মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক জননেতা পীর হবিবুর রহমান’র ২০তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন

চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী
সিলেট অফিসঃ
 ভাষা সৈনিক, অবিভক্ত পূর্ব-পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমএলএ), মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, আজীবন অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ, এদেশের বাম গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব, মুক্তচিন্তার লেখক ও কলামিস্ট, সিলেট-৩ আসনের সাবেক এমপি, গণতন্ত্রী পার্টির সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি, সিলেটের কৃতীসন্তান, মজলুম জননেতা পীর হবিবুর রহমান-এর ২০তম মৃত্যুবার্ষিকী ১৬ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালন করা হয়েছে।
পালিত কর্মসূচির মধ্যে ছিল সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার লালাবাজার ইউনিয়নের বাগরখলা গ্রামস্থ পীরবাড়ির পারিবারিক কবরস্তানে মরহুমের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন, কবর জিয়ারত, বাড়িতে পবিত্র কোরআন খতম, স্মরণ সভা, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল এবং শিরণী বিতরণ।
অনুষ্ঠানসমুহে অংশ নেন গণতন্ত্রী পার্টির কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সিলেট জেলা সভাপতি মোঃ আরিফ মিয়া, জেলা ঐক্য ন্যাপ সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা সুবল চন্দ্র পাল, যুক্তরাজ্যের টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের সাবেক মিডিয়া অফিসার নজরুল ইসলাম বাসন, যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত, বিশ্বের বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে বহুল জনপ্রিয় দৈনিক সত্যবাণী পত্রিকার সম্পাদক ও স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের রাজপথ কাঁপানো তুখোড় ছাত্রনেতা সৈয়দ আনাস পাশা, জেলা বাসদ আহবায়ক কমরেড আবু জাফর, জেলা গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক জুনেদুর রহমান চৌধুরী, নগর শাখার সাধারণ সম্পাদক শ্যামল কপালী, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের রাজপথ কাঁপানো তুখোড় ছাত্রনেতা ও জেলা ঐক্য ন্যাপ-এর সাধারণ সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস বাবুল, জেলা গণতন্ত্রী পার্টির দপ্তর সম্পাদক আজিজুর রহমান খোকন, বাসদ নেতা জুবায়ের আহমদ চৌধুরী, ঐক্য ন্যাপ নেতা মাওলানা নুরুল ইসলাম চৌধুরী, মীর আনসার আহমদ, সৈয়দ মোক্তার আহমদ, সুনীল চন্দ্র দেব, গণতন্ত্রী পার্টির সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলা সভাপতি অধ্যক্ষ মিহির রঞ্জন দাস, মরহুমের নাতি বেলায়েত হোসেন লিমন প্রমুখ। মোনাজাত পরিচালনা করেন মরহুমের জামাতা, প্রিন্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্ব রোটারিয়ান মোহাম্মদ মনির উদ্দিন চৌধুরী। অনুষ্ঠানসমুহে মরহুমের আত্মীয়-স্বজন, রাজনৈতিক, সামাজিক নেতৃবৃন্দ, গণ্যমাণ্য ব্যক্তিবর্গ ও সুধীজন উপস্থিত ছিলেন।
স্মরণ সভায় বক্তারা বলেন, পীর হবিবুর রহমান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬ দফা, ১১ দফা, মহান মুক্তিযুদ্ধ, পরবর্তীতে দেশ গড়ার আন্দোলন, গরীব, দুঃখী, খেটে-খাওয়া মানুষের কল্যাণে আজীবন রাজনীতি করে গেছেন। তিনি যে স্বপ্ন নিয়ে রাজনীতিতে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তা অনুকরণীয়। আজ বাংলাদেশের রাজনীতিতে জননেতা পীর হবিবুর রহমান-এর মতো ত্যাগী রাজনীতিবিদের বড়ো প্রয়োজন। তিনি বাম রাজনীতির পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
উল্লেখ্য, পীর হবিবুর রহমান ১৯২৭ সালের ৯ অক্টোবর বাগরখলা গ্রামের পীরবাড়ির সৈয়দ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। প্রথম রাজনৈতিক জীবনে তিনি তৎকালীন সর্বভারতীয় তুখোড় রাজনীতিবিদ জননেতা আবুল হাশেমের প্রভাবে মুসলিম লীগের সাথে সম্পৃক্ত হন। ১৯৪৮ সালে পীর হবিবুর রহমান নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। একই সালে তিনি সিলেটের নানকার আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন হলে তিনি এর সিলেট জেলা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫১ সালের ১৬ নভেম্বর তিনি সিলেট জেলা ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সিলেট জেলা ছাত্র ইউনিয়ন-ই ১৯৫২ সালে ঢাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন নামে প্রতিষ্ঠা পায় এবং পরবর্তীতে অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, মুক্তচিন্তার ছাত্র সংগঠন হিসেবে দেশে-বিদেশে ব্যাপক সুনাম কুড়ায়।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি সিলেটে সক্রিয় ভুমিকা পালন করেন। ১৯৫৬ সালে পীর হবিবুর রহমান সিলেট জেলা আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এর পাশাপাশি একই সালে সিলেট সদরের একটি আসনের উপ-নির্বাচনে তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ থেকে প্রগতিপন্থী রাজনীতিবিদরা একযুগে বের হয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) প্রতিষ্ঠা করেন। ন্যাপের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন ‘সীমান্ত গান্ধী’ খ্যাত পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ত্যাগী রাজনীতিবিদ জননেতা খান আব্দুল গাফফার খান। সে সময় পীর হবিবুর রহমান পার্টির প্রাদেশিক কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬৭ সালে মস্কো-পিকিং অনুসারীদের পৃথক অবস্থানের কারণে ন্যাপ বিভক্ত হলে তিনি ন্যাপ (ওয়ালী)তে অবস্থান নেন। তখন ন্যাপের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন ‘সীমান্ত গান্ধী’ জননেতা খান আব্দুল গাফফার খান-এর ছেলে জননেতা খান আব্দুল ওয়ালী খান। আর একই পার্টির পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক কমিটির সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। একই সালেই তিনি পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের যুগ্ম সম্পাদক এবং পরে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি অবিভক্ত পাকিস্তান ন্যাপেরও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।
১৯৬৮ সালে তিনি বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত হন। ১৯৬৮ সালে ন্যাপ (মোজফ্ফরের)পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ তথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে যুক্ত হয়ে তিনি আইয়ুব বিরোধী মোর্চা গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৮ সালের ১৩ ডিসেম্বর তিনি জুলুম প্রতিরোধ দিবসের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ৬ দফা আন্দোলন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্দোলনসহ তৎকালীন সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত মুক্তিবাহিনীর প্রধান হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। এই মুক্তিবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে ২৩ হাজারের মতো।
১৯৭৭ সালে ন্যাপ (মোজাফ্ফরের) কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৫ দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে সিলেট-৩ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
১৯৮৬ সালে ন্যাপ (মোজাফফর), ন্যাপ (হারুন) ও একতা পার্টি মিলে ঐক্য ন্যাপ গঠন করা হয়। তখন তিনি এই পার্টি গঠনে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং ঐক্য ন্যাপ-এর প্রেসিডিয়ামের সিনিয়র সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৯০ সালের ৩০ আগস্ট গণতন্ত্রী পার্টি গঠিত হলে তিনি পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে ছিলেন এবং সর্বশেষ কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। এরআগে তিনি বাংলাদেশ কৃষক সমিতির সভাপতিও ছিলেন। ২০০১ সাল থেকে স্বাস্থ্যগত কারণে তিনি রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন।
মজলুম জননেতা পীর হবিবুর রহমান ২০০৪ সালে ১৬ ফেব্রুয়ারি সিলেটে মৃত্যুবরণ করেন। বাগরখলা গ্রামের পীরবাড়ির পারিবারিক কবরস্তানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

You might also like