মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিজয় উল্লাস
আবু মুসা হাসান
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তৎকালীন রমনা রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকন্ঠের ঘোষণা ‘‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম“ শোনার পর কোন বাঙালির মনেই আর দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকলোনা। সারা দেশের মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো। সাতই মার্চ এর এই জনসভার আগেই বঙ্গবন্ধু বাঙালির একচ্ছত্র নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনেই তাঁর নেতৃত্ব পাকাপোক্ত হয়ে যায়। ঐ নির্বাচনে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে জনসংখ্যার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ হয়েছিল ১৬২ টি আসন। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ভেবেছিল যে, মুসলিম লীগ এবং জামায়াতে ইসলামী জাতীয় দলগুলোর তথাকথিত ‘জনপ্রিয়তার‘ ফলে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারবেনা। কিন্তু তাদের হিসেব-নিকেষের সাথে বাস্তবতার কোন মিলই ছিলনা। তারা আন্দাজই করতে পারেনি যে, মুক্তিপাগল বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুকে একচ্ছত্র নেতা হিসেবে বেছে নিয়েছে। তাই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা নৌকা প্রতীক নিয়ে ১৬২ টি আসনের মধ্যে ১৬০টি আসনেই জয়লাভ করে। বাকী দুটি আসনের একটিতে পিডিএম এর নুরুল আমীন ময়মনসিংহ থেকে এবং অপরটিতে চাকমা রাজা ত্রিদীব রায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা থেকে নির্বাচিত হতে পেরেছিলেন।
‘৭০ এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর না করার জন্য ষড়যন্ত্র শুরু করে। জুলফিকার আলী ভূট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি মাত্র ৮১ টি আসনে জয়লাভ করলেও নির্লজ্জের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য দৌড়-ঝাঁপ শুরু করে দেয়। ৩রা মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন আহবান করা হলেও তা বানচাল করার জন্য নানামুখী ষড়যন্ত্র শুরু করে। ১লা মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া ৩রা মার্চের জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দিলেন। ঐ সময় পরিস্কার বোঝা যাচ্ছিল যে, পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বাঙালির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেনা ।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে আয়োজন করা হয়েছিল ৭ই মার্চের জনসভা। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য সবাই ছুটে এসেছিল রমনা রেসকোর্স মাঠে (বর্তমানে সোহরায়ার্দী উদ্যান) মনে আছে, পাকিস্তানী এজেন্টরা প্রচার করছিল যে জনসভাস্থলে আকাশ থেকে মেশিনগানের গুলি ছোঁড়া হবে, বোমা নিক্ষেপ করা হবে ইত্যাদি। কিন্তু কেউ এসব প্রপাগান্ডায় কর্ণপাত করেনি। ঢাকা শহর এবং আশে-পাশের জেলাগুলো থেকে হাজার হাজার মানুষ ছুটে এসেছে। আমরা আজিমপুর নতুন পল্টন লাইনের বন্ধুরা সবাই একসাথে মিছিল করে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য রওয়ানা দিলাম। মিছিল যতই অগ্রসর হচ্ছিল, মিছিলের কলেবরও তত বড় হচ্ছিল। চারদিক থেকেই গগনবিদারী শ্লোগান দিয়ে মিছিল আসছিল। সবার হতেই কিছু না কিছু ছিল। তবে অধিকংশের হাতেই ছিল বাঁশের লাঠি। আমাদের মিছিলের সামনে যারা ছিলাম তাদের হাতে ছিল বর্শাফলক। পথে দেখা হয়েছিল জিঞ্জিরা থেকে আগত একটি মিছিলের সাথে। তাদের হাতে ছিল নৌকার বৈঠা। রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে পৌঁছলাম, ততক্ষণে আক্ষরিক অর্থেই রেসকোর্স ময়দানটি একটি জনসমুদ্রের রূপ ধারণ করে। বঙ্গবন্ধু যখন ভাষণ দিচ্ছিলেন তখন প্রতিটি মুহুর্তেই মনে হয়েছে আমি যেন একটি জনসমুদ্রের উত্তাল ঢেউ এ ভাসছিলাম।
এদিকে, বঙ্গবন্ধুর আহবানে দেশবাসী অসহযোগ আন্দোলনে যেভাবে সাড়া দিয়েছিল, তার আর কোন দ্বিতীয় নজির নেই। ঐ সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সরকারী অফিস-আদালত ব্যাংক-বীমা সবকিছুই চলছিল তাঁর নির্দেশে। অন্যদিকে সর্বত্র চলছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে চলছিল আমাদের ছাত্র ইউনিয়নের প্রশিক্ষণ। ছাত্রলীগও একইভাবে আয়োজন করেছিল প্রশিক্ষণের। ইউনিভার্সিটি অফিসার্স ট্রেনিং কোর্স (ইউওটিসি) এর ছাত্র ক্যাডেটরা ডামি রাইফেল দিয়ে আমাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র লীগের ব্যাপক সংখ্যক ছাত্রী কর্মীরাও প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছিল। আমার মনে আছে, প্রশিক্ষণ নেয়ার পর আমরা ডামি রাইফেল নিয়ে ঢাকার রাজপথে মিছিল করে মহড়া দিয়েছিলাম। মোট কথা, চারিদিকে সাজ সাজ রব চলছিল। সবাই প্রস্তুত মুক্তিযুদ্ধ করার জন্য, স্বাধীনতার জন্য।
অসহযোগ আন্দোলন চলার সময় পাকিস্তানী সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং তার দোসর জুলফিকার আলী ভূট্টো বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনার নাম করে একদিকে কালক্ষেপণ করছিল এবং অন্যদিকে বাঙালী জাতির ওপর নারকীয় হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ২৫শে মার্চ রাতের আঁধারে হানাদার বাহিনী অতর্কিত শুরু করলো বাঙালি নিধন যজ্ঞ। তবে মুক্তিপাগল বীর বাঙালি এই নারকীয় বীভৎস হামলায় ভীত সন্ত্রস্ত না হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে গড়ে তুললো প্রতিরোধ। তাই ২৫ শে মার্চ, শুধু কালো রাত নয়, পাকস্তানী হায়েনাদের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রতিরোধের রাতও বটে।
আমার দেখা সেই প্রতিরোধের বর্ণনা এখানে তুলে ধরছি। ২৫শে মার্চ রাতে আজিমপুর নতুন পল্টন লাইনে আমরা কয়েকজন বন্ধু শাহীনের বাসায় আড্ডা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ শাহীনের বড় ভাই সালেহ এসে বললেন, পাকিস্তানী সৈন্যরা হামলা শুরু করতে যাচ্ছে, আর তোরা এখনও বসে আছিস। আমরা সাথে সাথে বেড়িয়ে পড়লাম। আমাদের নতুন পল্টন লাইন এলাকাটা হচ্ছে নিউ মার্কেট সংলগ্ন তৎকালীন ইপিআর বা পিলখানার পাশে (বর্তমানে বিজিবি)। ইপিআর-এর গেট থেকে নিউ মার্কেট পর্যন্ত রাস্তার দু‘ধারে সারি সারি অনেক বড় বড় গাছ ছিল। ইপিআর গেইটে এসে দেখলাম শত শত মানুষ কুড়াল নিয়ে রাস্তার দু‘পাশের গাছ কেটে ব্যারিকেড দেয়ার কাজে লেগে পড়েছে। আরও একটু এগিয়ে দেখলাম আর্ট কলেজের হোস্টেলের পাশে অবস্থিত সেই সময়কার সিএন্ডবি‘র কম্পাউন্ড থেকে লোকজন একটি পরিত্যাক্ত প্রকান্ড ভারী মেশিনকে টেনে নিয়ে আসছে। রাস্তার ওপর মেশিনটিকে এনে ‘জয় বাংলা‘ শ্লোগান দিতে দিতে আক্ষরিক অর্থেই ঐ প্রকা- ভারী মেশিনটি উল্টিয়ে কয়েকটি গাছের তৈরী একটি ব্যরিকেডের ওপর ফেললো। শতশত পিঁপড়া একজোট হয়ে যেমন ভারী জিনিস বয়ে নিয়ে যায়, ঐ দৃশটা তেমনই ছিল।
আরও একটু এগিয়ে আমরা নিউমার্কেটের মোড়ে পৌঁছার পর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নারকীয় হামলা শুরু হয়ে গেল। প্রথমে মীরপুর রোড দিয়ে একটি মিলিটারী কনভয় আসতে দেখলাম। হলুদ হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়িগুলো এগিয়ে আসতে লাগলো। এর আগে আমরা ঐ ধরনের হেডলাইট ঢাকা শহরে দেখিনি। এসব অত্যাধুনিক সামরিক যানগুলো পূর্ব পাকিস্তানে আনা হয়েছিল বাঙালি নিধনের জন্য। হঠাৎ করে সমস্ত ঢাকা শহর জুড়ে শুরু হলো প্রচ- গোলাগুলি। আমরা কয়েক বন্ধু দেয়াল টপকে আজিমপুর কলোনীতে আশ্রয় নিলাম। সারারাত বাইরে কাটিয়ে ভোর বেলায় বাসায় ফিরে দেখি যে ইপিআর-এর এক জোয়ান আমাদের ঘরে এসে আশ্রয় নিয়েছে। ঐ জোয়ান আমাকে জানালো যে, ব্যারাকে ঘুমন্ত অবস্থায় পাকিস্তানীদের হামলার শিকার হয়ে তাদের অনেকেই নিহত হয়েছে। যারা সুযোগ পেয়েছে তারা তাদের হাতিয়ার নিয়ে ব্যারাক থেকে পালিয়ে চলে এসেছে এবং আমাদের পাড়ার বিভিন্ন বাড়ীতে আশ্রয় নিয়েছে। আমরা তাদের নিয়ে আসা থ্রি নট থ্রি রাইফেলগুলো একটি বাড়ীতে জড়ো করলাম। ২৬ শে মার্চ আমাদের পাড়ার খসরু ভাই (প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা এবং পরবর্তীকালে ‘ওরা এগার জন‘ ছবির নায়ক কামরুল আলম খান খসরু) এসে রাইফেলগুলো নিয়ে গেলেন।
২৭শে মার্চ কারফিউ প্রত্যাহার হওয়ার সাথে সাথেই আমাদের মহল্লাটা ফাঁকা হয়ে গেল। ইপিআর এর পাশে থাকাটা কেউই নিরাপদ মনে করলোনা। কারন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আনা সৈন্যদের অনেককেই ইপিআর ব্যারাকেই জড়ো করা হয়েছিল।
মা-বাবা এবং দুই বোনকে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়য়ের সন্ধানে বের হয়ে পড়তে হলো। ছুটলাম অজানার উদ্দেশ্যে। হাজার হাজার মানুষের মিছিলে সামিল হয়ে আমরা গিয়ে পৌঁছলাম জিঞ্জিরায়। দেখা পেয়ে গেলাম আমাদের পাড়ার রেশন দোকানের মালিক সাথে। আমাদের দূর-সম্পর্কের এই আত্মীয় পরিবার পরিজন নিয়ে জিঞ্জিরায় চলে এসেছেন। সবাই মিলে কয়েক রাত কাটালাম এক জিঞ্জিরাবাসীর বাড়ীতে। সম্পূর্ণ অপরিচিত হলেও তারা যে আন্তরিকতা দেখিয়েছিল তা‘ ভুলার নয়।
এদিকে, পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা এবং অগ্নিসংযোগে বাঙালির প্রতিরোধের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে।সারাদেশে শুরু হয়ে যায় প্রতিরোধ যুদ্ধ। আর্মি, ইপিআর এবং পুলিশের বাঙালী সদস্যরাও বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়ে জনতার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশব্যাপী এই প্রতিরোধ যুদ্ধে শামিল হন। জিঞ্জিরায়ও সংঘবদ্ধ হতে থাকলো প্রতিরোধ যোদ্ধারা এবং তারা ঐ সময় ঢাকা শহরে কয়েকটি অপারেশনও চালিয়েছিল। কয়েকদিন জিঞ্জিরায় থাকার পর আমরা নৌপথে মুন্সিগঞ্জ হয়ে নবীনগর গিয়ে পৌঁছলাম। নবীনগর থেকে আমরা চলে গেলাম আমাদের নিজ গ্রাম কসবা থানার রাইতলায়।
গ্রামে গিয়েও দেখলাম যে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য যুব সমাজ প্রস্তুত হয়ে আছে। আমাদের কসবা ও ব্রাম্মণবাড়িয়া তখনও মুক্ত এলাকা। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে হানাদার বাহিনী যাতে আসতে না পারে সেজন্য বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিকরা জনগণের সহায়তায় কুমিল্লা-ব্রাম্মণবাড়িয়া সড়কে প্রতিরোধ সৃষ্টি করে রেখেছে।
এদিকে ঢাকার ছাত্র ইউনিয়নের বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমি ছট্ফট্ করছি। ভাবছি কিভাবে কি করা যায়। কয়েকদিন পর আখাউড়ার নিকটবর্তী গঙ্গাসাগরে মামার বাড়িতে গেলাম। মামার বাড়ী গিয়ে আমার খালাতো ভাই মহিউদ্দিন আহমেদকে পেয়ে গেলাম। দেখলাম, আওয়ামী লীগের সক্রিয় নেতা মামা গোলাম রফিক ইতোমধ্যেই ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে ট্রেনিং এর জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের স্লিপ দিয়ে আগরতলায় পাঠানো শুরু করেছেন। আমি ও মহিউদ্দিন আমাদের দু’জনকেও পাঠিয়ে দেয়ার জন্য মামাকে বললাম। মামা বললেন, পাঠাতে পারি। কিন্তু তার আগে তোমাদের দু‘জনকেই যার যার মায়ের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আসতে হবে। আমরা দু‘জনই যার যার মায়ের কাছে ছুটে এলাম। অনুমতি নিয়ে আবার পরদিন মামার বাড়ি ফিরে গেলাম। তার দু‘একদিন পরই পাক সেনাদের হাতে গঙ্গাসাগরের পতন ঘটলো। আমরা সবাই আগরতলা সীমান্তের কাছাকাছি নানার গ্্রামের বাড়ি টনকীতে চলে গেলাম। তবে সাথে করে নিতে পারলামনা বড় মামা গোলাম সফিককে। মামার বাড়িতে পাক হানাদার বাহনীর লাগানো আগুনে বড়মামা ভস্মীভূ’ত হয়ে মারা গেলেন। পরদিনই আমরা আগরতলায় চলে গেলাম।
মামারা বড় হয়েছেন আগরতলায়। ভারত বিভক্ত হওয়ার আগে নানা আগরতলা রাজবাড়ীর স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। ঐ সময় ত্রিপুরা রাজ্যের রাজ্য সরকারের মূখ্যমন্ত্রী সচিন শিং সহ রাজ্যের কর্তাব্যক্তিরা প্রায় সবাই ছিলেন নানার ছাত্র এবং মামার সুপরিচিত। আগরতলায় পৌঁছে আমরা বটতলায় সিপিএম দলীয় এমপি বীরেন দত্তের ভাই ধীরেন দত্তের বাসায় উঠলাম। আগরতলা থাকাকালে এই বটতলাতেই নানার বাড়ী ছিল।
এদিকে আগরতলায় পৌঁছার পরই আমার প্রচন্ড জর হয়। কিছুতেই জর কমছিলনা। তাই ধীরেন দত্ত এ্যাম্বুলেন্স ডেকে আমাকে আগরতলা জি বি হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলেন। প্রচন্ড জরে কাতর হলেও হাসপাতালের চিকিৎসক এবং সেবিকাদের কাছ থেকে যে সেবা যতœ পেয়েছি, তা ভুলার নয়। আমার খাবারের ডায়েট ছিল পাউরুটি এবং দুধ। কিন্তু ওয়ার্ডের মেট্রন স্টিারদের বলতো, “জয়বাংলাকে“ দুধ-রুটির সাথে ভাত-মাংশ ও দিবি।
এদিকে মহিউদ্দিন আগরতলায় তার দলবল পেয়ে আমাকে না জানিয়েই চলে গেল বিএলএফ-এর ট্রেনিং নেয়ার জন্য। ছাত্রলীগের কর্মীদের জন্য দেরাদুনে এই বিশেষ ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। হাসপাতালে থাকাকালেই একদিন দেখি আমার বেডের পাশে আমার বড় বোন হাউ-মাউ করে কাঁদছে। বড় আপা জাহান আরা রউফ ছিলেন চারুকলা কলেজের সহকারী গ্রন্থাগারিক। দুলাভাই আব্দুর রউফ কর্মরত ছিলেন এ জি অফিসে। অসহযোগ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর বড় আপারা গ্রামের বাড়ী চলে গিয়েছিলেন। হানাদার বাহিনীর হাতে ব্রাম্মণবাড়িয়ার পতন ঘটার পর বড় আপারা আগরতলায় চলে গিয়েছিলেন। আমাদের সাথে কোন যোগাযোগ ছিলনা। তাই আমাকে পেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিলেন। বড় আপা জানালো যে, তারা আগরতলার ক্র্যাফ্ট হোস্টেল ক্যাম্পে ঠাঁই পেয়েছেন, আরও জানালেন যে এই ক্যাম্পেইে কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ এবং ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরাও আছেন। তাই হাসপাতাল থেকে ছুটি পেয়ে ক্র্যাফ্ট হোস্টেল গিয়ে উঠলাম। দলীয় কাম্পে গিয়ে কমডেদের পেয়ে ভরসা পেলাম। এই ক্যস্পইে একটি কক্ষে বড় আপারা থাকাতে বাড়তি সুবিধাও ছিল। ক্যাম্পের যৎসামান্য খাবার খেয়ে ক্ষিধে পেলে বড় আপাদের খাবারে ভাগ বসাতাম। কিন্তু ট্রেনিং বা অস্ত্রপ্রাপ্তির কোন বন্দোবস্ত তখনও হয়নি জেনে হতাশ হলাম।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির কংগ্রেস সরকার আমাদের মতো বামপন্থীদের আশ্রয় দিলেও ট্রেনিং ও অস্ত্র দিতে অনীহা প্রকাশ করছিল। শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন আদায় করার জন্য এবং একই সাথে সিপিআই (সর্ব ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি) এর নেতাদের দেন-দরবারের ফলে ইন্দিরা গান্ধির সরকার আমাদের ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করলো। আমাদের ক্যাম্পগুলোতে আমার মতো অনেকেই ট্রেনিং এর জন্য ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করছিল। কিন্তু খুবই সীমিত সুযোগ থাকায় অনেকের পক্ষেই দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেও ট্রেনিং এ যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না।
ট্রেনিং-এর দীর্ঘ অপেক্ষার কথা বিবেচনা নেতাদের, বিশেষ করে প্রয়াত সাইফ উদ্দিন মানিকের পরামর্শে কিছুদিনের জন্য গ্রামের বাড়ী চলে এলাম। গ্রামে এসে দেখি, পাকিস্তানী দস্যুদের হামলার আশংকায় আমার চাচা আর দাদী ছাড়া সবাই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। আম্মারা চলে গেছেন কয়েক মাইল দূরে কালসার গ্রামে ফুফুর বাড়িতে। আমিও ফুফুর বাড়িতে চলে গেলাম। কিছুদিন পরে পাশ্ববর্তী মেহেরী গ্রামের বাজারে আমার সাথে আকস্মিকভাবে দেখা হয়ে গেল নবীনগরের ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী শওকতের সাথে। শওকত জানালো যে ভৈরবের একটি মুক্তিযোদ্ধা দলের সাথে সে আগরতলা যাচ্ছে। ঐ দলটি যাচ্ছিল গোলা-বারুদ আনার জন্য। আমি মুহুর্তের মধ্যে ওদের সাথে আগরতলা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। শওকতের মাধ্যমে কমা-ারের সাথে দেখা করে আমার আগরতলা যাওয়ার বিষয়টি পাকাপোক্ত করে নিলাম। ভদ্রলোকের নাম যতটুকু মনে পড়ে হান্নান সাহেব। তিনি ভৈরব কলেজের কমার্সের অধ্যাপক ছিলেন। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই নৌকাযোগে রওয়ানা দেবেন বলে কমা-ার সাহেব জানালেন। আমি আম্মা, ফুফু ও বাড়ীর সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার জন্য চলে এলাম। ফুফু এবং ভাবী (ফুফাতো ভাই প্রয়াত হেফজুল বারীর স্ত্রী) আমাকে নিবৃত করার জন্য চেষ্টা চালালেন। ভাবী কাপড়ের থলের ব্যাগ থেকে আমার কাপড়-চোপড় বের করে বিলম্ব ঘটাচ্ছিলেন। আম্মা ওদদেরকে ব্যর্থ চেষ্টা না কারার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্ত এবার ফুফু বললেন. একটু দুধ ভাত খেয়ে যেতে হবে, দুধভাত খেয়ে গেলে তোর কোন বালা মুসিবত হবেনা। ফুফুর হাতে মাখানো দুধ ভাত খেয়ে দ্রুত খালের পাশে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকাটির জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। পড়ন্ত বেলায় মেঘলা দিনে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। সেখানে এক যুবক জাল দিয়ে মাছ ধরছিল। আমি তাকে আমার অপেক্ষার কারণ বলার পর সে জানালো যে মনে হয় একটা ‘মুক্তির‘ নৌকা চলে গেছে, দুই মাঝি নৌকাটি চালাচ্ছিল। তখন আমার মাথায় বাজ পড়লো। এবার বাড়ি ফিরে গেলে আমার আর আগরতলায় যাওয়াই হবেনা। যেভাবেই হোক, আমাকে আগরতলায় যেতে হবে। কমান্ডার আমাকে বলেছিলেন যে তারা আমাদের গ্রামের পার্শ্ববর্তী নিমবাড়ী গ্রামের স্থানীয় এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সূদন মিয়ার মাধ্যমে আগরতলায় যাবেন। খালের পাড়ে অসহায়ের মত কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আমি আমার কর্তব্য স্থির করে ফেললাম। সরাসরি সূদনের বাড়িতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। তখন সন্ধ্যা হয় হয় অবস্থা, ফুফুর গ্রাম থেকে কিছুদূর হেঁটে হাঁটু পানি এবং কোমড় পানি ভেংগে চারগাছ বাজারের কাছে জাঙ্গাইলের সড়ক নামে একটি উঁচু রাস্তায় গিয়ে উঠলাম। ঐ রাস্তা থেকে আমাদের গ্রামটি আধ মাইল দূরে আর সূদন মিয়ার নীমবাড়ী গ্রামটি আমাদের পাশের গ্রাম শ্যামবাড়ীর লাগোয়া গ্রাম। আমাদের এলাকার গ্রামগুলো নীচু এলাকায় অবস্থিত। চারদিকে পানি থৈ থৈ করছে। নৌকা ছাড়া যাওয়ার কোন উপায় নেই। বেশ দূরে একজন নৌকা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তাঁকে ডেকে আমার চাচার পরিচয় দিয়ে অনুরোধ করলাম আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার জন্য। ঐ ভদ্রলোক দয়া করে আমাকে আমাদের বাড়িতে পৌঁছে দিলেন। চাচা ও দাদীর সাথে দু‘একটি কথা বলে আমি আমাদের পাশের বাড়ির এক ভাতিজাকে নিয়ে নৌকা করে সূদনের বাড়ির দিকে ছুটলাম। আমাদের নৌকাটি সূদনের বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছতেই মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা থেকে টর্চ জ্বালিয়ে হল্ট-হল্ট বলে একজন হুংকার দিয়ে উঠলো। আমি আমার পরিচয় দেয়ার পর কমা-ার সাহেবত‘ অবাক। বললেন, আমিত‘ মনে করেছিলাম তুমি বোধহয় আমাদের সাথে যাবেনা।
একটু পরে উঠানে এসে ঐ সূদন বললেন, ‘আইজ রাইতে ক্লিয়ারেন্স নেই, যাওন যাইবনা, আপনাদেরকে অন্য কোন জায়গায় থাকতে হইব, কাইল ক্লিয়ারেন্স পাইলে পার কইরা দিমু।‘ অর্থাৎ পাক বাহিনীর যে কমান্ডার কালভার্টের পাহারার দায়িত্বে রয়েছে তার সাথে সুদনের বোঝাপড়া হয়নি। রাতের বেলায় ২০-২২ জনের এই দলবল নিয়ে কোথায় গিয়ে উঠবেন তা‘ নিয়ে কমান্ডার চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়লে আমি তাকে বললাম, আমাদের বাড়িতে চলুন, কোন সমস্যা হবেনা। আমার চাচা ডাক্তার ময়না মিয়া এই এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা এবং মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক। আপনারা গেলে বরং চাচা খুশীই হবেন। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামাল ঢাকার বন্দীদশা থেকে পালিয়ে ফিরোজ মিয়ার সাথে আমাদের গ্রামের বাড়ি এসে উঠেছিলেন। কয়েকদিন আমাদের বাড়ী থাকার পর শেখ জামালের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে চাচা নিজেই তাকে আগরতলা নিয়ে গিয়েছিলেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের দলটিকে নিয়ে বাড়ী যাওয়ার পর চাচা তড়িঘড়ি করে রাতের খাওয়ার আয়োজন করলেন। দাদী রান্না করে মুক্তিযোদ্ধাাদের খাওয়ালেন। আমাদের বাড়িতে তিন দিন থাকার পর ক্লিয়ারেন্স পাওয়া গেল এবং রাজাকার কর্তৃক পাহারারত কালভার্টের নীচ দিয়ে পার হয়ে আমরা নিরাপদে আগরতলায় গিয়ে পৌঁছলাম।
কিছুদিন অপেক্ষা করার পর ট্রেনিং-এ যাওয়ার সুযোগও এসে গেল। আমাদের ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা হয়েছিল আসামের তেজপুরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি বেইজে। ট্রেনিং ক্যাম্পে আমাদের ব্যাচে আমরা মোট চারশ‘ জন ছিলাম। আমাদের দলনেতা ছিলেন প্রয়াত ইঞ্জিনিয়ার মর্তুজা খান। আমাদের চেয়ে বয়স অনেক বেশী ছিল। ট্রেনিংয়ের প্রথম দিনের একটি ঘটনা আজও আমার মনে পড়ে। প্রথমেই আমাদেরকে দৌড় দিয়ে একটি বিশাল মাঠ চক্কর দিতে বলা হলো। তারপর কমান্ড আসলো লীডারের সাথে পিটি শুরু করার জন্য। কিন্তু ততক্ষণে মর্তুজা ভাইয়ের দম ফুরিয়ে এসেছে, কমান্ডের সাথে সাথেই তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। তাকে অবশ্য ঐদিনের জন্য ছুটি দিয়ে দেয়া হয়েছিলো। আমরা থাকতাম সারি সারি ব্যারাকের মধ্যে। রাতের বেলায় চলতো গল্প-গুজব। আমার পাশের বেডেই ছিল গোপাল সাহা নামে কুলিয়ার চরের ছাত্র ইউনিয়নের এক কর্মী। গোপাল তার প্রেমিকাকে দেশে ফেলে এসেছিলো। প্রতিরাতেই গোপাল তার প্রেমিকার স্মরনে একটি স্বরচিত গান গাইতো আর অঝোরে কাঁদতো। তার গানের একটি চরণ ছিল, ‘হায়রে সাধের সাধনা, তুমি রইলা কোলকাতায় আর আমি আছি আগরতলায়।‘
ট্রেনিং ক্যাম্পে আর একটি মজার ঘটনা মনে পড়ছে। জয়দেবপুরের ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী মানব কুমার গোস্বামী মানিক মহা বিপাকে পড়েছিল থ্রি নট থ্রি রাইফেলের গুলি ছোঁড়ার প্র্যাকটিস করতে গিয়ে। এক চোখ বন্ধ করে নিশানা তাক করতে হয়। কিন্তু মানিক এক চোখ বন্ধ করতে পারতোনা। এক চোখ বন্ধ করতে গেলে তার দু‘চোখই বন্ধ হয়ে যেতো। ভারতীয় আর্মির ইন্সট্রাক্টর ধমক দিয়ে হিন্দিতে বলতো, ‘তুম কিয়া মরদ হায়, লারকিকো কাভি আঁখ নেই মারা।‘
ট্রেনিং ক্যাম্পের আর একটি ঘটনার কথা মনে পড়লে গা এখনও শিউরে উঠে। ক্যাম্পের পাশে বয়ে যাওয়া একটি সরু নদীতে আমাদের গোসল করতে হতো। ঐ নদীর পানিতে ছিল বড় বড় জোঁক। আমরা লাফ দিয়ে জোঁকে গিজগিজ করা পানিতে নেমে কোন রকমে একটা ডুব দিয়ে উঠে আসতাম।
ছোট অস্ত্রের ট্রেনিং শেষ হওয়ার পর এলএমজি, মর্টার ইত্যাদির প্র্যাাকটিক্যাল ট্রেনিং-এর জন্য আমাদেরকে ক্যাম্পের বাইরে নিয়ে যাওয়া হতো। বাইরেই দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা হতো। কিন্তু পিপাসা মেটানোর মতো প্রযোজনীয় পানি জুটতোনা। খাবারের আগে হাত ধোয়ারত‘ প্রশ্নই উঠেনা। আমরা গাছ থেকে বড় বড় টসটসা পাকা আমলকি পেরে পানির বিকল্প হিসেবে চালিয়ে দিতাম। এই হাত না ধুয়ে খাওয়ার অভ্যেসটি আমার দীর্ঘদিন রয়ে গিয়েছিল।
ট্রেনিং পেতে আমাদের যেমন বিলম্ব হয়েছিল তেমনি ট্রেনিং -এর পর অস্ত্র নিয়ে দেশে ঢুকতে গিয়েও সমস্যায় পড়েছিলাম। ঐ সময় মুক্তিযোদ্ধারা প্রবেশ করতে গিয়ে অকাতরে প্রাণ দিচ্ছিল। দেশে প্রবেশ করতে গিয়ে চৌদ্দগ্রামের বেতিয়ারায ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন এবং কমিউনিস্ট পার্টির বিষেষ গেরিলা বাহিনীর একদল কমরেড পাকিস্তানী সৈন্যদের এ্যম্বুসে পড়ে প্রাণ হারালো। অবশেষে আমরা দেশে প্রবেশ করতে সক্ষম হলাম। আমরা নৌকা করে ধীরে ধীরে ঢাকামুখী এগুতে লাগলাম। তখন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছে। স্পষ্টতঃ বোঝা যাচ্ছিল যে. হো চি মিনের ভিয়েৎনামের মডেলে দীর্ঘমেয়াদী গেরিলা যুদ্ধ করার যে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিলাম, সেই সুযোগ আর থাকছেনা। আমরা ধীরে ধীরে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়লাম। আমাদের গ্রুপের অবস্থান ছিল মুন্সিগঞ্জে। আমাদের স্কোয়াড লীডার ছিলেন মাহবুব জামান। মাহবুব ভাই স্বাধীনতার পর অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের (ঢাকসু) নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। মুন্সিগঞ্জে যখন আমরা অবস্থান করছিলাম তখন দখলদার পাকিস্তানী জেনারেল নিয়াজীকে আত্মসমর্পন করার জন্য প্রতি ভারতীয় জেনারেল মানিক শাহ-এর ফরমান বার বার বেতারে প্রচারিত হতে লাগলো। ১৬ই ডিসেম্বর নিয়াজী দলবল নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পন করার পর বাংলাদেশ হানাদার মুক্ত হলো।
আমরা মুক্তিযোদ্ধারা মুন্সিগঞ্জবাসীদের সাথে নিয়ে বিজয় উৎসব করলাম। পরদিন ভোরেই আমরা নারায়নগঞ্জ হয়ে একটি পিকআপে করে ঢাকায় চলে এলাম। ঢাকায় এসে আমরা নামলাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে। শহীদ মিনারের করুণ পরিণতি দেখে আমরা রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়লাম। পাকিস্তানী স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অনুপ্রেরণার উৎস কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। তাদের আক্রোশ ছিল এই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এবং একই সাথে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের বটতলার বটগাছটির ওপর। আইয়ুব-ইয়াহিয়া বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র ছিল এই বটতলা। তাই পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী শহীদ মিনার গুঁড়িয়ে দিয়েছিল এবং বটতলার বটগাছটি উপড়িয়ে ফেলে দিয়েছিল। ১৭ই ডিসেম্বর মিনারবিহীন বিধ্বস্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে রাইফেল উঁচিয়ে বিজয় উল্লাস করেছিলাম, দেশ গড়ার শপথ নিয়েছিলাম। দীর্ঘমেয়াদী গেরিলা যুদ্ধ করে দেশমাতৃকাকে জঞ্জালমুক্ত করতে না পারার অতৃপ্তি থেকে গেলেও শত্রুমুক্ত স্বাধীন দেশে নিঃশ্বাস নিতে পারায় আমাদের আনন্দের সীমা ছিলনা। শহীদ মিনারের পাদদেশে প্রয়াত প্রেস ফটোগ্রাফার রশীদ তালুকদারের তোলা একটি গ্রুপ ছবিটি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত একটি স্মারক নোটে ব্যবহার করা হয়। ৪০তম বিজয় দিবসে প্রকাশিত ৪০ টাকার এই স্মারক নোটের একপাশে জাতির জনকের ছবি এবং অন্যদিকে আমাদের গ্রুপ ছবিটি ব্যাবহার করা হয়।
এদিকে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সময় লেখা-পড়ার পাঠ চুকিয়ে গিয়েছিলাম। কখনও ভাবিনি যে, আবার ক্যাম্পাসে ফিরে যেতে হবে, আবার পড়পশুনা করতে হবে। কিন্ত অগত্যা ফিরে গেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে পড়াশোনার চেয়ে ছাত্র রাজনীতিই বেশী প্রাধাণ্য পেয়েছিল। মুহসীন হল ছাত্র সংসদে এ জি এস নির্বাচিত হওয়ায় হল সংসদেরে কাজ নিয়েও ব্যসাত থাকতে হতো। তবে শেষ পর্যন্ত সমাজবিজ্ঞান বিভাগে অনার্স এবং মাস্টার্স ডিগ্রী নিয়ে বের হলাম।
লেখক পরিচিতঃ ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন এবং কমিউনিস্ট পার্টির বিশেষ গেরিলা বাহিনীর সদস্য মুক্তিযোদ্ধা আবু মুসা হাসান বর্তমানে লন্ডনের সত্যবাণী অনলাইন নিউজ পোর্টালের উপদেষ্টা সম্পাদক। ইতোপূর্বে তিনি বাংলাদেশে থাকাকালে দৈনিক সংবাদ এর ষ্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক পূর্বকোনের ঢাকা ব্যুরো চীফ এবং ইংরেজী দৈনিক ইন্ডিপেন্ডেন্ট এর স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
লন্ডন, ১৬ ডিসেম্বর’ ২০২০
(আবু মুসা হাসান: মুক্তিযোদ্ধা, সিনিয়র সাংবাদিক। সত্যবাণীর উপদেষ্টা সম্পাদক)