শববাহিনী গঙ্গা
দিলীপ মজুমদার
গুজরাত থেকে একটা কবিতা এল বাংলায়।এল একটা দমকা বাতাস । এল একটা বিদ্রোহের গন্ধ।১৪ লাইনের একটা কবিতার কি শক্তি !এক সামান্য গৃহবধূর লেখা একটা কবিতা গুজরাটের গেরুয়া শিবিরের ঘুম কেড়েছে।অবাক হিন্দুত্ববাদী ঐতিহাসিক বিষ্ণু পাণ্ডে।তিনি জানতেন পঞ্চাশোর্ধ গৃহবধূ পারুল কক্কর কবিতা লেখেন।গাছ,ফুল,প্রেম সে সব কবিতার বিষয় । রাজনীতি নেই তার মধ্যে । তাই তিনি পারুলকে ‘গুজরাতি সাহিত্যের ভবিষ্যৎ’ বলে অভিনন্দিত করেছিলেন ।হল কি পারুলের ! পবিত্র গঙ্গায় করোনাপীড়িত মানুষের শব দেখে পারুলের মাথার গোলমাল দেখা গেল কি ! যোগী রাজ্যে থেকে গঙ্গায় ভেসে আসা মানুষের শব দেখে দেশের বিরোধীরা চিৎকার শুরু করেছে । পারুল তার সঙ্গে গলা মেলাল কেন ? এ কি অঘটন !একটা চোদ্দ লাইনের কবিতা নেট মাধ্যমে প্রকাশ পায় ১১ মে । মাত্র পাঁচ দিনের মধ্যে ইংরেজি, বাংলা, হিন্দি, মরাঠি, পঞ্জাবি ভাষায় অনূদিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে কবিতাটি দেশময় । বাংলায় দু-তিনটি অনুবাদ হয়েছে ।আমরা তার মধ্যে মানস সরকার ও শারদ্বত মান্নার অনুবাদটি আপনাদের শোনাচ্ছি । :
দাও সকলে জয়ধ্বনি, ওড়াও রে তেরঙ্গা ।
মহারাজের রামরাজত্বে শববাহিনী গঙ্গা ।।
উপচে ওঠে শ্মশান-মশান, ফুরিয়ে দিয়ে কাঠ ।
শূন্য করে উঠোন মড়ায় ভরেছে সব ঘাট ।।
নাচছে উদোম মৃত্যুদূতী বাজছে মরণডঙ্কা ।
রাজা তোমার রামরাজ্যে শববাহিনী গঙ্গা ।।
চিতার আগুন গিলছে হাজার, ভাঙছে হাজার ঘর ।
হাজার ভেলায় যায় ভেসে যায় হাজার লখিন্দর ।।
পাড় থেকে তাও রাজা হাঁকে, ‘নেই কোন আশঙ্কা’-
রাজারে তোর রাম রাজত্বে শববাহিনী গঙ্গা ।।
রাজার সাজের ভড়ং, কথার বাহার দেখে লোকে ।
ভাবিস আজও তাক লেগেছে, ঘোর লেগেছে চোখে ।।
আজকে দেশে উঠছে আওয়াজ—‘রাজা রে তুই নাঙ্গা’—
ল্যাংটো রাজার রামরাজ্যে শববাহিনী গঙ্গা ।।
হ্যাঁ, মাথার গোলমাল হয়েছে এক সামান্য গৃহবধূর । করোনা সংক্রমণের তীব্রতা রুখতে না পারার ব্যর্থতা, মানুষের অসহায় মৃত্যু, মৃতকে ন্যূনতম মর্যদা না দিয়ে তার শব কে মাটিতে পুঁতে দেওয়া অথবা গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া সহ্য করতে পারেন নি তিনি ।রবীন্দ্রনাথই তো বলেছেন ‘অত্যাচারে মত্তপারা যদি না হও আত্মহারা’ তাহলে দাম কি মনুষ্যত্বের !গুজরাতি কবির কবিতার ছোঁয়া বাংলা কবিতায় লাগবে কি ?
লেখক: কলামিষ্ট, ফেলোশীপ প্রাপ্ত গবেষক, সত্যবাণীর কন্ট্রিবিউটিং কলামিষ্ট।