সিলেট অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী চুঙ্গাপুড়াঃ ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে
চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী
সিলেট অফিসঃ
সিলেটের প্রাচীন ঐতিহ্য পিঠে-পুলির অন্যতম চুঙ্গাপুড়া পিঠে ইদানিং বিলুপ্তপ্রায়। আগের মতো এখন আর গ্রামীণ এলাকার বাড়িতে বাড়িতে চুঙ্গাপুড়ার আয়োজন চোখে পড়ে না। শীতের রাতে খড়কুটো জ্বালিয়ে সারারাত চুঙ্গাপুড়ার দৃশ্যও তাই দেখা যায় না।
একটা সময় ছিল বাজারে মাছের মেলাও বসতো। সেই মেলা থেকে মাছ কিনে কিংবা হাওর-নদীর বা কারো বাড়ির পুকুর থেকে বড় বড় রুই, কাতলা, চিতল, আইড়, বোয়াল, পাবদা, কই, মাগুর মাছ ধরে নিয়ে এসে হাল্কা মসলা দিয়ে ভেজে (আঞ্চলিক ভাষায় ‘মাছ বিরান’) চুঙ্গাপুড়া পিঠা খাওয়া ছিল সিলেটের একটি অন্যতম ঐতিহ্য। বাড়িতে মেহমান বা নতুন জামাইকে শেষ পাতে চুঙ্গাপুড়া পিঠা মাছ বিরান আর নারিকেলের পিঠা বা রিসা পরিবেশন না করলে যেন লজ্জায় মাথাকাটা যেত। বর্তমানে সেই দিন আর নেই।
চুঙ্গাপুড়া পিঠা তৈরির প্রধান উপকরণ ঢলু বাঁশ ও বিন্নি ধানের চাল (বিরইন ধানের চাল) সরবরাহও এখন অনেক কমে গেছে। অনেক স্থানে এখন আর আগের মতো বিরইন ধানের চাষাবাদও হয় না। এছাড়া, মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার পাথারিয়া পাহাড়, জুড়ী উপজেলার লাঠিটিলা ও চুঙ্গাবাড়ি, রাজনগরসহ বিভিন্ন উপজেলার টিলায় টিলায় ও চা-বাগানের টিলায়, কুলাউড়ার গাজীপুরের পাহাড়ে প্রচুর ঢলুবাঁশ পাওয়া যেতো। তন্মধ্যে চুঙ্গাবাড়ি একসময় প্রসিদ্ধ ছিলো ঢলুবাঁশের জন্যে। আর মৌলভীবাজারের বিভিন্ন উপজেলায় চুঙ্গাপুড়া পিঠা তৈরির প্রধান উপকরণ ঢলু বাঁশের অধিক উৎপাদনের কারণে মৌলভীবাজার জেলার প্রতিটি উপজেলা এবং সিলেট জেলার জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার এবং গোলাপগঞ্জ উপজেলার পূর্বাংশে এ চুঙ্গাপুড়ার প্রচলন ছিল বেশী। এসব উপজেলার আত্মীয়-স্বজনদের নিকট থেকেই সিলেট শহর বা অন্যান্য উপজেলার স্বজনরা চুঙ্গাপুড়া পিঠের স্বাদ উপভোগ করতেন।
কমলগঞ্জ উপজেলার পাহাড়ি এলাকায় প্রচুর ঢলুবাঁশ পাওয়া যেতো। কিন্তু অনেক আগেই বনদস্যু ও ভুমিদস্যু এবং পাহাড়খেকোদের কারণে বনাঞ্চল উজাড় হয়ে যাওয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে ঢলুবাঁশ। তবে আশার কথা হচ্ছে, টিলা অধ্যুষিত মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন উপজেলায় এখনও অল্প কিছু ঢলুবাঁশ পাওয়া যায়।
এদিকে, পাহাড়ে বাঁশ নাই বলে বাজারে ঢলুবাঁশের দামও এখন তাই বেশ চড়া। ব্যবসায়ীরা দূরবর্তী এলাকা থেকে ঢলুবাঁশ সংগ্রহ করে নিয়ে যান নিজ নিজ উপজেলার বাজারসমূহে বিক্রির আশায়।
ঢলুবাঁশ ছাড়া চুঙ্গাপিঠা তৈরি করা যায় না, কারণ ঢলুবাঁশে এক ধরণের তৈলাক্ত রাসায়নিক পদার্থ আছে, যা আগুনে বাঁশের চুঙ্গাকে না পোড়াতে সাহায্য করে। ঢলুবাঁশে অত্যধিক রস থাকায় আগুনে না পুড়ে ভিতরের পিঠা আগুনের তাপে সিদ্ধ হয়। ঢলুবাঁশের চুঙ্গা দিয়ে ভিন্ন স্বাদের পিঠা তৈরি করা করা হয়ে থাকে। কোনো কোনো জায়গায় চুঙ্গার ভেতরে বিন্নি চাল, দুধ, চিনি, নারিকেল ও চালের গুড়া দিয়ে পিঠা তৈরি করা হয়। পিঠা তৈরি হয়ে গেলে মোমবাতির মতো চুঙ্গা থেকে পিঠা আলাদা হয়ে যায়। চুঙ্গাপিঠা পোড়াতে আবার প্রচুর পরিমাণে খড় (ধানের নাড়া) দরকার পড়ে। সময়ের প্রয়োজনে এখন খড়ের দামও একটু বেশি।
একটা সময় ছিলো শীতের মৌসুমে গ্রামীণ জনপদে প্রায়ই বাজারে মাছের মেলা বসত, বিশেষ করে সনাতনী হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম উৎসব পৌষ সংক্রান্তির সময় এ বাঁশগুলো মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ভানুগাছ, আদমপুর, মুন্সীবাজারসহ বিভিন্ন হাটবাজারে দেখা যেতো।
পিঠা তৈরির জন্য মুন্সীবাজারে ঢলুবাঁশ নিতে আসা নিবাস চন্দ আমাদের মৌলভীবাজার সংবাদদাতাকে জানান, ‘‘আসলে সব সময় তো এই জিনিসগুলো পাওয়া যায় না। পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে এগুলো খুব কম পরিমাণ বাজারে উঠেছে। আজ থেকে ১০/১৫ বছর আগে প্রচুর দেখা যেত। এখন কালের পরিবর্তনে হারিয়ে বসেছে। বাজারে আসার সময় পরিবারের সদস্যরা বললো পিঠা তৈরির জন্য এই ঢলুবাঁশ পেলে নিয়ে যেতে, তাই কয়েকটা বাজার ঘুরে দেখলাম, পাইনি। এখন মুন্সীবাজারে স্বল্প পরিমাণ নিয়ে এসেছে এক বিক্রেতা। আমি সেখান থেকে নিয়ে যাচ্ছি বাসায়।
কমলগঞ্জ উপজেলার লেখক-গবেষক ও উন্নয়নচিন্তক আহমদ সিরাজ জানান, ‘আগে কম-বেশি সবার বাড়িতে ঢলুবাঁশ ছিল। এখন সেই বাঁশ আর আগের মতো নেই। এই বাঁশ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। একসময় এই ঢলুবাঁশ দিয়ে চুঙ্গাপুড়ার ধুম লেগেই থাকত। ধীরে ধীরে তা আজ প্রায় বিলু্প্তির দিকে।
তাই বাঁশটিও সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া জরুরী। প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় সচেতন সমাজ ঐতিহ্য রক্ষাকারী ঢলুবাঁশ সংরক্ষণে উদ্যোগ না নিলে হয়তো অদূর ভবিষ্যতে এটি আমাদের স্মৃতির পাতায় চলে যাবে।