চা শ্রমিকদের আন্দোলনে বিভক্তির সুর
চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী
সিলেট থেকেঃ নিজেদের মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে ঐক্যবদ্ধ যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন চা শ্রমিকরা, তাতে এখন বিভক্তির সুর শোনা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে আস্থা রেখে স্থানীয় নেতারা আন্দোলন থেকে সরে আসতে চাইলেও কেন্দ্রীয় নেতারা এখন বেঁকে বসেছেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতারাই একপর্যায়ে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছিলেন।এদিকে, স্থানীয় চা শ্রমিক নেতাদের অনেকেই এখন আন্দোলন নিয়ে শঙ্কিত। তারা মনে করছেন, আন্দোলন ‘বিপথগামী’ হয়ে যাচ্ছে। ফলে নেতাদের কেউ কেউ থানায় সাধারণ ডায়েরি করারও প্রস্তুতি নিচ্ছেন।শ্রমিকরা জানান, সর্বশেষ ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১২০ টাকা মজুরি পাচ্ছেন তারা। এই মজুরি ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে বৃদ্ধির কথা ছিল। কিন্তু মালিকপক্ষ নানা টালবাহনায় মজুরি চুক্তি বাস্তবায়ন করেননি। শ্রমিকরা এখন দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরি চাইছেন।
অন্যদিকে, চা বাগান মালিকপক্ষ বলছে, চা শ্রমিকরা দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরি দাবি করলেও বর্তমানে একজন শ্রমিক দৈনিক প্রায় ৪০০ টাকা সমপরিমাণ সুবিধা পেয়ে থাকেন। প্রত্যক্ষ সুবিধার মধ্যে দৈনিক নগদ মজুরি ছাড়াও ওভারটাইম, বার্ষিক ছুটি ভাতা, উৎসব ছুটি ভাতা, অসুস্থজনিত ছুটি ভাতা, ভবিষ্যৎ তহবিল ভাতা, কাজে উপস্থিতি ভাতা, ভবিষ্যৎ তহবিলের ওপর প্রশাসনিক ভাতার মাধ্যমে সর্বমোট গড়ে দৈনিক মজুরির প্রায় দ্বিগুণ নগদ অর্থ দেয়া হয়। তাদের দাবি, শ্রমিকদের সামাজিক উন্নয়ন ও নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য দৈনিক ১৭৫ টাকার বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দেয়া হচ্ছে।এরই প্রেক্ষিতে বাগান মালিকরা শ্রমিকদের মজুরি খুব বেশি বাড়াতে নারাজ। তারা মজুরি আরও ১৪ টাকা বাড়াতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু চা শ্রমিকরা তা মানতে চাননি। গত ৩ আগস্ট শ্রমিকদের সংগঠন চা শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে চা সংসদে স্মারকলিপি দিয়ে মজুরি ৩০০ টাকা করার দাবি জানান। এজন্য এক সপ্তাহ সময় বেঁধে দেন তারা। কিন্তু দাবি না মানায় ৮ আগস্ট থেকে ২ ঘন্টা করে কর্মবিরতি শুরু করেন শ্রমিকরা।
এরপর ১১ আগস্ট চা বাগানগুলোর মালিকপক্ষ ও শ্রমিকদের নিয়ে সমঝোতা বৈঠক ডাকে বিভাগীয় শ্রম দফতর। তবে মালিকপক্ষের কেউ সেখানে যাননি। পরে শ্রমিকরা ১৩ আগস্ট থেকে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের ডাক দেন। সেই ধর্মঘটের আজ ৯ম দিন।এরমধ্যে ১৬ আগস্ট মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে শ্রম অধিদফতরের আঞ্চলিক কার্যালয়ে চা শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে শ্রম অধিদফতর কর্তৃপক্ষের দুই দফা বৈঠক হয়। বৈঠকে আগামী ২৩ আগস্ট পর্যন্ত আন্দোলন কর্মসূচি স্থগিত করার আহ্বান জানান শ্রম অধিদফতরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরী। কিন্তু তাতে সায় দেননি শ্রমিক নেতারা।১৭ আগস্ট রাজধানীর বিজয়নগরে শ্রম ভবনে চা শ্রমিক ইউনিয়ন ও বাগান মালিকদের সঙ্গে শ্রম অধিদফতরের কর্মকর্তারা বৈঠক করেন। সে বৈঠকেও মালিকপক্ষ ১৪ টাকা মজুরি বাড়ানোর কথা বলেন। কিন্তু শ্রমিকপক্ষ তাতে রাজি না হওয়ায় বৈঠকে কোনো সুরাহা হয়নি।সর্বশেষ শনিবার মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলস্থ বিভাগীয় শ্রম দফতর অফিসে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে মৌলভীবাজার-৪ আসনের সংসদ সদস্য উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ, শ্রম অধিদফতরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরী, চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে শ্রমিকদের মজুরি ২৫ টাকা বাড়িয়ে ১৪৫ টাকায় উন্নীত করার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল। তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্বাসে সরকারের এই প্রস্তাব শ্রমিকরা মেনে নিয়েছেন।কিন্তু এমন সিদ্ধান্ত পরে বদলে যায়। শনিবার সন্ধ্যার পর নৃপেন পাল বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তকে আমরা সম্মান জানাই। ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়ার পর বিভিন্ন চা-বাগান থেকে পঞ্চায়েত কমিটি ও ভ্যালি কমিটির নেতারা আমাদের ফোন দিয়ে জানান, ১৪৫ টাকা মজুরি মেনে নেবেন না জানিয়ে শ্রমিকেরা বাগানে বাগানে আন্দোলন শুরু করেছেন। শ্রমিকেরা বৈঠকের সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। তাই আমরা শ্রমিকদের কথা চিন্তা করে ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিচ্ছি।এদিকে, শনিবার রাতে সিলেটের জেলা প্রশাসক মজিবুর রহমানের সাথে বৈঠকে বসেন সিলেট ভ্যালির চা শ্রমিক নেতারা। বৈঠকে রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।বৈঠক শেষে বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়ন সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা বলেন, প্রধানমন্ত্র্রী আমাদের দাবিদাওয়া শুনে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানের উদ্যোগ নেবেন।তাই রোববার থেকে শ্রমিকরা যথারীতি কাজে যোগ দেবেন।কিন্তু কেন্দ্রীয় চাপে এই সিদ্ধান্ত থেকেও শেষমেশ সরে আসতে হয় স্থানীয় চা শ্রমিক নেতাদের। কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে আন্দোলন চলবে বলে জানিয়েছেন তারা।রোববার সকালে শ্রমিক নেতা রাজু গোয়ালা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বলেছেন যে, আন্দোলন চলবে, বাগান বন্ধ থাকবে। কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তে আমাকেও সমর্থন দিতে হয়। নতুন সিদ্ধান্তের আলোকে শ্রমিকরা কাজে যোগ দেয়নি।
আন্দোলন নিয়ে বিভক্তির প্রশ্নের নিজের শঙ্কার কথাও গোপন করেননি এই শ্রমিক নেতা, ‘একটা ইয়ে হয়ে গেছে। চা শিল্প নষ্ট হয়ে যাবে….।’ রাজু গোয়ালা বলেন, ‘যে অবস্থা তৈরি হয়েছে, সরকারও পাশে থাকবে না, মিডিয়াও না। পাবলিকও পেটাবে….।এদিকে, আন্দোলন ‘বিপথগামী’ হয়ে যেতে পারে বলে শঙ্কায় রয়েছেন স্থানীয় শ্রমিক নেতারা। আন্দোলন থেকে হতে পারে বিশৃঙ্খলাও। এর প্রেক্ষিতে থানায় সাধারণ ডায়েরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা।রাজু গোয়ালা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি থানায় জিডি করবো। কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হলে এর দায় আমি নেব না।নাম প্রকাশ না করার শর্তে শ্রীমঙ্গলের বালিশিরা ভ্যালির এক শ্রমিক নেতা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী যেখানে আশ্বাস দিয়েছেন, সেখানে আন্দোলন স্থগিত করাটাই ছিল সবচেয়ে উত্তম। কিন্তু আমরা স্থগিত করতে চাইলেও কোনো একটি পক্ষ তা চাইছে না। এখানে বাইরের ইন্ধন ঢুকে গেল কিনা, তা নিয়ে আমরা এখন শঙ্কায় পড়ে গেছি।’