সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শুরুর আগেই ১৩৩১ কোটি টাকা কাটছাঁট
চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী
সিলেট থেকেঃ পরিকল্পনা কমিশনে ‘সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (এসএমইউ) স্থাপন’ সংক্রান্ত প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ২৯৪ কোটি ২১ লাখ টাকা। কিন্তু কমিশন অযৌক্তিক ব্যয় কাটছাঁট করে তা ১৯৬২ কোটি ৯২ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। ফলে প্রকল্পের অবকাঠামো কাজ শুরুর আগে পেপার ওয়ার্কিংয়েই কমলো ১৩৩১ কোটি টাকা। স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের ‘সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (এসএমইউ) স্থাপন’ প্রস্তাবিত প্রকল্পে বিশাল অংকের এ ব্যয় কমানো হয়েছে।পরিকল্পনা কমিশন জানিয়েছে, প্রস্তাবিত প্রকল্পটি সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে (জিওবি) ২১৯০ কোটি ১৬ লাখ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে জানুয়ারি ২০২৩ থেকে ডিসেম্বর ২০২৬ মেয়াদে বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়। প্রকল্পটির ওপর পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগ (আসাঅবি) পর্যালোচনা সভা করে। এ বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) মোসাম্মৎ নাসিমা বেগমের অনুমোদনক্রমে প্রধানকে (আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগ) আহ্বায়ক করে উদ্যোগী বিভাগ, পরিকল্পনা কমিশন, কার্যক্রম বিভাগ, আইএমইডি ও বাস্তবায়নকারী সংস্থার সমন্বয়ে ৭ সদস্যের একটি ব্যয় যুক্তিযুক্তকরণ কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির সভা হয় ২০২৩ সালের ৬ মার্চ। সভায় কতিপয় সিদ্ধান্ত সুপারিশ গৃহীত হয়। এরমধ্যে অন্যতম ছিল প্রকল্পের ব্যয় হ্রাস।
জানা যায়, দেশের চিকিৎসাক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও সেবার মান এবং সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণসহ অবকাঠামো উন্নয়নের লক্ষ্যে আলোচ্য প্রকল্পটি সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে ৩২৯৪ কোটি ২১ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০২১ সালের ২৭ জুন ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আর্থিক ও প্রকল্প বাস্তবায়ন সক্ষমতা এবং বিদ্যমান জনবল বিবেচনায় ২/৩ পর্যায়ে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রথম পর্যায়ে প্রকল্পের কর্মকা- নির্ধারণপূর্বক ডিপিপি পুনঃর্গঠন করে পাঠানোর জন্য পরিকল্পনা কমিশন অনুরোধ করে। ফলে প্রত্যাশী সংস্থা ২১৯০ কোটি ১৬ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে জানুয়ারি ২০২৩ থেকে ডিসেম্বর ২০২৬ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্পটি প্রস্তাব করে।
প্রকল্পের ওপর গত ৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পর্যালোচনা সভায় সংশ্লিষ্ট সদস্যদের উপস্থিতিতে প্রকল্পের প্রায় প্রতিটি খাতের আইটেমভিত্তিক বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২১টি সিদ্ধান্ত সুপারিশ গৃহীত হয়। এরই মধ্যে ব্যয় যুক্তিযুক্তকরণ কমিটির সদস্যরাসহ একটি পরিদর্শন দল গত ২৬ ফেব্রুয়ারি সরেজমিনে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন। অতঃপর গত ৬ মার্চের যুক্তিযুক্তকরণ সভায় পরিদর্শনের আলোকে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সভায় প্রকল্পের অবকাঠামোগত বিষয়ে ৬টি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সুপারিশ গৃহিত হয়। সভায় ২১টি সুপারিশ সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে পরিপত্রের নির্ধারিত ফরমেট অনুসারে প্রকল্পের ব্যয় কমানো হয়।পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) মো. মাহবুবুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা বিভিন্ন ধাপে কমিটি করে প্রকল্পের ব্যয় কমিয়ে যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে এসেছি। প্রতিটি খাত ধরে আমরা ব্যয় কাটছাঁট করেছি।পরিকল্পনা কমিশনকে কেন এতো কোটি টাকা ব্যয় কমাতে হলো, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কেউ ইচ্ছেমতো ব্যয় বরাদ্দ চাইলেই আমরা অনুমোদন দেবো না। এটি দেখার জন্যই তো আমরা। আমাদের কাজই ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে এনে জনগণের সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করা।তবে এক ধাপেই ১৩৩১ কোটি টাকা ব্যয় কমানো প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের সিদ্ধান্তের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের যুগ্ম-সচিব (পরিকল্পনা অধিশাখা) মো. আব্দুস সালাম খান।
স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ জানায়, পরিকল্পনা কমিশনের পর্যালোচনা সভা ছাড়াও ব্যয় যুক্তিযুক্তকরণ কমিটির সভায় প্রকল্পের অবকাঠামোগত উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ব্যয় হ্রাস করার সুপারিশ করা হয়েছে। রাজস্ব ব্যয় ১০২ কোটি ৪৩ লাখ ৩১ হাজার থেকে ৫২ কোটি ৮৭ লাখ ৪২ হাজার টাকা কমিয়ে ৪৯ কোটি ৫৫ লাখ ৮৯ হাজার টাকা করা হয়েছে। মূলধন খাতে ২০৪৪ কোটি টাকা থেকে কমানো হয়েছে ১৬৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা। সার্বিকভাবে, মূল প্রস্তাবিত প্রাক্কলন ব্যয় ২৯৯০ কোটি ১৬ লাখ থেকে ২২৭ কোটি ২৩ লাখ ৯২ হাজার টাকা কমিয়ে ১৯৬২ কোটি ৯২ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে।এছাড়া ১২০০ শয্যাবিশিষ্ট ১৬ তলা হাসপাতাল ভবনের আগের প্রস্তাব অক্ষুন্ন রেখে ভিসি, প্রো-ভিসি ও স্কুলভবনসহ অনেকগুলো ভবন প্রস্তাবিত প্রকল্প থেকে বাদ দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি একাডেমিক ভবন ৮ তলার পরিবর্তে ৪ তলা, হোস্টেল ভবন দু’টির পরিবর্তে একটি (তিনতলা), সাবস্টেশন তিনটির পরিবর্তে দু’টির প্রস্তাব করা হয়েছে।একই সঙ্গে আরও কিছু ভবন বাদ দিয়ে অন্য ভবনগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করা হয়েছে। প্রকল্পটি যথাসময়ে বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্পের বাস্তবায়ন মেয়াদকাল জুলাই ২০২৩ থেকে জুন ২০২৭ পর্যন্ত প্রস্তাব করা হলে সভায় একমত প্রকাশ করা হয়।পর্যালোচনা সভার সুপারিশের আলোকে অনেকগুলো আইটেমের ব্যয় কমানো হলেও টেস্টিং ফি, অভ্যন্তরীণ ভ্রমণ ব্যয়, সম্মানী, বিশেষ ব্যয় (উদ্বোধন/ভিত্তিপ্রস্তর) ও কম্পিউটার অ্যান্ড এক্সেসরিজ মেরামত বাবদ ব্যয় কমানো হয়নি। যদিও স্ট্রাকচারাল ডিজাইন পরামর্শক খাতটি বাদ দেয়া এবং অন্য পরামর্শক খাতে ব্যয় যৌক্তিকভাবে কমানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
প্রকল্পের জন্য ভূমি উন্নয়ন বাবদ ৪৯ কোটি ৬৯ লাখ, লেক উন্নয়নে ৭ কোটি ৭৭ লাখ, স্লুইসগেটে ১ কোটি ৬১ লাখ, ওয়াটার ট্রিটমেন্টে ৬ কোটি ও আনুষঙ্গিক ৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব আইটেমে ব্যয়ের ভিত্তি ও ব্যয় প্রাক্কলনের যৌক্তিকতা নিয়ে সভায় আলোচনা হয়।এ বিষয়ে গণপূর্ত বিভাগের এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, আলোচ্য আইটেমগুলোর মধ্যে লেক উন্নয়ন খাতে ৭ কোটি ৭৭ লাখ টাকার পরিবর্তে ৪ কোটি ৯০ লাখ এবং ওয়াটার ট্রিটমেন্টে ৬ কোটি টাকার পরিবর্তে ২ কোটি ২০ লাখ করা হয়েছে। অন্য আইটমেগুলোয় ব্যয় অপরিবর্তিত রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রকল্প কার্যালয়ের জন্য ৬টি যানবাহন (দু’টি জিপ, দু’টি মাইক্রোবাস, ১টি সিঙ্গেল কেবিন পিকআপ ও ১টি ডাবল কেবিন পিকআপ) বাবদ ৩ কোটি ৫৩ লাখ টাকা প্রাক্কলন করা হয়েছে।এ প্রকল্পে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ পরিপত্রের আলোকে যানবাহন কেনা বন্ধ রয়েছে। জনবল কমিটির সুপারিশে ৩টি পরিবহন সেবা কেনার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন সাফ জানিয়েছে, ৬টি যানবাহনের পরিবর্তে ৩টি যানবাহন সেবা কেনা যেতে পারে। পেট্রোল ওয়েল অ্যান্ড লুব্রিকেন্ট এবং মোটরযান মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ব্যয়ও বাদ দেয়া যেতে পারে।