭ নভেম্বর মঞ্চস্থ হয় ফারাহ বি ওয়ানের ‘কাম ওয়াশ ইউর সিনস’ব্রাডি আটর্স সেন্টারে। নাটকের থিম ছিল বিশ্বে ক্রমাগত বেড়েচলা জেনোসাইড ও মানবিকতার লঙ্গনের প্রতিধ্বনি। ৬ নভেম্বর কুইমেরী ইউনির্ভাসিটির প্রিন্টার স্টুডিওতে মঞ্চস্থ হয় ‘ডোন্ট হোল্ড ব্যাক দি রিভার’। মঞ্চস্থ করে মিত্রাদয়া সংগঠন। ব্রিটেনে আসা বাংলাদেশী অভিবাসী জীবনের সংকট নিয়ে এই নাটক দর্শকদের মন কাড়ে।
৯ই নভেম্বর মঞ্চস্থ হয়েছে ‘আশালতা।’
১০ই নভেম্বর সাহিত্য ও ইতিহাস নির্ভর পূর্ণাঙ্গ নাটক উপহার দেন ড. মুকিদ চৌধুরীর পরিচালিত ‘দি বাংলা মুভমেন্ট থিয়েটার আটর্স’গ্রুপ। এই গ্রুপের ‘ওয়ারিওর’ বাংলায় ‘যোদ্ধা’ মঞ্চস্থ হয়েছে ১০ নভেম্বর ব্রাডি আটর্স সেন্টারে সন্ধ্যায়। ড. মুকিদ চৌধুরী লিখিত ‘ওয়ারিওর’ বাংলায় ‘যোদ্ধা’ নাটকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে নির্মিত কাহিনি ছিল ত্রিপুরা ও খোয়াই রাজ্যের অর্ন্তঘাত, বিশ্বাঘতকতার বিনির্মিত নতুন এক আখ্যান। বিশ্বরাজনীতি এবং বাংলাদেশের অর্ন্তঘাতমূলক রাজনীতির ছায়া প্রতিফলিত হয়েছে পুরো নাটকে। নাটকের ভাষা ও সংলাপ ত্রিপুরার রাজভাষা সংস্কৃত ভাষার প্রভাবে অনেকটা যাত্রাপালার সংলাপকে মনে করে দিয়েছে। অভিনয় ছিল হৃদয়গ্রাহী ও উপভোগ্য।
এদিকে, নাটক ছাড়াও ২রা নভেম্বর ‘সেন্টার স্টেইজ’ উপস্থাপন করে ‘ইউজ ইওর ওয়ার্ডস’। পরিবেশিত হয় কুইনমেরী ইউনিভার্সিটির প্রিন্টার স্টুডিওতে। কবিতা ও শব্দের ব্যবহার নিয়ে কথন ছিল পুরো অনুষ্ঠানে ভিন্ন মাত্রার একটি পরিবেশনা।
৩ নভেম্বর কুইনমেরী ইউনির্ভাসিটির পিন্টার স্টুডিওতে কবি শামীম আজাদ ও মি. মাইকের উপস্থাপনায় ‘ব্রিটিশ বাইলেঙ্গুয়াল পয়েট্রি কালেক্টিভ’র ‘ হোপ উইথ ট্যাগুর’ কাব্যপাঠ, সঙ্গীত, কবিতাচর্চা ও অনুবাদ ওয়ার্কসপ অনুষ্ঠিত হয়। অংশগ্রহণ করেন বাঙালি, শ্বেতাঙ্গসহ আফ্রো-এশিয়ান সংস্কৃতিকর্মী, কবি ও লেখকবৃন্দ।
৫ই নভেম্বর ‘ডিভেইট: আর ফেয়ারী টেইলস লাইজ অর হোপ’ উপস্থাপন করেন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব বুলবুল হাসান। বিতার্কিকদের অংশগ্রহণে এ অনুষ্ঠানটি কুইনমেরী ইউনির্ভাসিটির প্রিন্টার স্টুডিওতে অনুষ্ঠিত হয়। সৃজনশীল এ পরিবেশনা মুগ্ধ করে দর্শক ও শ্রোতাদের।
৯ ও ১০ই নভেম্বর ছিল ‘সৌধ, সোসাইটি অব পয়েট্রি এন্ড ইন্ডিয়ান মিউজিক’ পরিবেশিত পয়েট্রি নিয়ে দুটি উপস্থাপনা। ৯ই নভেম্বর ‘ইন সার্চ অব দি সউল অব সিলভিয়া প্লাথ’ আধুনিক ইংরেজী সাহিত্য ও কবিতায় সিলভিয়া প্লাথের সৃষ্টি ও দর্শন সম্বলিত কাব্যপাঠ এবং মিউজিক। কবি টি এম কায়সারের উপস্থাপনায় উঠে আসে ইংরেজি সাহিত্যের বিশ্বমাত্রিকতা। আয়োজনটি ছিল বেথনালগ্রীনের রিসমিক্স থিয়েটার হলে। দ্বিতীয়টি অনুষ্ঠিত হয় হ্যানবারী স্ট্রিটের কবি নজরুল সেন্টারে। বিষয় ছিল ‘রি-রিডিং লোরকা, নজরুল এন্ড হিকমত’। বিশ্বমাত্রিক এই তিন কবির সৃষ্টি নিয়ে কথা ও পাঠ বোদ্ধা শ্রোতাদের উপস্থিতিতে ছিল মনোগ্রাহী।
উল্লেখ্য, এবারের মঞ্চায়িত ‘ওয়ারিওর বা যোদ্ধা’ ছাড়া মঞ্চস্থ নাটক ও কবিতাপাঠসহ অনুষ্ঠানগুলোর বৈশিষ্ট ছিল দ্বি-ভাষিক। ইংরেজি ও বাংলা বাইলেঙ্গুয়েল হওয়ায় নতুন প্রজন্মের অভিনয় ও দর্শক সারিতে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে বাঙালি অভিবাসন ও বাংলা এবং বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে ব্রিটিশ-বাঙালিদের মনোযোগ লক্ষ্য করার মতো ছিল। মূলধারার শ্বেতাঙ্গসহ অন্যান্য আফ্রো-ক্যারভিয়ান ও এশিয়ান দর্শকের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য হারে এবারে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রত্যেকটি নাটকেই এমন দৃশ্য চোখে পড়ে।
দর্শনীর বিনিময়ে অনুষ্ঠিত নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানমালায় বাঙালিসহ মূলধারা এবং আফ্রো-এশীয় সংস্কৃতি বোদ্ধাদের অংশগ্রহণ টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল একটি আশাজাগানিয়া সৃজনশীল ধারা তৈরী হয়েছে।