আফালে ভাঙছে হাওরপাড়ের ঘর-বাড়িঃ দুর্গতরা আরও বিপাকে

চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী

সিলেট থেকেঃ সুনামগঞ্জের হাওরপাড়ের খেটে খাওয়া মানুষেরা দু’দফা বন্যায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। নিজেদের সব সহায়-সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন তারা। সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওর এলাকায় বৃষ্টি বা দমকা হাওয়ার সাথে সাথে বড় বড় আফালের (প্রচলিত আঞ্চলিক ভাষায় প্রচন্ড ঢেউকে আফাল বলে ডাকা হয়) তা-বে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন বাসিন্দারা। বতর্মানে হাওরপারের চারদিকে বন্যার পানি থাকায় সামান্য বৃষ্টি আর বাতাস পেলেই শুরু হয় আফালের তা-ব। এবারের বন্যায় বড় বড় ঢেউয়ে হাওর অঞ্চলের বাসিন্দাদের ঘরবাড়ি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বন্যার পানি ধীরগতিতে নামায় এই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বেড়ে যাচ্ছে।সুনামগঞ্জের কয়েকটি হাওর এলাকার মানুষজনের সাথে আলাপ করে সাংবাদিক বাপ্পা মৈত্র জানান, বন্যার পর যা কিছু ছিল তাও আফালে নিয়ে যাবে। আফালের কারণে আমাদের ঘরের বেড়া ভেঙে গেছে, চলে যাচ্ছে বসতভিটা আর মাটি। এবারের বন্যায় ধান, ঘরের জিনিসপত্রসহ প্রয়োজনীয় শেষ হয়ে গেছে। আমাদের শেষ সম্বল ভিটেও নিয়ে যাবে আফাল। একেকটা আফাল আসে আর মনে হয় এই বুঝি পুরো ঘর ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। এই ভয়ে রাতে ঘুমাতে পারি না, সারা রাত জেগে থাকি। সেই সাথে রয়েছে সাপের ভয়। এভাবে বন্যার পানি জমে থাকলে শেষ রক্ষা হবে না। ঢেউয়ের কবল থেকে রক্ষা পেতে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানাচ্ছি।

গত কয়েকদিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টি আর বাতাস থাকায় সুনামগঞ্জের শাল্লা, দিরাই, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, জগন্নাথপুর ও মধ্যনগর উপজেলায় বেড়েছে ঢেউয়ের তা-ব। এসব এলাকার মানুষেরা বন্যার পানি বাড়ায় আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছিলেন, তবে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে এসে দেখছেন তাদের ঘরবাড়ি শেষ হয়ে গেছে। তাহিরপুর উপজেলার শনি, মাটিয়ান, মহালিয়া ও টাঙ্গুয়ার হাওরপাড়ের শতাধিক গ্রামের বসতভিটা ও ঘরবাড়ি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।এদিকে, সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হয়েছে। তবে বন্যার পানি ধীরে ধীরে নামায় মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। জেলার উপজেলাগুলোর অনেক এলাকা এখনও পানিবন্দী হয়ে রয়েছে। পানিতে ময়লা-আবর্জনা জমে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়েছে। আর এই পানি গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করায় দেখা দিয়েছে পানিবাহিত রোগ। এছাড়াও পানি নামার পরও ঘরের বেড়া ক্ষতিগ্রস্ত ও মেঝেতে কাদামাটি জমে থাকায় মানুষ সহজে ঘরে ফিরতে পারছে না। থাকছে আশ্রয়কেন্দ্র বা আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে।সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার হবিবপুর ইউপির আনন্দপুর গ্রামের সূর্যকান্ত রায় বলেন, বন্যায় আমার ঘরবাড়ি ও গোলার ধান সব শেষ। এরপর যেটুকু ছিল আফালের ঢেউয়ে এইটুকুও তছনছ করে দিয়ে গেছে। আমি স্কুলে আশ্রয় নিছি।

একই গ্রামের বাবুল মিয়া বলেন, আমার ঘরবাড়ি নষ্ট কইরা দিয়া গেছে সর্বনাশা বন্যায়। আমি এখন নিঃস্ব। উপজেলার রামপুর গ্রামের সুনীল দাস বলেন, বন্যায় তো সব ক্ষতি করছেই, এরমাঝে আফালে সব শেষ কইরা গেছে। কেমনে ঘরবাড়ি ঠিক করমু এই চিন্তায় আমি দিশেহারা। ঘরবাড়ি তইয়া আমি এখন আখড়ায় আশ্রয় নিছি। এখানো আমার বাড়িঘর তলে।হাওর বাঁচাও আন্দোলন উপজেলা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক তরুণ কান্তি দাস বলেন, বন্যা এবং পরবর্তী আফালে উপজেলার শতশত পরিবারের বাড়িঘরের ক্ষতি হয়েছে। তবে কি পরিমাণ ঘরবাড়ি নষ্ট হয়েছে সে পরিসংখ্যান এখনো আমরা করতে পারিনি। আমি নিজেও বাড়ি ছাড়া। এই ক্ষতি অপূরণীয় বলে জানান তিনি।দিরাই উপজেলার করিমপুর ইউনিয়নের শ্রীনারায়ণপুর গ্রামের উদীয়মান বাউল শিল্পী আশিক সরকার সুরে সুরে জানান, ঘরছাড়া করছে, আফাল ভাংছে বসতভিটার মাটি। কিলা চলতাম আর কিলা ঘরখান ঠিকঠাক করমু, এই চিস্তায় আছি। মানুষ খাইয়া বাঁচত পারের না, ইবার বন্যায় সবাইরে মারি লাইছে। তিনি আরও জানান, বাঁশপালা দিয়া বানাই নয়া বাড়ি, আমার এক লক্ষ টেকা দামের একটা লন্ডনী বায়োলিন বেহালা, আর একটা হারমোনিয়াম, আর বিয়ের মালপত্রসহ অনেক ক্ষতি অইছে, আমি অন্য এক বাড়ীর ছাদের উপরে তাবু বাইন্দা থাকরাম, আফালে ঘরের বেড়া একটাও নাই, আর শুধু চালটা আছে, তাও একহাত দাবি গেছে ঘর।উপজেলার পশ্চিম চন্ডিপুর গ্রামের বাসিন্দা আকমল মিয়া বলেন, গত বছর রিন ফিন কইরা ষাইট হাজার টেকাদি ঘর বানাইচলাম, এইবার পাইন্নে সব শেষ কইরা দিছে, খাইমু খিলা আর ঘরটা বানাইমু কিলা।

নারী ফুটবলার তমা দাসের বাড়ি দিরাইয়ের ভাংগাডহর গ্রামে। সে জানায় এমনিতেই বৃষ্টি আসলেই ঘরে পানি পড়তো, এবারের বন্যায় ঘরখানা একেবারে শেষ, ঝুঁকি নিয়ে বাস করতে হচ্ছে। গোবিন্দপুরের খালেদা তাবু বানিয়ে রাস্তায় থাকছেন, আফালে নিয়ে গেছে সব, ঘর পাওয়ার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন খালেদা ও তার দিনমজুর স্বামী তছলিম।
উপজেলার করিমপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান লিটন চন্দ্র দাস ও জগদল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হুমায়ূন রশিদ লাভলু বলেন, ভয়াবহ বন্যায় ও বন্যা পরবর্তী আফালের কারণে বসতভিটা ও ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অনেকের কাঁচা ঘরবাড়ি খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদেরকে পুনর্বাসন করতে হবে।জামালগঞ্জ উপজেলার বেহেলী ইউনিয়নের হাওরের মাঝে পৈন্ডুব গ্রামের বাসিন্দা কল্লোল তালুকদার বলেন, তাদের পরিবারের সদস্য ৭জন। পরিবারের উপার্জনকারী একজন। কোনরকম এক ফসলি জমির উপর নির্ভর করেই চলছে তার সংসার। প্রতি বছরই বর্ষাকালে তার বসতভিটা হাওরের আফালে ক্রমশই ছোট হয়ে আসছে। রাত-দিন আফালের ভয়ে থাকতে হচ্ছে। সপ্তাহখানেক আগে উত্তাল হাওর আমার সব কেড়ে নেয়ার উপক্রম ছিল। রামজীবন পুর গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি গেদু মিয়া বলেন, আমাদের গ্রামটা অনেক বড় ছিল। কিন্তু বন্যা ও ভয়ংকর আফালে ছোট হয়ে আসছে আমাদের গ্রামটি। এভাবে ভাঙতে থাকলে একসময় বিলীন হয়ে যাবে পুরো গ্রাম। মধ্যনগর উপজেলার বংশীকুন্ডা দক্ষিণ ইউনিয়নের সাহাপুর গ্রামের জাহেদ আলী বলেন, বন্যার পানি বাড়ার পর হাওরের ঢেউয়ের আঘাতে আমার ঘর ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছি। বর্তমানে আমরা অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছি।একই ইউনিয়নের নিশিস্তপুর গ্রামের আলমগীর বলেন, আমাদের গ্রামটি টাঙ্গুয়ার হাওর পারে হওয়াতে বন্যাকালীন সময়ে হাওরের ঢেউয়ে আমার বাড়ির সামনের গোশালা ও গোয়ালঘর ভেঙ্গে গেছে। এছাড়া এখনোও আমরা কোনো সরকারি সহযোগিতা পায়নি।চামরদানী ইউনিয়নের দুগনই গ্রামের রাবেয়া খাতুন বলেন, আমার পরিবারে লোকজন ৬ জন। গ্রামবাসীর সহযোগিতায় হাওরের মাঝখানে একটি ঘর বেঁধেছিলাম। হঠাৎ করে বন্যার পানি বেড়ে আমার ঘরে প্রবেশ করে। এরপর টেউয়ের আঘাতে চোখের সামনে আমার ঘরের চাল ও বেড়া ধসে গেছে। এখন পরিবারের লোকজন নিয়ে অন্যজনের ঘরে আশ্রয় নিয়েছি।

তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওরপারের ঠাকুরহাটি গ্রামের বাসিন্দা আবুল হাসনাত বলেন, ঢেউয়ে আমার বসতভিটা ভেঙে গেছে এবং শতাধিক মণ ধান ভেসে গেছে। মাটিয়ান হাওরপারের রতনশ্রী গ্রামের তমিম হোসেন বলেন, ঢেউয়ে ঘর ভেঙেছে, তাই বাড়ি ছেড়ে স্বজনের বাড়িতে আশ্রয়ে আছি।একই উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওরপারের গুলাবাড়ি, মন্দিয়াতা গ্রামের খসরু মিয়া ও আব্দুল হক জানান, বন্যার পানির বাড়ার সাথে সাথে বড় বড় ঢেউয়ে ঘরসহ বসতভিটা ভেঙে গেছে। এখন পরিবার অন্যের বাড়িতে রয়েছে। আমাদের সবকিছু শেষ, কিভাবে বাঁচব আমরা। সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের সরকারি তথ্য অনুযায়ী, জেলার ১১টি উপজেলা ও ৪টি পৌরসভায় ক্ষতিগ্রস্ত বসতঘরের সংখ্যা ৪৫ হাজার ২৮৮টি। এরমধ্যে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে ৪ হাজার ৭৪৭টি। আংশিক ক্ষতি হয়েছে ৪০ হাজার ৫৪১টি।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন গত বুধবার সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো জেলার বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি ও ত্রাণ তৎপরতা সম্পর্কিত এক প্রতিবেদনে এসব উল্লেখ করেছেন। তবে বন্যা পুরোপুরি কমে গেলে চূড়ান্ত ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হবে বলে জানান তিনি। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বন্যায় জেলায় ২৫ হাজার ২০৪টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। ১ হাজার ৬৪২টি গবাদিপশু মারা গেছে। এরমধ্যে গরু ৪২২টি, মহিষ ৩৭টি, ছাগল ৬৬৯টি ও ভেড়া ৫১৪টি। এছাড়া ২৮ হাজার ৮০৫টি মুরগি ও ৯৭ হাজার ৮৩১টি হাঁস মারা গেছে। বন্যায় জেলায় এ পর্যন্ত ৩৮৪ কিলোমিটার সড়ক, ১৫৫টি সেতু-কালভার্টের সংযোগ সড়ক এবং ৪টি সেতু-কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এখনো বিভিন্ন স্থানে পানি আছে। তাই বন্যার পানি পুরোপুরি নেমে যাওয়ার পর চূড়ান্ত ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণ করা হবে। বন্যায় সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ তৎপরতা সম্পর্কে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এ পর্যন্ত জেলায় প্রধানমন্ত্রীর স্বেচ্ছাধীন তহবিল থেকে নগদ ৫৫ লাখ টাকা, ৫০ হাজার ১২ প্যাকেট গুঁড়া দুধ পাওয়া গেছে। এসব নগদ টাকা ও সামগ্রী প্রতিটি উপজেলায় বন্যাদুর্গতদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ পাওয়া ১ হাজার ৩৫৬ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। নগদ টাকা পাওয়া গেছে ১ কোটি ৮০ লাখ ৯৩ হাজার টাকা।প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, এ পর্যন্ত বরাদ্দ পাওয়া ১১ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, সাড়ে ১৪ কেজির খাদ্যসামগ্রীর ২৮ হাজার বস্তা, ১০ লাখ টাকার শিশুখাদ্য এবং আরও ১০ লাখ টাকার গো-খাদ্য বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া বন্যাদুর্গতদের মধ্যে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিআইডব্লিউটি-এর পক্ষ থেকে ৭ হাজার ৫০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। এরবাইরে বেসরকারিভাবে এ পর্যন্ত নগদ ১৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা, ২ লাখ ৬১ হাজার ৯৩৬ প্যাকেট খাবারের পাশাপাশি ২৬ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে।

You might also like