কমিউনিটি নেতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আব্দুস সালিক আর নেই

নিউজ ডেস্ক
সত্যবাণী

লন্ডন: বিলেতের বাঙালী কমিউনিটির পরিচিত মূখ,  বর্নবাদ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রভাবশালী কমিউনিটি নেতা ও বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আব্দুস ছালিক আর নেই (ইন্না লিল্লাহ ই ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। ১৫ অক্টোবর বৃহস্পতিবার সকাল ১১ টায়  রয়েল লন্ডন হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বেশ কিছুদিন যাবত তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার নামাজে জানাজার সময় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এখনো নিশ্চিত হয়নি। তাঁর মৃত্যুতে কমিউনিটিতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

বেশ কিছুদিন যাবত ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপজনিত নানান জটিল রোগে ভোগছিলেন বিলেতে বাংলা সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারে নিবেদিতপ্রাণ এই জনপ্রিয় কমিউনিটি নেতা। তাঁর বয়স হয়েছিলো ৬৯ বছর।

মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী হাসনা সালিক, এক কন্যা সংগীত শিল্পী শাপলা সালিক, দুই পুত্র উচ্ছল সালিক ও সচ্ছল সালিক এবং নাতি নাতনিসহ অসংখ্য বন্ধু-বান্ধব গুনগ্রাহী রেখে গেছেন। 

জনাব আব্দুস সালিক সিলেট জেলার ওসমানীনগর উপজেলাধীন কাজির গাঁও গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। পরবর্তীতে গোয়ালা বাজার তাজপুরের নিকটবর্তী বর্তমান ওসমানীনগর থানার পার্শবর্তী গ্রাম ইলাশপুরে বসতি স্থাপন করেন। পূর্ব লন্ডনে তিনি বো বেথনালগ্রীণ এলাকায় বাস করলেও ব্রিকলেনে ছিল তার ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান  ’সালিকস্ রেষ্টুরেন্ট’, ’বনফুল’ এবং ’মিষ্টিদেশ’। 

আব্দুস সালিকের জন্ম ১৯৫১ সালের ১লা আগস্ট। তিনি তাজপুর মঙ্গলচন্ডি নিশিকান্ত উচ্চবিদ্যালয় থেকে মেট্টিক পাশ করেন এবং সিলেট এমসি কলেজ থেকে আই এ পাশ করেন। পরবর্তীতে স্নাতক (বানিজ্য) শ্রেনিতে সিলেট মদমমোহন কলেজে ভর্তি হন। রাজনীতি এবং সমাজ সচেতন জনাব আব্দুস সালিক ছাত্র জীবন থেকেই রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। তিনি তৎকালীন পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন  মেনন গ্রুপের সাথে জড়িত ছিলেন। মুলত বাম ধারার চিন্তা চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন। তখন থেকেই সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও তার সরব পদচারনা ছিলো। নিজে গান লিখতেন, গান গাইতেন এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনে নেতৃত্ব দিতেন। 

১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি যুক্তরাজ্যে চলে আসেন। কর্মস্থল হিসাবে বেছে নেন বাঙালি অধ্যুসিত পূর্ব লন্ডন এলাকা। এখানে প্রথমে পোশাক শিল্প এবং পরবর্তীতে রেষ্টুরেন্ট ব্যাবসায় মনোনিবেশ করেন। একজন সফল ব্যাবসায়ী জনাব আব্দুস সালিক লন্ডনেও ব্যবসার পাশাপশি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি স্থানীয় লেবার পার্টিতে যোগ দেন এবং ট্রেড ইউনিয়নে যুক্ত হন। বৃটেনে তখন উত্থাল বর্ণবাদি আক্রমন চলছে। পুর্ব লন্ডনে বাঙালিদের পক্ষে তিনি সামনের সারিতে থেকে বর্ণবাদীদের রুখে দাঁড়ান। তিনি স্থানীয় রাজনীতির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অঙনেও খুবই পরিচিতি লাভ করেন। দিশারী শিল্পী গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেই আশির দশকেই তিনি মুলধারার টেলিভিশনে বাংলা গানের অনুষ্ঠান করে বঙালিদের মধ্যে সাড়া ফেলে দেন এবং সবার দৃষ্টি কাড়েন।। তার নিজের কণ্ঠে গাওয়া ‘‘বাউলা কে বানাইলো রে.. এবং সোনা বন্দে আমারে পাগল করিলো… ‘‘ এসব হাসান রাজার গান লোকজন তখন আগ্রহভরে শোনতেন। বেশ কিছুদিন তিনি পূর্বলন্ডনের নজরুল সেন্টার পরিচালনায়ও নিয়োজিত ছিলেন। 

নিজ দেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি বিদেশে তোলে ধরার পাশাপাশি আব্দুস সালিক নিজ এলাকার উন্নয়নেও ব্যাপক অবদান রাখেন। যুক্তরাজ্যে থেকেও তার নিজ এলাকার উন্নয়নে তিনি সবসময় সোচ্চার ছিলেন। তিনি বালাগঞ্জ আদর্শ উপজেলা সমাজ কল্যাণ সমিতিতে নেতৃত্ব দেন এবং প্রবাসি বালাগঞ্জ এডুকেশন ট্রাস্ট এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষা বিস্তার ও শিক্ষা উন্নয়নে এ সংগঠনের সুনাম আজ বহুল পরিচিত। তিনি এ সংগঠনের সভাপতি হিসাবেও দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। পূর্ব লন্ডনের ব্রিকলেন এলাকার নাম বাংলা টাউন প্রতিষ্ঠার সাথে আব্দুস সালিক খুবই সক্রিও ছিলেন। 

২০০৮ সাল থেকে তিনি ফিরে যান বাংলাদেশে। মাঝেমধ্যে লন্ডন স্বল্প সময়ের জন্য এলেও সেখানেই বেশীরভাগ সময় থাকতেন। ঢাকার রামপুরায় তার নিজের ফ্ল্যাট বাসায় অথবা সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার ইলাসপুর গ্রামে ছিলো তার অবসর সময় কাটানোর প্রধানতম স্থান। চলতো বিরামহীন ভাবে সঙগীত ও সংস্কৃতিচর্চা। নিজে যেমন গাইতেন, তেমনি শিল্পীদের নিয়ে গানের অনুষ্ঠান করতেন নিয়মিত। আড্ডায় সংগীতে মেতে রইতেন সবসময়। নিজের কন্ঠে গাওয়া কয়েকটি গানের একটি সিডি প্রকাশ করেন। দুস্থ শিল্পীদের কল্যাণে তিনি প্রচুর অর্থ সাহায্য দিতেন। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি দান করতেন প্রচার না করার শর্তে। 

চলতি বছর আগস্ট মাসের ১০ তারিখে তিনি লন্ডনে ফিরেন। কিন্তু পরের দিন শরীর অসুস্থ বোধ করলে রয়েল লন্ডন হাসপাতালে যান। সেখানে পরীক্ষার পর তার করোনা ভাইরাস কভিট-১৯ ধরা পড়ে। শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায় আশষ্কাজনক হারে। তারপর দুইমাসেরও অধিক সময় হাসপাতালে থেকে অবশেষে ১৫ই অক্টোবর সকালবেলা শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।

ব্রিকলেইন কে বাংলা টাউনে রূপান্তরিত করা, বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন, আলতাব আলী পার্ক নামকরণ, শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা, বৈশাখী মেলা, লন্ডনে বাংলা ভাষা চর্চাসহ বাংলাদেশীদের বিভিন্ন দাবি দাওয়া প্রতিষ্ঠায় সদ্য প্রয়াত আব্দুস সালিক সবসময় ছিলেন অগ্রণী ভূমিকায়।

বিলেতে যাদের হাত ধরে বাংলা সংস্কৃতি মূলধারায় পরিচিত হয়েছে, তাদের মধ্যে একজন ছিলেন প্রয়াত আব্দুস সালিক। সেই ৭০ দশকেই মুলধারার সাথে তিনি যুক্ত করেছিলেন বাংলা সংস্কৃতিকে। ১৯৭৭ সালে তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠিত সাংস্কৃতিক সংগঠন দিশারী শিল্পী গোষ্ঠির মাধ‍্যমে বিবিসি ওয়ানে পরিবেশিত হয়, ‘সোনা সোনা সোনা, লোকে বলে সোনা’ এই গানটি।  ১৯৭৮ সালে বিবিসি ওয়ানে পরিবেশিত হয় হাসন রাজার গান। ১৯৮১ সালে ট্রেড ইউনিয়নের জন‍্য তিনি রচনা ও পরিবেশনা করেন, ‘আমরা এসেছি সুদুরের ডাক শুনে, সাত সাগরের অচেনা ঢেউ গুনে’ গানটি। ১৯৮৪ সালে তাঁর দল বিখ‍্যাত রয়েল আর্লবাট হলে সেভ দ‍্যা চিল্ড্রেনের অনুষ্ঠানে পরিবেশন করেছে গান। ব্রিকলেনের তাঁর মালিকানাধীন সালিকস রেষ্টুরেন্ট তখনকার সময়ে বিলেতে বাংলা সংস্কৃতির একটি কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিলো।

ইউটিউব ক্যাপশন:১৯৭৯ সালে আব্দুস সালিক প্রতিষ্ঠিত দিশারী সাংস্কৃতিক সংগঠনের উদ্যোগে স্কটল্যান্ডে পরিবেশিত অনুষ্ঠান।

You might also like