পশ্চিমবঙ্গের চিঠি: লক্ষ্মীর সংসারে নতুন বিপদ
দিলীপ মজুমদার
কলকাতার বউবাজারের মলঙ্গা লেনে থাকেন লক্ষ্মীদেবী। নাম লক্ষ্মী হলে কী হবে, তাঁর সংসারে লক্ষ্মীশ্রী একটুও নেই। থাকবে কী করে! স্বামী সরকারি বাসে চাকরি করতেন। হঠাৎ মারা গেলেন। সেই সূত্রে পেনশন পান লক্ষ্মী। মাত্র দু হাজার টাকা। অথচ পরিবারের সদস্যসংখ্যা আট। দুটি ছেলে ভ্যান চালিয়ে সামান্য কিছু আয় করে। লক্ষ্মীদেবী সংসার চালাবার জন্য ঠিকা শ্রমিকের কাজ করেন মাঝে মাঝে।
একদিন তাঁর এক প্রতিবেশী বেশ ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, ‘তোরা যে প্রধানমন্ত্রীর আবাস যোজনায় ঘর পেয়েছিস, আমাদের জানাস নি তো!’
লক্ষ্মী সে কথা শুনে অবাক। ঘর পেয়েছেন তিনি! কোথায় সে ঘর! যে ঘরে তিনি থাকেন সেটা ছয় বাই আট ফুটের এক চিলতে ঘর। সে ঘরে কুলায় না সবাইকে। তাই পুরুষ মানুষরা রাতে ফুটপাতে ঘুমোয়।
লক্ষ্মীদেবীর কথা শুনে প্রতিবেশী অবাক হন। কিন্তু তিনি যে নিজের চোখে বিজ্ঞাপন দেখেছেন। প্রধানমন্ত্রীর পাশে লক্ষ্মীর ছবি। খবরের কাগজে। রাস্তার হোর্ডিংয়েও সেই ছবি। প্রধানমন্ত্রীর পাশে হাভাতে লক্ষ্মীর ছবি। চাড্ডিখানি কথা!
কিন্তু কী করে এসব হল! লক্ষ্মী ভাবতে থাকেন। ভাবতে ভাবতে তাঁর মনে পড়ল সেদিনকার কথা। গঙ্গাসাগর মেলার কিছুদিন আগে বাবুঘাটে ঠিকা শ্রমিকের কাজ করতে গিয়েছিলেন। সেখানেই কয়েকজন তাঁর ছবি তুলেছিল। পরে সেই ছবিতে প্রধানমন্ত্রীর ছবি সেঁটে বিজ্ঞাপন করেছে। প্রবঞ্চিত ভাগ্যবান করে দিয়েছে মলঙ্গা লেনের হাড়হাভাতে লক্ষ্মীদেবীকে।
তাঁর এক প্রতিবেশীর রগচটা ছেলে বলল, ‘মাসি, ভোট আসছে না, তাই এসব ঢপের চপ দিয়ে মন ভোলাতে চাইছে, বুঝলে না!’
এরকম আকাট মিথ্যের জন্য সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করা যায়। কিন্তু লক্ষ্মীদেবীর পক্ষে মামলা করার বুদ্ধি ও রসদ নেই। দেশে লক্ষ্মীদেবীর মতো মানুষের সংখ্যা বিপুল। তাদের ঢপের চপ বিতরণ করে দলীয় রাজনীতি নিজের নিজের রাস্তা সাফ করে নেয়। বহুকাল ধরে চলে আসছে। গরিব-গুর্বোর মাথায় হাত বুলিয়ে ভোট বৈতরণী পার হবার চেষ্টা ভোটবাবুদের। ভোটের আগে বড় উদার হয়ে যান তাঁরা, কথার খই ফুটতে থাকে মুখে। যুদ্ধ জয়ের জন্য অবলম্বন করেন চাণক্যনীতি। ছল বল আর কৌশল। মিথ্যাকে সত্যি করে তোলেন। হিটলারের জিগরি দোস্ত বলেছিলেন না, বারবার মিথ্যে বলতে বলতে লোকে মিথ্যাকে সত্যি বলে মনে করবে।
লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে এই যে জালিয়াতি হল, তা নিয়ে বিরোধীরা খুব হইচই করছেন। নিশ্চয়ই সেসব কথা প্রধানমন্ত্রীর কানে গেছে। কিন্তু তিনি নীরব মোদি। শক্তিশালী গণতন্ত্রের দেশে প্রধানমন্ত্রীরা কখনও ক্ষমা চান না। তাঁরা যে সত্যের ধ্রুবতারা। আর যে বিরোধীরা এই ছবির ব্যাপারে সরব, তাঁরাও কী সব ধোয়া তুলসীপাতা? তাঁরা কী মিথ্যার বেসাতি করেন না? স্বপ্নের ফেরিয়ালা হয়ে অলীক প্রতিশ্রুতি বিলি করেন না?
লক্ষ্মীদেবীর মতো মানুষেরা সহ্য করে যান নীরবে। রবীন্দ্রনাথ তো নেই, তাই কে বলবে, ‘এইসব মূঢ় ম্লান মুখে দিতে হবে ভাষা !’
লেখক: কলামিষ্ট, ফেলোশীপ প্রাপ্ত গবেষক, সত্যবাণীর কন্ট্রিবিউটিং কলামিষ্ট।