১৯৭১ – প্রসঙ্গঃ শরণার্থী ও অক্সফ্যাম
উদয় শঙ্কর দাশ
বাংলাদেশের বিজয় দিবসের বায়ান্ন বছর পূর্তি আমাদের আবার মনে করিয়ে দেয়, এই বিজয় এসেছে অনেক রক্তের বিনিময়ে, অনেক স্বপ্ন ও জীবনের বিনিময়ে, অনেক আশা ও সাধনার উচ্ছ্বাসে। ন’মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাংলার মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ,খ্রীষ্টান, আদিবাসী তথা ধর্ম, জাতি, শ্রেণী, নির্বিশেষে সমগ্র বাঙালি জাতি। ছিনিয়ে এনেছিল বিজয়। আমরা পেয়েছি আমাদের প্রিয় স্বাধীন মাতৃভূমি – বাংলাদেশ। সেই মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানীদের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য সর্বস্ব ফেলে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিল এক কোটি বাঙালি। শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নিয়েছিল প্রতিবেশী দেশ ভারতে। সেটাও ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক করুণ অধ্যায়।
১৯৭০-এর ডিসেম্বরের নির্বাচনে বাঙালি জাতীয়বাদীনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ-এর বিশাল বিজয় পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীকোনোমতেই মেনে নিতে পারেনি এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে করছিলগড়িমসি। তারপর, মুক্তি ও স্বাধীনতাকামী বাঙালিদেরআন্দোলন দমনে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পঁচিশে মার্চের‘কালো রাতে’ শুরু কোরলো তাদের বাঙালি নিধনঅভিযান ‘অপারেশন সার্চলাইট’ । নিরপরাধ, নিরীহ ও নিরস্ত্র বাঙালির ওপর তারা চালালো এক নৃশংস হত্যাযজ্ঞ (সেই রাতেই তাঁকে গ্রেফতারের আগে, বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা)।
শতশত বাঙালিকে সারিবদ্ধ ক’রে, কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে, ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়ে গুলি ক’রে হত্যা করা ছাড়াও পাকিস্তান সেনাবাহিনীপুড়িয়ে দিয়েছে গ্রামের পর গ্রাম, ধর্ষণ করেছে নারীদের – যার ফলে, নৃশংসতা ও হত্যাযজ্ঞের বেদনাদায়ক স্মৃতি নিয়ে লাখ লাখ লোক তাদের প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্য, বিশেষ ক’রে, পশ্চিম বঙ্গ, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে আশ্র্য নিতে বাধ্য হয়। এদের বেশীর ভাগই ছিল হিন্দু,পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ধারণা, হিন্দুরা ১৯৭০-এর ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের জন্য দায়ী করে হিন্দুদের। তাদের ভোটেই নাকি আওয়ামী লীগ ঐ নির্বাচনে জয়লাভ করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্রোধ থেকে রক্ষা পেতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিমও তখন ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
লাখ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া এবং তাদের সামাল দেওয়া ভারতের জন্য একটা বোঝা হয়ে দাঁড়ালো – অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে। কিন্তু ভারত সরকার এবং সেই দেশের সাধারণ জনগণ শরণার্থীদের সাদরে গ্রহণ করলেন এবং তাদের সাহায্য প্রদানে এগিয়ে এলেন। বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক দাতব্য প্রতিষ্ঠান জনাকীর্ণ অস্থায়ী শিবিরে আশ্রয়গ্রহণকারী শরণার্থীদের দুঃখ- দুর্দশা লাঘবে ত্বড়িতগতিতে ব্যবস্থা নিতে শুরু কোরলো। কিছু সংখ্যক শরণার্থী অবশ্য তাদের বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়ের বাড়ীতে থেকেছিলেন।
আমাদের পরিবারকেও ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ের পথে হেঁটে রামগড়ে পৌঁছে, সাব্রুমে সীমান্ত অতিক্রম ক’রে প্রবেশ করলাম ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে। সাব্রুম থেকে সড়ক পথে আগরতলায়, সেখানে একটি কলেজের হোস্টেলে ছিলাম তিনদিন। এরপর, বাসে ও রেলে মেঘালয় ও আসাম হয়ে চারদিনের আরেক কষ্টসাধ্য যাত্রা শেষে পৌঁছালাম কোলকাতায়। সেখানে, পার্ক সার্কাস এলাকায় বাংলাদেশ মিশনের পেছনে মেহের আলি রোডে একটি ভবনে দু’টো কামরায় থাকতাম আমাদের যৌথ পরিবারের আঠারো জন সদস্য।
তখন কোলকাতাতেই আমি আন্তর্জাতিক দাতব্য প্রতিষ্ঠান অক্সফ্যাম-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। তারা ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী ছয় লাখ শরণার্থীর দেখাশোনা কোরতো, বিশেষ ক’রে পশ্চিম বঙ্গে, সেই সঙ্গে আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরা রাজ্যেও। ঐ সময়, আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলির প্রধান কাজকর্ম পরিচালিত হোতো কোলকাতা থেকেই, ত্রাণ সংস্থাগুলি তাদের দফতর গড়ে তুলেছিল সেই শহরেই। আমার মনে আছে, একদিন কোলকাতায় চৌরঙ্গীতে হঠাৎ আমার স্কুলের সাবেক অধ্যক্ষ ব্রাদার রেমন্ড কোরনোয়ারের সঙ্গে দেখা। তাঁকে সবসময় দেখেছি পাদ্রীর পোষাকে, তাই আমাদের মত সাধারণ পোষাকে প্রথমে তাঁকে চিনতে পারিনি। তিনি আমাকে দেখে খুশী হলেন, আমিও বেশ উচ্ছসিত। কেমইন আচ্ছি, আমার পরিবারের সবাই কেমন আছে জানতে চাইলেন। তারপর আমাকে নিয়ে গেলেন নিউ কেনিলওয়ার্থ হোটেল-এ। সেখান ছিল অক্সফ্যাম-এর শরণার্থী ত্রাণ কর্মসূচী পরিচালনা ও সমন্বয় দফতর।
ব্রাদার রেমন্ড ১৯৬৫ সালে কানাডায় ফিরে যান। এরপর, তিনি কুইবেকে অক্সফ্যামে যোগ দেন এবং ১৯৭১ সালে তাঁকে ভারতের পূর্বাঞ্চল ও পূর্ব পাকিস্তানে অক্সফ্যামের ফিল্ড ডাইরেক্টর নিয়োগ করা হয়। শরণার্থীদের ভারতে আশ্রয় গ্রহণ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ত্রাণ তৎপরতা পরিচালনার জন্য কোলকাতায় একটি প্রশাসনিক দফতর খোলেন। সেই কেনিলওয়ার্থ হোটেলেই আমার পরিচয় হয় আরেক ইংরেজ জুলিয়ান ফ্রান্সিস-এর সঙ্গে, যিনি ছিলেন অক্সফ্যামের ত্রাণ কর্মসূচীর সমন্বয়ক। ব্রাদার রেমন্ড আমাকে তার পরদিন থেকেই কাজ শুরু করতে বললেন।
আমাকে প্রথমে দেওয়া হল পণ্যাগারের দায়িত্ব। ধর্মতলায় ছিল তাদের বিশাল পণ্যাগার যেখানে ত্রাণ সামগ্রী, যেমন কম্বল,বাসন, ঔষধ ও চিকিৎসা সামগ্রী, রাখা হত আর সেখান থেকেই পাঠানো হত অক্সফ্যামের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে। আমার মত যারা দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছে তাদের জন্য কিছু করতে পারছি, এটা ভেবে ভালো লাগছিল, আমাকেও তো তাদের মত শিবিরে থাকতে হতে পারতো।
মাসখানেক পণ্যাগারের এই দ্বায়িত্ব পালনের পর, জুলিয়ান আমাকে একদিন অফিসে ডাকলেন এবং আরও বড় একটি দায়িত্ব। আমার কাজ হবে পশ্চিম বঙ্গ সীমান্তে অক্সফ্যাম-পরিচালিত শরণার্থী শিবিরে গিয়ে সেখানকার কাজ পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ণ, তারপর শিবিরগুলির প্রয়োজনীয়তা এবং করণীয় সম্পর্কে সাপ্তাহিক প্রতিবেদন লিখে জুলিয়ানকে দেওয়া। নিজে একজন শরণার্থী হয়ে ঐ বয়সে ওক্সফ্যামের মত একটি প্রতিষ্ঠানে এরকম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেয়ে বেশ ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল নিজেকে। আমার এই কাজে জুলিয়ান আমাকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিলেন, উৎসাহ দিয়েছিলেন। সপ্তাহে ছ’দিন শিবিরগুলি পরিদর্শনে যেতাম আর সবকিছু লিখে রাখতাম। একদিন অফিসে ব’সে ছ’দিনের কাজ নিয়ে প্রতিবেদন লিখে জুলিয়ানকে দিতাম। তিনি সেগুলি দেখে পাঠিয়ে দিতেন অক্সফোর্ডে অক্সফ্যামের সদর দফতরে। ঐ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এর পরের করণীয় নির্ধারণ করা হত।
আমাকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের সময় এমন কোনো ঘটনা আমার মনে বিশেষভাবে দাগ কেটেছিল কি না। প্রত্যেকটা দিনই ছিল মনে দাগ কাটার মত, যখনই দেখতাম শরণার্থীরা ত্রাণ সামগ্রীর জন্য সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, আমি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়তাম। আমিও তো তাদের মত একজন। ভাবতাম, এদের তো এই করুণ অবস্থায় থাকার কথা নয়। সবচেয়ে বেশী ভেঙে পড়তাম যখন ঐ সারিগুলিতে পরিচিত লোকজনদের দেখতাম। তবে, এটা ভেবেও ভালো লাগতো যে তাদের সামান্য সাহায্যে হলেও কিছুটা করতে পেরেছি এবং তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে অক্সফ্যাম। আমার দেশের মুক্তিযুদ্ধে এটা ছিল আমার অতি সামান্য অবদান।
এই বিশাল ত্রাণ কর্মসূচী ছাড়া, অক্সফ্যাম আর যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ তখন করেছিল সেটা হচ্ছে, ‘দ্য টেস্টিমনি অফ সিক্সটি অন দ্য ক্রাইসিস ইন বেঙ্গল’ নামে একটি দলিল প্রকাশনা। বিশ্ব নেতাদের চোখ খুলে দেওয়ার এবং শরণার্থীদের এই ট্র্যাজেডী সম্পর্কে সচেতন করার লক্ষ্যে বিশ্বের ষাটজন বিশিষ্ট ব্যক্তি তাঁদের কথা লেখেন এই দলিলে। এঁদের মধ্যে ছিলেন মাদার টেরেসা, সেনেটর এডওয়ার্ড কেনেডী, এন্টনী মাসকেরেনহাস, টনি পিলজার,নিকলাস টমালিন এবং মারটিন উলাকটের মত সাংবাদিকবৃন্দ। ১৯৭১ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই সেনেটর এডওয়ার্ড কেনেডী ‘দ্য টেস্টিমনি অফ সিক্সটি ‘- দলিলের প্রতি মার্কিন সেনেটের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং আটাশে অক্টোবর ১৯৭১-এ এই দলিলের পুরোটাই মার্কিন কংগ্রেসের রেকর্ডে প্রকাশিত হয়। এই দলিল প্রকাশে অক্সফ্যাম এবং জুলিয়ানের অবদান অনস্বীকার্য।
ষোলই ডিসেম্বর, ১৯৭১-এ মিত্র বাহিনীর কাছে পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবরে শরণার্থী শিবিরগুলিতে যে উচ্ছ্বাস ও আনন্দের চিত্র দেখেছি তা কোনোদিন ভুলবোনা। শরণার্থীরা যে এখন তাঁদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে পারবেন, এই চিন্তাই ফুটে উঠেছিল তাঁদের চেহারায়। শিবিরের সবখানেই ধ্বনিত হতে লাগলো ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। তাঁরা যে ফিরে যাবেন তাঁদের প্রিয় স্বাধীন বাংলাদেশে।
লাখ লাখ শরণার্থী যখন দেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল, তখন সুশৃঙ্খলভাবে তাদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য অক্সফ্যাম এক বিশাল প্রত্যাবাসন কর্মসূচী গ্রহণ করে। সীমান্তে দেখা দেয় স্বাস্থ্য ও পয়ঃপ্রণালী সমস্যা। হাজার হাজার শরণার্থীকে দিনের পর দিন বনগাঁয় আটকে থাকতে দেখেছি। আমাদের জরুরীভিত্তিতে তাদের জন্য খাদ্য-সামগ্রী, পানীয় জল এবং সেই সঙ্গে পয়ঃপ্রণালীর সুযোগ-সুবিধা করে দিতে হয়েছিল।
এক কোটি মানুষের শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয়গ্রহণ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় যার উল্লেখ আজকাল তেমন শোনা যায় না। এই অধ্যায়ের খুবই ছোট একটি অংশ হতে পেরে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করি, ধন্যবাদ জানাই অক্সফ্যামকে তাদের বিশাল ও প্রশংসনীয় শরণার্থী ত্রাণ কর্মসূচীর জন্য।
লেখকঃ জেষ্ঠ্য সাংবাদিক, বিবিসি বাংলার প্রাক্তণ বেতার সাংবাদিক, রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও ক্রীড়া বিশ্লেষক।