হৃদয় মণ্ডল: আর কারও ক্ষেত্রে যেন এমনটা না ঘটে- কারাগার থেকে মুক্তির পর বিবিসিকে বলছেন মুন্সীগঞ্জের বিজ্ঞান শিক্ষক

নিউজ ডেস্ক
সত্যবাণী

মুন্সীগঞ্জ: ধর্ম অবমাননার অভিযোগে একটি মামলায় উনিশ দিন কারাভোগের পর মুন্সীগঞ্জের বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন।রবিবার সকালে মুন্সীগঞ্জের আদালত তাকে জামিন দেয়ার পর বিকাল পৌনে পাঁচটায় তিনি কারাগার থেকে মু্ক্তি পান।কারাগার থেকে মুক্তির পর হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, তিনি নিরাপত্তা চান। তবে শুধু তার বেলায় নয়, বাংলাদেশের আর কোন শিক্ষকের ক্ষেত্রে, কোন সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও যেন এমন ঘটনা না ঘটে।দুই দফা জামিন আবেদন নাকচ করার পর রবিবার দুপুরে সংক্ষিপ্ত শুনানির পর পাঁচ হাজার টাকা মুচলেকায় আদালত জামিন মঞ্জুর করেন। বিকালে জামিনের আদেশ কারাগারে পৌঁছানোর পর তাকে মুক্তি দেয়া হয়।গতকালই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে আটকের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছিল।হৃদয় মণ্ডলের মুক্তির দাবীতে সামাজিক মাধ্যম ছাড়াও ঢাকা ও বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে।বৃহস্পতিবার শিক্ষকদের নেটওয়ার্ক একটি বিবৃতিতে তার মু্ক্তি চেয়ে বলেছিল, হৃদয় মণ্ডলের মতো একজন শিক্ষককে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত করা প্রয়োজন, সেখানে রাষ্ট্র তাকে বন্দী করে রেখেছে।

মুক্তির পর বিবিসি বাংলাকে যা বলছেন হৃদয় মণ্ডল

কারাগার থেকে মুক্তির পর হৃদয় মণ্ডলের সঙ্গে বিবিসি বাংলার টেলিফোনে কথা হয়।তিনি বলছেন, কারাগার থেকে মুক্তির পর তার ভীষণ আনন্দ লাগছে। কারণ তিনি ভয়াবহ হতাশার মধ্যে ছিলেন। তবে একটু ভয়ও লাগছে।”ভয় একটু এখনো লাগছে, কোন সময় আবার কী ঘটে? প্রশাসন আমাকে আশ্বাস দিয়েছে, তারা আমাকে রক্ষা করবে, আমার পাশে সবসময় থাকবে,” তিনি বলছেন।”আমি চাই নিরাপত্তা। যাতে আর এইরকম অঘটন না ঘটে। শুধু আমার বেলায় না, বাংলাদেশের কোন শিক্ষকের বেলায়, সাধারণ মানুষের বেলায়ও যেন এইরকম ঘটনা না ঘটে,” বলছিলেন হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল।কারাগারে প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে থাকার কারণে ডায়াবেটিসের রোগী হৃদয় মণ্ডলের রক্তে চিনির পরিমাণ ১৬ পয়েন্টের বেশি উঠে গেছে। তাই প্রথমেই তিনি চিকিৎসা করাতে চান। এরপর স্কুলের প্রধান শিক্ষক, ব্যবস্থাপনা কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন।এই ঘটনা সম্পর্কে তিনি মনে করেন, ”আমার প্রতিপক্ষ শিক্ষক আছে, স্কুলে হয়তো জড়িত আছে, বাহিরেও যারা টিউশনি করে, আমাকে তাড়াতে পারলে তারা একছত্র প্রাধান্য লাভ করতে পারবে। এটাই হয়তো মূল কারণ।তিনি জানান, সেদিন তিনি স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষার একটি ক্লাসে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াচ্ছিলেন। কিন্তু কয়েকজন ছাত্র বারবার ধর্মের প্রসঙ্গ তুলছিলেন।সেটা গোপনে ভিডিও করে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার পর উত্তেজনা তৈরি হলে ওই শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়।ঐ শিক্ষককে গত ২২শে মার্চ গ্রেপ্তারের পর গত সপ্তাহে স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট আদালত দুই দফায় তার জামিনের আবেদন নাকচ করেছে। অবশেষে রবিবার তাকে জামিন দেয়া হয়।

‘পূর্বপরিকল্পনার ভিত্তিতে’ শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে অভিযোগ

হৃদয় মণ্ডলের ঘটনার পর বাংলাদেশে বিজ্ঞান শিক্ষা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হতে পারে কিনা, জানতে চাওয়া হলে বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ”একজন শিক্ষক বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এবং তথ্যের ভিত্তিতে একটা বিষয়কে ব্যাখ্যা করবেন। সেখানে তাকে এমন একটা প্রশ্নের সম্মুখীন করা হয়েছে, যার সঙ্গে বিজ্ঞান শিক্ষা বা ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে একটা আলোচনা সৃষ্টি করে বিতর্ক করার জন্য এবং পরিস্থিতির শিকার করার জন্য আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে,” তিনি বলছেন।

মহিবুল হাসান চৌধুরী শনিবার বিবিসিকে বলেন, ”তবে একটা বিষয় থাকতে পারে, এটাকে পুঁজি করে, এই বিষয়টাকে সামনে এনে এবং সাংঘর্ষিক একটি পরিস্থিতি তৈরি করে একটা মহল দীর্ঘদিন ধরে চাইছে একটা সাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা করার জন্য এবং ধর্মে ধর্মে এক ধরনের সংঘাত তৈরি করার জন্য। যে রাজনৈতিক শক্তিগুলো বাংলাদেশকে পাকিস্তানে পরিণত করতে চায়, কট্টর একটা সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাদের পক্ষ থেকে এটা একটা অপচেষ্টা। সেটার বিষয়ে আমরা অবগত আছি।’পাকিস্তানে এ ধরণের নানা ঘটনায় সহিংসতা, অপদস্থ করার উল্লেখ করে শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলছেন, ”আমাদের দেশে যাতে এই ধরণের কোন পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়, সেজন্য আমি মনে করি আমাদের পুলিশ প্রশাসন ও বিচার প্রশাসনকে একটা বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে যে, কে কি বললো, কে কি শুনল, সেটার ওপর ভিত্তি করে মামলা গ্রহণ করা, আবার সেটার ওপর ভিত্তি করে জামিন না দেয়া, এগুলো সঠিক বলে আমার কাছে মনে হয় না।’তবে তিনি বলেন, ”এটা যদি একটা উদাহরণ হিসাবে সৃষ্টি হয়ে যায়, তাহলে কিন্তু সমূহ বিপদ অপেক্ষা করছে”।

‘পূর্বপরিকল্পনার ভিত্তিতে’ অভিযোগ

হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল মুন্সীগঞ্জ সদরের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের শিক্ষক।সেই স্কুলের একাধিক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক এবং ছাত্রদের কথাবার্তা গোপনে ভিডিও করে তা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়।সেকারণে তারা ঘটনাটিকে পূর্বপরিকল্পিত বলে মনে করেন।স্কুলটির প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, দশম শ্রেণির ক্লাসে ছাত্র শিক্ষকের প্রশ্ন উত্তরের ঘটনা ঘটে ২০শে মার্চ। কিন্তু তার পরদিন ১০/১২ জন ছাত্র এসে তার কাছে বিজ্ঞান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ করে।

মি. আহমেদ উল্লেখ করেন, ছাত্রদের অভিযোগের ভিত্তিতে তিনি ঐ শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়ার পাশাপাশি সাময়িকভাবে বরখাস্তও করেন। এরপরও ২২শে মার্চ ঐ শিক্ষকের বাড়িতে আক্রমণ করা হয়।বাইশে মার্চ ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে একটি মামলা করা হয় এবং সেদিনই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।এরপর থেকে তাকে আর জামিন দেয়া হয়নি।প্রধান শিক্ষকের বক্তব্যে ঘটনার যে ধারাবাহিকতা এসেছে, তা পর্যালোচনা করেও অনেকে ঘটনাটিকে পূর্বপরিকল্পিত বলে মনে করছেন।মুন্সিগঞ্জের আইনজীবী সমিতিও অভিযোগ করেছে, পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে পরিকল্পনা মাফিক পুরো ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে।এই সমিতির সভাপতি অজয় চক্রবর্তী বলেছেন, আসলে পরিকল্পিতভাবে তাকে (শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল) হয়রানি করার জন্য এই কাজ করা হয়েছে।তিনি মনে করেন, আগের পরিকল্পনা ছাড়া শিক্ষকের বক্তব্য গোপনে ভিডিও করা ছাত্রদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।ধর্ম এবং বিজ্ঞান সম্পর্কে ছাত্ররা শিক্ষকের কাছে যে ধরনের প্রশ্ন করেছে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে আইনজীবী অজয় চক্রবর্তীর।প্রশ্নগুলোও আগের প্রস্তুতি নিয়ে করা হয়েছে। তারা দেখতে চেয়েছে যে প্রশ্নের জবাব ঐ শিক্ষক কীভাবে দেয়। সেখানে বিভিন্নভাবে জবাব নিয়ে সেটা দিয়েই উস্কে দিল আরকি”, বলেন মুন্সীগঞ্জ আইনজীবী সমিতির নেতা।ঘটনার ব্যাপারে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে।তবে অনেকে আবার মনে করেন, ধর্ম এবং বিজ্ঞান নিয়ে ছাত্রদের প্রশ্নের জবাবে ঐ শিক্ষকও কিছু বক্তব্য দিয়েছেন, যা নিয়ে অভিযোগ করা বা প্রশ্ন তোলার সুযোগ হয়েছে।
পুলিশ যা বলেছে

মুন্সিগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার আব্দুল মোমেন বলেন, সব অভিযোগ বা সব প্রশ্নেরই জবাব খুঁজবে তদন্ত কমিটি।”ঘটনার ব্যাপারে মামলা হয়েছে। সে মামলার তদন্তে সব বিষয়ই দেখা হবে।ঘটনা পূর্ব পরিকল্পিত বলে যে সব অভিযোগ উঠেছে, সে ব্যাপারে তদন্ত করা হবে কিনা-এই প্রশ্নে পুলিশ সুপারের বক্তব্য হচ্ছে, বিভিন্ন অভিযোগ বা প্রশ্ন যা উঠেছে, সেগুলো সবই তদন্ত করা হবে।হৃদয় মণ্ডলের স্ত্রী ববিতা হালদার বলেছেন, তাদের নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।”ভয়ের মধ্যে আছি। আমরা বাসার ছাদে উঠলেই আশে পাশে থেকে অনেকে কটূক্তি করে। আমার ছেলেকেও স্কুলে পাঠাচ্ছি না।”তবে পুলিশ শিক্ষকের পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলেছে।

You might also like