নারীর প্রতি মানসিকতার পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়েছেন সায়মা ওয়াজেদ
নিউজ ডেস্ক
সত্যবাণী
ঢাকাঃ বাংলাদেশে ধর্ষণ ও নারী নিপীড়নের ঘটনা কমাতে সবার আগে নারীর প্রতি মানসিকতার পরিবর্তন আনার পরামর্শ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুল। তিনি নিপীড়নমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সবাইকে আন্তরিক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমাদের দেশকে আমরা এমন একটা জায়গায় নিয়ে যেতে চাই, যেখানে কোনও মেয়ে হয়রানির শিকার হবে সঙ্গে এগিয়ে যেতে পারি। নারী-পুরুষ একসঙ্গে মিলে নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ করি।’ সেই সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য ছোটবেলা থেকেই নারী-পুরুষের সমতার শিক্ষা দেওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি।
বুধবার (১৪ অক্টোবর) রাতে আওয়ামী লীগের গবেষণা সেল সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই), জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের (এনএইচআরসি) যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ‘পাবলিক প্লেসে নারীর নিরাপত্তা’ বিষয়ক সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইনের উদ্বোধনী বক্তব্যে এসব কথা বলেন সায়মা ওয়াজেদ হোসেন।কাঙ্ক্ষিত ওই সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য ঘরের মধ্যে ছোটবেলা থেকেই ছেলে ও মেয়ে শিশুদের সমান অধিকার ও সম্মান দিয়ে বড় করার পরামর্শ দেন তিনি। একটি মেয়ে শিশু যেনো ছেলের মতো সাহস, তেজ নিয়ে চলতে পারে, সেই শিক্ষা ও মর্যাদাবোধ তার মধ্যে তৈরি করার পরামর্শ দেন সায়মা ওয়াজেদ। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে ওই রকমভাবে সবাইকে শেখানো হোক যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনও তফাৎ নাই। আমরা ইক্যুয়াল। আমরা সব জায়গায় ঘরে হোক, বাইরে হোক যেখানেই হোক, রাস্তাঘাটে হোক, স্কুলে হোক এবং কাজকর্মের জায়গায় যেনো আমরা নারীর সম্মান তৈরি করি।’
নারী নির্যাতন রুখতে স্কুল-কলেজ, কর্মক্ষেত্র বা পথে-ঘাটে যেখানেই নারী নিপীড়নের ঘটনা ঘটতে দেখা যাবে, সেখানেই নারী-পুরুষ সবাইকে এক হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলারও আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ। তিনি বলেন, ‘একটা মেয়ে যদি এক জায়গায় দাঁড়ায় আমরা যদি দেখি যে, তাকে হ্যারাস করা হচ্ছে, তার সঙ্গে প্রতিবাদ করার মতো যদি কেউ না থাকে পাশে, তাহলে সে একা কী করবে? কোনও মানুষই একা কী করবে? তার সঙ্গে তো কাউকে না কাউকে থাকতে হবে, পাশে থাকতে হবে। আমাদের ছেলেদের এ শিক্ষাটা দিতে হবে ছোটবেলা থেকে, ঘরের থেকে। বড় হয়ে নিজেদের সংসার করবে, ওই জায়গাটা তো তাকে তৈরি করে দিতে হবে। সম্মানটা কিন্তু ঘরের থেকে সবার আগে হয়।’
সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) ট্রাস্টি ও কো-চেয়ারম্যান সায়মা ওয়াজেদ এখন ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) দূতের ভূমিকায় আছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-ডব্লিউএইচওর মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা প্যানেলের সদস্যও করা হয়েছিল তাকে।
এই মানসিক বিশেষজ্ঞ বলেন,‘হ্যা, মেয়েদের সেলফ প্রটেকশন স্কিলস জানা উচিত, অফকোর্স। কিন্তু আমাদের কেন এভাবে থাকতে হবে? কেন আমরা জেন্ডার আইডেন্টিটি নিয়ে চলবো? আমরা মেয়ে বলে কেন ভয়ে চলতে হবে? এক্সট্রা কেয়ারফুলি চলতে হবে, অন্যভাবে চলতে হবে? আমাদের যেটা মন চায়, যেটা ইচ্ছা, যেটা আমরা করতে পারি, সেটা কেন আমরা করতে পারবো না?’
বাঙালির ইতিহাস ও নারীর প্রতিবাদী চেহারাকে তুলে ধরে সায়মা ওয়াজেদ বলেন, ‘‘আমি যদি জোর গলায় কথা না বলতে পারি নিজের বাড়িতে, আমাদের যদি সব সময় বলা হয় ‘না না না, চুপ থাকো’, ‘তুমি বেয়াদবি করো না’, ‘শান্ত থাকো, মাথা ঠাণ্ডা রাখো, ‘প্রতিবাদ করো না’, কিন্তু ওটা তো আমাদের বাঙালি জাতির ইতিহাসে নাই। প্রতিবাদের সময় বাঙালির সবার আগে কিন্তু মহিলারাই ছিল। আমাদের ইতিহাসই যখন বলে, আমরা প্রতিবাদ আগে করবো। তা এখন কেন আমরা চুপচাপ থাকবো? ভাই-বোন একসঙ্গে মিলে প্রতিবাদ করতে হবে। একা একা করলে হবে না।’’
এই ওয়েবিনারে বাংলাদেশে পথে-ঘাটে চলতে নারীদের যৌন নিপীড়নের চিত্র একটি ভিডিও ডকুমেন্টারিতে দেখানো হয়। দেশের নানা প্রান্ত থেকে তরুণরা যুক্ত হয়ে নিজেদের দেখা নিপীড়নের ঘটনা জানান এখানে। এ বিষয়ে সায়মা ওয়াজেদ বলেন, ‘‘কোথাওকোনও একটা মেয়েকে যেনো ওই প্রশ্ন না দেওয়া হয়, তোমরা এ রকম না করলে কিন্তু তোমার কিন্তু উন্নতি হবে না, চাকরি চলে যাবে। এটা প্রত্যেকটা প্রফেশনে হচ্ছে। কিন্তু এটাকে আল্টিমেটলি আমরা দেখি ভায়োলেন্স হিসেবে। সেক্সুয়াল আগ্রাসন, রেইপ এগুলো পরে আসছে। কিন্তু এসব যখন আমরা ইগনোর করে যাই, তখন কিন্তু প্রবলেম থেকে যায়। আর তাতে সোশ্যাল চেঞ্জটাও আসবে না।”
নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ প্রতিষ্ঠায় কাজ করার অনুরোধ জানিয়ে সায়মা ওয়াজেদ বলেন, ‘কাজের জায়গায় ভালো অ্যাটিচুড-ভালো পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যাতে কোনও মেয়েকে হয়রানির শিকার না হতে হয়। কেননা, আসল জিনিসটা হচ্ছে সম্মান। আমরা মেয়েদেরকে ছোটবেলা থেকে অন্যভাবে দেখি। মনে করি না তাদের সম্মান দেওয়ার যোগ্য। এই মানসিকতা পরিহার করতে হবে।’
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সামাজিক ও ধর্মীয় নানা বিষয়কে কাজে লাগিয়ে নারীদের সম্মানের জায়গাটি নষ্ট করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন সায়মা ওয়াজেদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘গত ৩০ বছরে আমাদের কালচার, ধর্ম, বিভিন্ন জিনিস ব্যবহার করে নারীদের এই যে সম্মান দেওয়ার কথা, এটা চলে গেছে। মেয়েরা কী পরলো, কীভাবে চললো, কোথায় গেলো, কোন সময় গেলো, কোন জায়গায় গেলো, খেলাধুলা করবে কিনা, এসব নেগেটিভ বিষয় সামনে এনে ঘুরেফিরে দোষ দেওয়া হয়।’ এর থেকে বেরিয়ে এসে নারী-পুরুষ সবাইকে মানুষ ভাবার পরামর্শ দেন সায়মা ওয়াজেদ হোসেন।
‘পাবলিক প্লেসে নারীর নিরাপত্তা’ বিষয়ক সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সচেতনতা, নারীশিক্ষা ও সমঅধিকার নিশ্চিতকরণসহ নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়ে দেশব্যাপী সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে বলে সিআরআই এর পক্ষ থেকে এ ওয়েবিনারে জানানো হয়।ওয়েবিনারে তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা ইন্দিরা, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাসিমা বেগম, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক প্রধান সমন্বয়ক জুয়েনা আজিজ ও আইজিপি বেনজির আহমেদ যুক্ত ছিলেন।