ব্যারিস্টার মনোয়ার অবাণিজ্যিক হাসপাতাল করতে চান চট্টগ্রামে
হামিদ মোহাম্মদ
কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট,সত্যবাণী
লন্ডনঃ “বাংলাদেশে কতিপয় এমপি জনগুরুত্বপূর্ণ ‘এমপি’ নামক এ শব্দটিকে এমন কলুষিত করেছেন, যে কারণে এমপি হতে ইচ্ছে করে না।” কথা বলছিলেন ব্রিটেনের সুপরিচিত জনপ্রিয় আইনজীবী ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেন এবং তিনি লন্ডনে একজন সফল প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার। তাঁর চেম্বারে বসে মুখোমুখি সম্প্রতি কথা বলছিলাম। দরাজ অথচ নরম কণ্ঠের মানুষ, কোন প্যাচপাচ নেই, সোজা সাপ্টা কথা বলেন। মুখে হাসি লেগেই থাকে। ফাঁকে ফাঁকে চুটকি কাটেন। অফিসের কর্মরত অধ্বস্তনদের সহকর্মীর মত বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহারে অভ্যস্ত ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেন চট্টগ্রাম নিজ শহরের জলাবদ্ধতা নিরসন, নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসম্মত নগরী গড়ে তোলার স্বপ্নদেখা মানুষ তিনি। এ নিয়ে তার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরাম লাগাতার আন্দোলন করছে। সভা সেমিনার, মানববন্ধনসহ জনগণকে নিয়ে আন্দোলন করছেন। বসবাস করেন লন্ডনে কিন্তু ঘনঘন দেশে গিয়ে উদ্যোগ নিচ্ছেন নানা কর্মসূচী বাস্তবায়নে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের রেলওয়ের শত বছরের ঐতিহ্যবাহী প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত সিআরবি বেহাত হওয়ার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করছেন। সিআরবিকে ধ্বংস করে বেসরকারি উদ্যোগে হাসপাতাল নির্মিত হবার প্রচেষ্টাকে রুখে দাঁড়ানোর সচেষ্ট ব্যক্তিত্ব তিনি। লক্ষাধিক বৃক্ষসমৃদ্ধ, ছায়াসুনিবিড়,পর্যটনপ্রেমিদের প্রিয় সিআরবি আকর্ষণীয় স্থান। এটাকে ধ্বংস করে বেসরকারি হাসপাতাল নির্মাণ বা ঐতিহ্যবাহী স্থানটির বাণিজ্যিক রূপায়ন চট্টগ্রামবাসী কেন দেশবাসী কেউই পছন্দ করেন না।
ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেন এ ধরণের বাণিজ্যিক জনকল্যাণবিরোধী প্রচেষ্টার বিপরীতে বাংলাদেশ সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি নিজ উদ্যোগে চট্টগ্রামে নির্মাণ করে দিতে চান এক হাজার শয্যার আধুনিক হাসাপাতাল। যেটি পূর্ণাঙ্গ একটি হাসাপাতাল নির্মাণ করে তিনি পরিচালনার জন্য সরকারের কাছে হস্তান্তর করে দিবেন। সরকার পরিচালনা করবে। চিকিৎসা বাণিজ্যের বিপরীতে দরিদ্র মানুষের জন্য স্বল্পমূল্যে সুলভ চিকিৎসা প্রাপ্তি নিশ্চিত করার স্বপ্ন দেখছেন তিনি।
কথা বলছিলাম এই ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেনের সাথেই। সম্প্রতি এক বিকেলে তার পূর্ব লন্ডনের ব্যারিস্টারস চেম্বারে বসে। কাজে ব্যস্ত থাকেন সারাদিন। ক্লায়েন্টদের কাজ শেষ না হওয়ার আগে অফিস ছাড়েন না। এতো ব্যস্ততার মাঝে আমাকে স্বাগত জানালেন।
ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেন ২০২০ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে মনোনয়ন চেয়েছিলেন, কিন্তু প্রার্থীতায় চুড়ান্ত হন তার এক সময়ের আন্দোলনের রাজপথের সিনিয়র বন্ধু রেজাউল করিম | তবে, ব্যারিস্টার মনোয়ারের মতো স্থানীয়, জাতীয় এমনকি আন্তর্জাতিকভাবেও স্বনামধন্য ও দীর্ঘ রাজনীতির অভিজ্ঞতাসহ সবদিক থেকেই অত্যন্ত সুযোগ্য একজনকে ওই দায়িত্ব দিলে সেই নেতৃত্বে চট্টগ্রাম হয়তোবা শতবছর দ্রুত এগিয়ে যেত, চট্টগ্রামের মানুষ নিজেদের অনেক সোভাগ্যবান করতে পারতেন, এই ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ |
মনোয়ার হোসেন আশি ও নব্বই দশকে স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, শহর ও বৃহত্তর চট্টগ্রাম ভিত্তিক এবং এই সাথে কেন্দ্রীয় ছাত্র আন্দোলনের নেতা ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সংগ্রামী শীর্ষ নেতা ছিলেন। স্বৈরাচার বিরোধী শিক্ষা ও গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে তিনি দুই বার দীর্ঘদিন বিনাবিচারে কারাগারে আটক ছিলেন, আর গ্রেফতারের জন্য তাঁর বাড়িতে পুলিশ- সেনাদের হামলা হয়েছিল কয়েকডজন বার | কারাগারে তিনি যাদের সাথে আটক ছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন জননেতা এবি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, মোসলেম উদ্দিন এমপি, খোরশেদ আলম সুজন, মোহাম্মদ শাহ আলম এবং আরো বেশ কয়েকজন রাজনীতিক|
বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও শহরে সে সময় স্বৈরাচারী এরশাদের সামরিক সরকারের ছত্রছায়ায় উত্থান ঘটা ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রগতিশীল,মুক্তমনা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনাশী হত্যা, রগকাটার রাজনীতিকে রুখে দেয়ার সাহসী যোদ্ধা ছিলেন।
ব্যারিস্টার মনোয়ার জীবনকে গড়ে তোলার আকাঙ্খা নিয়ে ব্যরিস্টারী পড়তে ব্রিটেন আসেন। তিনি মনে করেছিলেন দেশসেবায় নিয়োজিত হতে হলে প্রকৃত মানবতাবাদী মানুষে হয়ে উঠতে হবে। এই জন্য উচ্চ শিক্ষা লাভ করা জরুরী। তিনি লন্ডনের বিখ্যাত লিংকনস ইন থেকে কৃতিত্বের সাথে বার-এট ল সম্পন্ন করেন। বর্তমানে নিজস্ব চেম্বার প্রতিষ্ঠা করে লন্ডনেই আইন ব্যবসায় নিয়োজিত। বাংলাদেশ থেকে আসা শত শত শিক্ষার্থীর ইমিগ্রেশন সমস্যা সমাধানে কখনো বিনে পয়সায়, কখনো অতি অল্প ফিতে বেশির ভাগ আইনী সহায়তা দিয়ে থাকেন। অনেক এ্যাসাইলাম প্রার্থীকে স্বল্প ফিতে সেবাদানকারি মনোয়ার হোসেন বাঙালি কেন, মূল ধারার আইনপেশায় নিয়োজিতদের কাছে সম্মানিত ব্যক্তিত্ব।
ব্যরিস্টার মনোয়ার হোসেন ‘উড়ে এসে জুড়ে-বসা’ ব্যক্তি হতে চান না। তিনি লন্ডনে পেশাগত কারণে বসবাস করলেও পড়ে থাকেন বাংলাদেশকে নিয়ে। দেশের যে কোন সংকটের খবরে অস্থির হয়ে ওঠেন, ভাল খবরে গর্ববোধে আপ্লুত হন। তিনি চান বাংলাদেশে রাজনীতিতে আরো সক্রিয় ভূমিকা রাখতে, রাজীনীতির মানকে উন্নত করতে ।কিন্তু দেশের রাজনীতির বর্তমান হাল তাকে বিচলিত করে তুলেছে। অনেক ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার নেই, পেশিশক্তির কব্জায় থাকা রাজনীতি কী করে মানুষের কল্যাণসাধন করবে,এই চিন্তা-ই সব সময় তার মাথায় ঠিকমতো তাঁর মূল্যায়ন হলে, যথাযথ সুযোগ থাকলে ব্যারিস্টার মনোয়ার বিলেতের শান্তি -সুখ বিলাসের জীবন বাদ দিয়ে শুধুমাত্র বাংলাদেশকে এবং বাংলাদেশের মানুষের কাছে বাকি জীবন সম্পূর্ণ নিবেদিত করার দৃঢ় ইচ্ছার কথা কয়েকবার বলেছেন তিনি |
মনোয়ার হোসেন যে পর্যায়ের আইনব্যবসায়ী ও সম্মানজনক অবস্থানে, সেই অবস্থান থেকে তিনি মানুষের কাছাকাছি থাকেন বেশি। যে কোন ব্যক্তির সাথে ব্যবহার এমন,তিনি বাধ্য করেন ‘ভাই’ ডাকটি যেন পেশাগত পরিচয়ের উর্ধে থাকে। ‘মনোয়ার ভাই’ সম্বোধনেই তিনি বেশি স্বাছন্দবোধ করেন।
হিউম্যান রাইটস ইন্টারন্যাশনালের সেক্রেটারি জেনারেল ও চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরামের চেয়ারম্যান এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন আন্দোলনের রূপকার যিনি একসময় চট্টগ্রামের সার্বিক ও পরিকল্পিত উন্নয়ন নিয়ে সারাদেশকে আলোড়িত করেছিলেন এবং যার উৎসাহে সিলেট, খুলনা, ময়মনসিংহ ও বরিশালেও গড়ে উঠে সফল বিভাগ গড়ার আন্দোলন| ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেন সবর্দা বাংলাদেশে ও ব্রিটেনে সামাজিক ও জন কল্যাণ মূলক কাজে অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছেন। তিনি ইউকে তথা ইউরোপের অন্যতম বৃহত্তম বাংলাদেশিদের সংগঠন গ্রেটার চট্টগ্রাম এসোসিয়েশন ইউকের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং ব্রিটিশ-বাংলাদেশী ফোরামের কনভেনর | স্যার ফজলে হাসান আবেদ, প্রফেসর আনিসুজ্জামান, ক্রিকেটের আকরাম খাঁন, শায়িখ সিরাজ, আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী সহ ১২ জন বাংলাদেশের কৃতি সন্তানদের একজন হিসেবে ঢাকায় প্রথম “হুজ-হু বাংলাদেশ” এর অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন ব্যারিস্টার মনোয়ার | এছাড়াও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরুনের উপস্থিতিতে সফল আইনজীবী হিসেবে ব্রিটিশ-বাংলাদেশী বিজনেস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন তিনি |
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী প্রথম বিশাল মেজবান ’অনুষ্ঠান আয়োজন লন্ডনে হয় তারই নেতৃত্বে এবং এসবগুলি কয়েক কয়েক সহস্র মানুষের উপস্থিতিতে উৎসবে রূপ নেয়। তখন এ অনুষ্ঠান স্থলকে এক টুকরো বাংলাদেশ মনে হয়।
কাউকে পেলে কাজের ফাঁকে বাংলাদেশ নিয়ে গল্প জুড়ে দেন তিনি। নানা স্মৃতিকাতরতা তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে সব সময়।
আমি মাঝে মাঝে তার অফিসে গেলে তিনিও যেন স্বাদ পান বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলতে। আমি তার কোন সাক্ষাৎকার নিইনি, শুধু বাংলাদেশ নিয়ে আলাপই করছিলাম আর তার অপলক দৃষ্টিতে দেখছিলাম ‘এক খন্ড বাংলাদেশ’।
বিদায় নিয়ে আসছিলাম আর ভাবছিলাম তাঁর মেধাকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যথাযথ ভাবে যুক্ত করতে না-পারাই আমাদেরই ব্যর্থতা। তবুও আশা, যদি ভবিষ্যতে সুযোগ আসে দেশ ও দেশবাসী নতুন চিন্তার ফসল তুলবে তাঁর বিজ্ঞানভিত্তিক মনন থেকে।