আজ ন্যাপের ৬৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী
চৌধুরী ফরহাদ
আজ ঐতিহাসিক ২৭ জুলাই, মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী ও ঐতিহ্যবাহী প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠন তথা উপমহাদেশের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অন্যতম প্রাচীন দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) এর ৬৬ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।১৯৫৭ সনের ২৫ ও ২৬ জুলাই দুই দিনব্যাপী পুরানো ঢাকার সদরঘাটের রূপ মহল সিনেমা হলে গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ২৭ জুলাই জন্ম লাভ করে তৎকালীন নিখিল পাকিস্তান ভিত্তিক সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। ন্যাপ গঠনে নেতৃবৃন্দের মধ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে ছিলেন- মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, পীর হাবিবুর রহমান, মহিউদ্দিন আহমেদ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ, সৈয়দ আলতাফ হোসেন, মোহাম্মদ তোয়াহা, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, দেওয়ান মাহবুব আলী, সেলিনা বানু, সৈয়দ আশরাফ হোসেন, আহমেদুল কবির, অধ্যাপক আহসাব উদ্দিন প্রমুখ। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ছিলেন- সীমান্ত গান্ধী খ্যাত খান আবদুল গাফফার খান, ইফতেখার উদ্দিন, জিএম সৈয়দ, মাহমুদুল হক ওসমানী, গাউস বক্স বেজেনজো, মিয়া ইফতেখার উদ্দিন প্রমুখ।
১৯৬৭ সালে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক শিবিরে মতাদর্শগত বিরোধকে কেন্দ্র করে ন্যাপ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে মস্কোপন্থী ন্যাপ (ওয়ালী) ও পিকিংপন্থী ন্যাপ (ভাসানী) দুই ধারায় পৃথক হয়ে যায়। তখন রিকুইজিশন কাউন্সিলের মাধ্যমে সারা পাকিস্তানের ওয়ালী ন্যাপের সভাপতি হন খান আবদুল ওয়ালী খান ও পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি হন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে এই অংশটি মোজাফফর ন্যাপ নামে পরিচিতি লাভ করে।মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সকল অসাম্প্রদায়িক, গনতান্ত্রিক আন্দোলন ও বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণে ন্যাপের নিরবিচ্ছিন্ন অংশগ্রহন এবং নেতৃত্বদানের দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পরিক্রমায় অগণিত নেতাকর্মী জীবন দিয়েছেন, জেল-জুলুম, অত্যাচার সহ্য করেছে। ন্যাপ-ই একমাত্র রাজনৈতিক দল যে দলটি ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ছয় দফা কর্মসূচি ও ছয় দফা ভিত্তিক আন্দোলনে প্রকাশ্যে সমর্থন করেছিল।
১৯৬৮ সালে ন্যাপই সর্বপ্রথম দাবি দিবস ঘোষণার মাধ্যমে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পতনের ডাক দিয়ে রাজপথে নেমে গণ আন্দোলনের সূচনা করেছিল। পরবর্তিতে ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের জোট— ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি (DAC) গঠনে ন্যাপই প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল।
১৯৭১ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকহানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার পরে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করতে তৎকালীন সময়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল ন্যাপের সভাপতি হিসাবে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। তিনি বাঙালী জাতির মুক্তির সংগ্রামের পক্ষে তৎকালীন সুপার পাওয়ার সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া) সহ ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের সমর্থন আদায়ে সচেষ্ঠ হন। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্ঠামন্ডলীর অন্যতম সদস্য হিসেবে তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বিশ্বের সকল রাষ্ট্র প্রধানদের সামনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবভিত্তিক চিত্র ও বাঙালী জাতির দুঃখ-দুর্দশার কথা তুলে ধরে এক সুদীর্ঘ বক্তব্য রাখেন। মহান মুক্তিযুদ্ধকে চূড়ান্ত লক্ষ্যে উপনীত করার প্রয়াসে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের সম্মতিতে ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকর্মী রিক্রুটের মাধ্যমে প্রায় ১৯ হাজার সদস্যের সমন্বয়ে সোভিয়েত ও ভারত সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় “ন্যাপ-কমিউনিষ্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা বাহিনী” নামে একটি স্বতন্ত্র প্রশিক্ষিত সশস্ত্র গেরিলা বাহিনী গড়ে তুলেন। এই গেরিলা বাহিনীর যোদ্ধারা পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে বীরত্বের সাথে বহু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে আত্মবলিদানের মাধ্যমে দেশকে শত্রু মুক্ত করেন।
১৯৮২ সালে উপমহাদেশের একমাত্র রাজনৈতিক দল হিসেবে ন্যাপ নারায়ণগঞ্জের মদনপুরে ‘সামাজিক বিজ্ঞান পরিষদ’ প্রতিষ্ঠা করে এবং ন্যাপ সহ সমমনা প্রগতিশীল দলের নেতাকর্মীদের জন্য সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ চালু করে এবং সমাজতন্ত্রের প্রশিক্ষিত কর্মী তৈরি করে যাচ্ছে।
ন্যাপের ৬৬ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ইতিহাসের কিছুকথা না বললেই নয়। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সামগ্রীকভাবে বাংলাদেশের বামপন্থা রাজনীতি যখন ভাঙ্গা-গড়া মধ্য দিয়ে এবং হতাশাগ্রস্থ ও সুবিধাবাদি দলছুট-দের কারণে একটা দুঃসময়ে পতিত হয় তখন থেকে উপমহাদেশের প্রগতিশীল রাজনীতির অন্যতম দিকপাল মহান নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ তাঁর আদর্শিক দর্শন ও তাঁর অবিচল নেতৃত্বের মাধ্যমে ন্যাপকে এগিয়ে নিয়েছেন। অসীম সমুদ্রে অনেক ঝড়-ঝঞ্জার মধ্যে দিয়ে একজন নাবিক যেমনি ভাবে জাহাজকে এগিয়ে নিয়ে যায় অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ঠিক তেমনি ভাবেই নানান ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবেলা করে ন্যাপকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। আজও ন্যাপের নেতা-কর্মীরা প্রয়াত মহান নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের আদর্শকে আঁকড়ে ধরে ন্যাপ পার্টিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
মুক্তিযুদ্ধের পর ন্যাপের সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল— সংবিধানের ৪ (চার) মূলনীতির ১ (এক) নীতি হিসেবে সমাজতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করা। এটা প্রগতিশীলদের মহা বিজয়। বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গভীর ষড়যন্ত্রে এক রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। আন্তর্জাতিক কারণে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য মূল্য প্রতিনিয়তই বেড়ে চলেছে। দেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ তথা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার এক দুর্বিষহ পরিস্থি মোকাবেলা করতে হচ্ছে। অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজি বন্ধ করা ও দ্রব্য মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারকে দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সরকারকে বিদ্যুৎ সংকট ও লোডশেডিং সমস্যা সমাধানে কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট ছেড়ে স্থায়ী প্রতিকারের ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে। ন্যাপ পার্টি বরাবরই দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার লড়াই অব্যাহত রেখেছে, ন্যাপ আগামীতেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার দৃঢ় অবস্থান থেকে ভূমিকা পালন করবে। ন্যাপ সর্বদা দুর্নীতির সাথে জড়িত এবং দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছে সেই ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে বিচারের সম্মুখীন করার দাবি জানিয়েছে। জনগণের ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ে ন্যাপ সকল সরকারের আমলেই সোচ্চার ছিল, বর্তমানেও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। দেশে বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার না হলে এদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। কালো টাকা, পেশী শক্তি আর অরাজনৈতিক পুঁজিপতি ব্যক্তিদের কাছে নির্বাচনী ব্যবস্থা জিম্মি হয়ে পড়েছে। এই নির্বাচনী ব্যবস্থায় একজন সৎ, যোগ্য ও আদর্শিক প্রার্থী জয়লাভ করা সম্ভব নয়।
ন্যাপের মূল লক্ষ্য জনগনের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করা। পাশাপাশি ধর্ম-কর্ম গণতন্ত্রের নিশ্চয়তাসহ সমাজতন্ত্র তথা একটি শোষণ মুক্ত, বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক সমাজ ব্যাবস্থা কায়েম করা তথা বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা। আদর্শের রাজনীতিই সমাধানের পথ; আদর্শের রাজনীতি কঠিন, কষ্টকর ও ত্যাগের। এই আদর্শ এবং ত্যাগ শোষক শ্রেনীর কবল থেকে দেশ ও জনগণের ভাগ্য বদলের জন্য, মানুষের রুটি-রুজির নিশ্চয়তা দেবার জন্য, সুন্দর জীবনের জন্য। এই ত্যাগে বৈষয়িক প্রাপ্তি না থাকলেও চিত্ত আনন্দে উৎফুল্ল হয়। বুর্জোয়া রাজনীতির গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে সমাধান চাইলে বার বার হতাশা আসবেই। আদর্শের প্রতি অবিচল আস্থা থাকলেই হাসতে হাসতে জীবন উৎসর্গ করা যায়। জীবন উৎসর্গ করা মানুষের সংখ্যা সমাজে কমই থাকে। আদর্শের টানে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রথমে এগিয়ে আসে ছাত্র-যুবক-তরুণরা। তাদের আহ্বাণে সাড়া দিয়ে অগণিত মানুষ যুক্ত হয় সংগ্রামের কাফেলায়। তখনই আমরা নতুন সমাজ ও রাষ্ট্রের আগমণী বার্তা শুনতে পাই। এই আন্দোলনের সাফল্যে পৌছাবার জন্য একটি বিপ্লবী রেডিক্যাল পার্টি ও শ্রেনীভিত্তিক পার্টির যুগপৎ নেতৃত্ব প্রয়োজন। দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ন্যাপের একজন কর্মী হিসেবে আমি আশা করি এদেশের ছাত্র-যুবসহ আপামর জনতা ন্যাপের মূল লক্ষ্যে পৌঁছাতে সহায়তা করবেন।ন্যাপের ৬৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে শ্রদ্ধেয় মহান নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ সহ ন্যাপের যে সমস্ত নেতৃবৃন্দ প্রয়াত হয়েছেন আজ তাঁদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
লেখক: প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী ও হবিগঞ্জ জেলা ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক।